ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে প্রকাশ হওয়া এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ধরনের ৯৬ শতাংশ মার্জিনের বিজয়ের ফল উত্তর কোরিয়ার মতো দেশে প্রত্যাশা করা যায়, কোনোভাবেই বাংলাদেশের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশে নয়।
নিচে পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটির বঙ্গানুবাদ তুলে ধরা হলো :
বিশ্বের একাদশতম জনবহুল দেশ, বাংলাদেশে গত রোববার এক দশকে তার প্রথম প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে দেখা গেছে। কিন্তু এর ফল হয়েছে রুদ্ধ ধরনের। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মতাসীন জোট সংসদে ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮ টিতে জিতেছে।
এই ধরনের ৯৬ শতাংশ মার্জিনের বিজয়ের ফল উত্তর কোরিয়ার মতো দেশে প্রত্যাশা করা যায়, কোনোভাবেই বাংলাদেশের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশে নয়।
ঠিক এটাই হলো সমস্যা যে, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী নেতা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় তার নিয়ন্ত্রণকে সুসংহত করছিলেন। কিন্তু এটি তিনি করেছেন নিজের নির্বাচনী বৈধতার বিনিময়ে।
বিরোধীরা হতাশাজনক এই ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে। আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা এবং বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘আমরা নির্বাচন কমিশনকে এই নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করে নতুন নির্বাচন দেয়ার আহ্বান জানাই।’
তবে সোমবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার নতুন নির্বাচনের এই দাবি বাতিল করে দেন। এই ফলাফল শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি হাসিনাকে রাজনৈতিক বিরোধী ও তার সরকারের সমালোচকদের দমনের সাথে সাথে নিজ কর্তৃত্ব চালিয়ে যাওয়ার পথ তৈরি করবে।
বাংলাদেশে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ কোনো সময়ে হয় না। পুলিশের একজন মুখপাত্রের মতে, দুটি প্রধান দলের সমর্থকেরা সাধারণত রাস্তায় সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে এবং এবারের নির্বাচনে সহিংসতায় অন্তত ১৭ জন নিহত হয়েছে। বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ এবার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, হাসিনা এবারের নির্বাচনে জয়ী হবেন তবে তাদের মধ্যে অল্প কয়েকজনই এই মাত্রার ভূমিধস বিজয় প্রত্যাশা করেছিলেন। এবারের নির্বাচনে হাসিনার আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের শেষবারের চেয়েও ভালো করেছে। আগেরবার বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করে এবং অনেক আসনে তখন একাধিক প্রার্থী ছিলেন না।
অবাস্তব ভোটের ব্যবধানসহ এবার পোলিং স্টেশনগুলোতে অনিয়মের নানা খবর ছড়িয়ে পড়েছে। তবে পর্যবেকরা বলেন, রোববারের অনেক আগে থেকেই হাসিনা তার পে জয়ের এই ত্রেটি তৈরি করার জন্য নানা উপায় ব্যবহার করেছিলেন। বিরোধীদলীয় প্রার্থীরা বলেছেন, তারা প্রচারণা চালানোর চেষ্টা করার সময় সহিংসতা, হুমকি ও হয়রানির শিকার হন; বিএনপি জানায়, দলটির এক ডজন প্রার্থীকে উদ্দেশ্যমূলক অভিযোগ এনে গ্রেফতার করা হয়। রাজধানী ঢাকায় বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের পোস্টার ছিল না বললেই চলে।
রয়টার্সের খবর অনুসারে, সোমবার ভোট জালিয়াতির অভিযোগ অস্বীকার করে হাসিনা সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি একটি মুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছিলেন এবং তিনি অবাক হয়েছিলেন যে বিরোধী দল সক্রিয়ভাবে প্রচারণা চালাচ্ছে না।
এদিকে ভোটারদের একটি কঠিন বিকল্প পছন্দ করতে হয়েছে। হাসিনা ভিন্ন মতাবলম্বীদের প্রতি ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছেন এবং মতা ছেড়ে দেয়ার কোনো ইচ্ছা তার রয়েছে এমনটি দেখা যায়নি। তবে তিনি একটি গতিশীল অর্থনীতি তৈরি এবং দারিদ্র্য হ্রাসে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছেন। মিয়ারমারের উদ্বাস্তুদের জন্য তিনি তার দেশের দরজা খুলে দিয়ে প্রশংসিত হয়েছেন।
শেখ হাসিনাকে প্রতিবেশী ভারতসহ অনেকে বাংলাদেশে ইসলামপন্থী চরমপন্থার সম্ভাব্য বিস্তারের বিরুদ্ধে সহযোগী হিসাবে দেখেছেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির এখন এক ধরনের বিধ্বস্ত অবস্থা। দলটির নেতা ও হাসিনার প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়া এই বছরের শুরুতে দুর্নীতির অভিযোগে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। অক্টোবরে ব্রিটেনে বসবাসরত তার ছেলেকে ২০০৪ সালে হাসিনাকে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে অন্য ১৯ জনের সাথে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়।
দিল্লির রাজনৈতিক ভাষ্যকার কাঞ্চন গুপ্ত লিখেছেন, “রোববারের নির্বাচনের পর বাংলাদেশে ‘এক দলীয় গণতন্ত্র’ হয়ে উঠেছে। হাসিনার বিরোধীদের নামমাত্র আসন প্রাপ্তির অর্থ হলো তাকে কোনো ধরনের জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে না।”
বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির সভাপতি আতাউর রহমান বলেন, হাসিনার বিজয় সত্ত্বেও নির্বাচনের ন্যায্যতা নিয়ে ‘গুরুতর সন্দেহ’ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বিরোধীদলীয় স্বল্প আসনের অর্থ হলো রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার কোনো ব্যবস্থা থাকল না। অ্যাক্টিভিস্ট এবং সাংবাদিকরা সরকারের সমালোচনায় ভীতিজনক পরিবেশ সৃষ্টির অভিযোগ করে এর বিপজ্জনক পরিণতি হতে পারে বলে মন্তব্য করেন। গত সেপ্টেম্বর হাসিনার সরকার একটি নতুন ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা’ আইন পাস করে যাতে ‘প্রচারণার’ জন্য জেলের বিধান করা হয়। সম্পাদকরা এটি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করতে পারে বলে উল্লেখ করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশের নির্বাচনের এক দীর্ঘ সময়ের পর্যবেক বলেন, ‘বাংলাদেশে বিকাশের গল্পটি ঊর্ধ্বমুখী বক্ররেখা এবং গণতন্ত্রের গল্প একটি নি¤œতর বক্ররেখা।’
গত গ্রীষ্মে বাংলাদেশকে নিরাপত্তা প্রতিবাদের আন্দোলন সম্পর্কে ‘উত্তেজক’ বিবৃতি দেয়ার অভিযোগে বিখ্যাত ফটোগ্রাফার শহিদুল আলমকে আগস্ট মাসে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে তাকে জেলে রাখা হয়েছিল। সম্প্রতি টেলিভিশন সাাৎকারে এই বিখ্যাত ফটোগ্রাফার আলম বলেন, ‘নিজের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হলে তা সবচেয়ে বড় শাস্তি হিসেবে বিবেচিত হয়, এটি করার পর সমগ্র জাতিকে অব্যাহত শাস্তি দেয়া হচ্ছে।’