ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বাবা-মাসহ শিক্ষকদের কাছে অপমানিত হয়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রি অধিকারী সোমবার আত্মহত্যা করে। এ ঘটনার পর সহপাঠীকে ‘আত্মহত্যার প্ররোচনায়’দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মঙ্গলবার আন্দোলনে নামে বিদ্যালয়ের শিকার্থীরা। টানা তিনদিন আন্দোলন চলার পর বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টার দিকে আন্দোলন স্থগিত করে পরীক্ষা ও ক্লাসে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়।
এর আগে মঙ্গল ও বুধববারের মতো বৃহস্পতিবার সকালেও কলেজ ভবনের গেটের সামনে অবস্থান নেয় শিক্ষার্থীরা। সেখানে বুধবার উত্থাপন করা ছয় দফা দাবি পুনর্ব্যক্ত করা হয়।
তবে দুপুরের দিকে হঠাৎ স্কুল ভবনের পূর্বদিকের গেটে মিনিট দশেকের মতো অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ভিকারুননিসার শ্রেণি শিক্ষিকা হাসনা হেনার নিঃশর্ত মুক্তি চায়। যাকে বুধবার রাতে রাজধানীর উত্তরার একটি হোটেল থেকে গ্রেফতার করে ডিবি কার্যালয়ে নেয়া হয়।
উদ্ভুত পরিস্থিতিতে দুপুরে জরুরি বৈঠকে বসেন ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষকরা। এরপর বেলা দেড়টার দিকে পরিচালনা কমিটির সভাপতি গোলাম আশরাফ তালুকদার দুঃখ প্রকাশ করে সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের বৃহত্তর স্বার্থে যদি আমাকে পদত্যাগ করতে হয় বা সরে যেতে হয় তাতে আমি রাজি।’
এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের পক্ষে আনুষকা ও অধরা নামের দুই শিক্ষার্থী তাদের ছয় দফা দাবি মন্ত্রণালয়ে গিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বরাবর জমা দিয়ে আসেন। মন্ত্রণালয় থেকে ছয় দফা দাবি গ্রহণ করা কপি হাতে দুপুর ২টা ৫০ মিনিটের দিকে আন্দোলন স্থলে ফিরে আসেন ওই দুই শিক্ষার্থী।
এর আগেই জরুরি বৈঠক শেষে দুপুর আড়াইটার দিকে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের এক শিক্ষিকা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থামিয়ে স্কুল ভবনে প্রবেশের জন্য আহ্বান জানান। ওই শিক্ষিকা কলেজ ভবনের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে মিনিট দশেক দুই শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেন। তিনি গেটের ভেতরে প্রবেশের পর আনুষকা ও অধরাসহ অন্য শিক্ষার্থীরা ভবনের ভেতরে চলে যান।
এরপর বিকেল ৩টার দিকে শিকার্থীদের সঙ্গে শুরু হয় শিক্ষকদের বৈঠক। সাড়ে ৩টার দিকে খবর আসে ভিকারুননিসার শ্রেণি শিক্ষিকা হাসনা হেনাকে আদালতে হাজির করা হয়েছে এবং আদালত জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
কিন্তু ভেতরে প্রবেশের পর এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও কোনো শিক্ষার্থী বাইরে বেরিয়ে না আসায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন বাইরে অপেক্ষমাণ অভিভাবকরা। এক পর্যায়ে ৪টা ২০ মিনিটের দিকে ক্ষিপ্ত হয়ে কতিপয় অভিভাবক জোর করে গেটের ভেতরে ঢুকে পড়েন। এ সময় তাদের সঙ্গে সংবাদকর্মীরাও প্রবেশ করেন। এরপর ৪টা ৩০ মিনিটের দিকে বৈঠক থেকে বেরিয়ে আসেন শিক্ষার্থীরা।
বাইরে এসে আনুষকা সাংবাদিকদের বলে, ‘শিক্ষকরা আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ২,৩ ও ৪ নম্বর দাবির বিষয়ে তারা কাজ করবেন এবং জলদি আমাদের লিখিত প্রতিশ্রুতি দেয়া হবে। ৬ নম্বর দাবিও শিক্ষকরা মেনে নিয়েছেন।’
শিক্ষার্থীদের ২ নম্বর দাবিতে বলা হয়, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর সমন্বয়ে তাদের নিজস্ব আচরণ ও চারিত্রিক বৈশিষ্টের ওপর ভিত্তি করে এবং মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে তাদের আলাদা যত্ন নিশ্চিত করতে হবে। কোনোভাবেই কোনো শিক্ষক শারীরিক ও মানসিক চাপ ও অত্যাচার করতে পারবেন না।
৩ নম্বর দাবিতে বলা হয়েছে, কথায় কথায় শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারের হুমকি দেয়া বন্ধ করতে হবে এবং ৪ নম্বর দাবিতে বলা হয়েছে, বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষকরা ও কর্মরত সবার মানসিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে মানসিক পরামর্শদাতা থাকতে হবে। শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে পরামর্শদাতার প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে হবে। আর ৬ নম্বর দাবিতে বলা হয়েছে, অরিত্রির মা-বাবার সঙ্গে দুর্ব্যবহারের জন্য অধ্যক্ষ ও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে।
শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবির মধ্যে এক নম্বরে বলা হয়, অধ্যক্ষের পদত্যাগ এবং ৩০৫ ও ৩০৬ ধারায় আত্মহত্যার প্ররোচনার অপরাধে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আর ৫ নম্বরে বলা হয়েছে, গভার্নিং বডির সবাইকে পদত্যাগ করতে হবে।
এ বিষয়ে অরিত্রির সহপাঠী আনুষকা বলে, ‘আমাদের দাবিগুলোর বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে এসেছি। ১ ও ৫ নম্বর দাবির বিষয়ে আমরা শিক্ষকদের কাছ থেকে কিছু আশা করতে পারি না, কারণ এটা তাদের হাতে নেই। এটা এখন মন্ত্রণালয়ের বিষয়। আমরা বিশ্বাস করি মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে এবং শিক্ষামন্ত্রী দ্রুত এর প্রতিফল দেখাবেন।’
‘আমরা নির্দোষ কোনো শিক্ষার্থী বা শিক্ষকের হয়রানি চাই না। আমরা দির্দোষ কোনো মানুষের হেনস্তা মেনে নেব না। শিক্ষকরা আমাদেরই অংশ। শিক্ষকদের বিপক্ষে আমরা না’ বলে আনুষকা।
এ সময় পাশে থাকা তার আরেক সহপাঠী অধরা বলে, ‘শিক্ষকরা প্রতিশ্রুতি দেয়ায় আমরা আন্দোলন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা আগামীকাল (শুক্রবার) পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করব এবং ক্লাসে ফিরে যাব।’
শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠক চলাকালে অভিভাকদের উদ্বিগ্ন দেখা যায়। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে অধরা বলে, ‘আমাদের ওপর কোনো চাপ প্রয়োগ করা হয়নি।’
আন্দোলন শেষ করে পরের দিনই পরীক্ষায় বসতে কোনো সমস্যা হবে কি না? এমন প্রশ্নের উত্তরে অধরা বলে, ‘আমাদের কোনো সমস্যা হবে না। আমরা বলেছিলাম যে মুহূর্তে আমাদের দাবি মেনে নেয়া হবে, তখনই আমরা ক্লাসে ফিরে যাব। আমরা আগে যে কথাগুলো বলেছি, এখনো তাই বলছি।’
এ সময় শিক্ষার্থীদের আর একটি অংশ ভিকারুননিসার শ্রেণি শিক্ষিকা হাসনা হেনার নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করে কলেজ গেটের সামনে অবস্থান নেন। যেখানে তিনদিন ধরে অরিত্রির ‘আত্মহত্যার প্ররোচনায়’দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে অবস্থান করছিলেন তার সহপাঠীরা। হাসনা হেনার নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করা এ শিক্ষার্থীরা এর আগে স্কুলের পূর্বদিকের গেটে দাঁড়িয়েছিল। তবে সেখানে মিনিট দশেক থাকার পর তারা দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত স্কুল ভবনের ভেতরে অবস্থান নেয়।
অরিত্রির আত্মহত্যার কারণ সম্পর্কে তারা বাবা দিলীপ অধিকারী বলেছিলেন, ‘অরিত্রির স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা চলছিল। রোববার সমাজবিজ্ঞান পরীক্ষা চলার সময় তার কাছে একটি মোবাইল ফোন পাওয়া যায়। এ জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাদের ডেকে পাঠায়। সোমবার স্কুলে গেলে কর্তৃপক্ষ আমাদের জানায়, অরিত্রি মোবাইল ফোনে নকল করছিল, তাই তাকে বহিষ্কারের (টিসি) সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’
‘স্কুল কর্তৃপক্ষ আমার মেয়ের সামনে আমাকে অনেক অপমান করে। এ অপমান এবং পরীক্ষা আর দিতে না পারার মানসিক আঘাত সইতে না পেরে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। বাসায় ফিরে ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দেয় অরিত্রি’ বলেন সন্তান হারা দিলীপ।
এ ঘটনার পর মঙ্গলবার রাত ১০টায় রাজধানীর পল্টন থানায় ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস, প্রভাতী শাখার প্রধান জিনাত আক্তার ও শ্রেণি শিক্ষিকা হাসনা হেনার বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা করেন অরিত্রির বাবা। এরপর শিক্ষামন্ত্রণালয় ওই তিন শিক্ষককে বরখাস্তোর নির্দেশ দেয়।
এর আগে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামার পরপরই মঙ্গলবার শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এরপর সকাল ১১টার দিকে ভিকারুননিসা নূন স্কুলে যান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। সেখানে শিক্ষার্থীদের বোঝানোর চেষ্টা করেন মন্ত্রী। তবে শিক্ষার্থীরা এ সময় মন্ত্রীর কথা না শুনে প্রিন্সিপালের পদত্যাগ দাবি করতে থাকে।