ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বাংলাদেশের সংবিধান সংসদের মেয়াদ ৭২ (৩) মোতাবেক ৫ বৎসর নিশ্চিত করেছে। সংবিধান মোতাবেক সংসদ ভেঙ্গে দেওয়ার ক্ষেত্রে দুইটি পন্থা অনুসরণীয় ১. মেয়াদ অবসানের কারণে ২. রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মেয়াদ অবসান ব্যতিত ভেঙ্গে দেওয়া।
বাংলাদেশের দশম সংসদ রাষ্ট্রপতি এখনও ভেঙ্গে দেন নি। ফলে দশম সংসদ ২৮শে জানুয়ারি ২০১৯ পর্যন্ত সাংবিধানিক ভাবে বিদ্যমান। কিন্তু দশম সংসদের মেয়াদ সমাপ্তির আগেই একাদশ সংসদের শপথ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে। যা সংবিধানের গুরুতর লঙ্ঘন। বিশ্বের কোন দেশে সংসদের মেয়াদ সমাপ্তি না করে পরবর্তী সংসদের কার্যক্রম শুরু হয় না। শুধু বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম। আওয়ামী লীগ সরকার প্রবর্তিত সংবিধানের ১২৩(৩)ক মোতাবেক দশম এবং একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
দুবারই সংবিধান লঙ্ঘন করেছে নির্বাচন কমিশন।
দশম সংসদের মেয়াদ অক্ষুন্ন রাখার শর্তে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংবিধানের ১২৩(৩)ক মোতাবেক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১২৩(৩)ক মোতাবেক জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি অপরিহার্য শর্ত রয়েছে। এই শর্ত পূরণের ভিত্তিতেই যেহেতু একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তাই এ শর্ত পূরণ অপরিহার্য- এই শর্ত অলঙ্ঘনীয়।
১২৩(৩)ক তে বলা হয়েছে, “মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে… তবে শর্ত থাকে যে এই দফার (ক) উপদফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগন, উক্ত উপদফায় উল্লিখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত, সংসদ সদস্য রূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।” অর্থাৎ দশম সংসদের মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত একাদশ সংসদ কার্যভার গ্রহণ করতে পারবে না। এটা সংবিধানের সুস্পষ্ট নির্দেশনা – এই নির্দেশনা একাদশ সংসদের নির্বাচিতগণ ও প্রজাতন্ত্রের সরকার মানতে বাধ্য। নির্বাচন কমিশন ২৮শে জানুয়ারির পূর্বে একাদশ সংসদের কার্যক্রম শুরু বা উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন না। একাদশের নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা গেজেট প্রকাশ সব হবে ২৮শে জানুয়ারির বিবেচনায়, যাতে দশম সংসদের মেয়াদ ক্ষুন্ন না হয়। নির্বাচন কমিশন সংবিধানের ১৪৮(২)ক মতে যদি ২৮শে জানুয়ারি গেজেট প্রকাশ করতো, তা হতো সংবিধান অনুসরণে। সংবিধানের যে শর্তে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো তা অনায়াশে লঙ্ঘন করে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন এবং সরকার।
সংবিধানের সুস্পষ্ট নির্দেশনা ও বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও ২৮শে জানুয়ারির পূর্বেই তড়িঘড়ি করে শপথ গ্রহণ ও সরকার গঠন করা হবে অসাংবিধানিক। সাংবিধানিকভাবে একাদশ সংসদের শপথ ও সরকার গঠন অবশ্যই হতে হবে ২৮শে জানুয়ারির পর। এর ব্যতয় ঘটলে নির্বাচন কমিশন এবং সরকার সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হবেন।
এই আইন ভঙ্গ করার কোন সাংবিধানিক এক্তিয়ার রাষ্ট্রের কোন প্রতিষ্ঠানের নেই। নির্বাচন কমিশনও কোন সংসদের মেয়াদকে সীমিত করতে পারে না। দশম সংসদের মেয়াদ একদিনের জন্য সীমিত করার ক্ষমতা সরকার বা একাদশ সংসদের নেই।
যেহেতু ১২৩(৩)ক অনুযায়ী একাদশ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সেহেতু সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার সাংবিধানিক বিধান কার্যকর করার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। যেহেতু দশম সংসদ ভেঙ্গে দেওয়া হয় নি তাই এর মেয়াদ অবসানের আগে একাদশ সংসদ সদস্যদের শপথ বা সরকার গঠনের সাংবিধানিক এক্তিয়ার নেই।
১২৩(৩)ক শর্ত যুক্ত অনুচ্ছেদটি আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এক সংসদের মেয়াদ বিদ্যমান থাকা অবস্থায় আরেক সংসদের শপথ সংবিধান ও সংবিধানের চেতনার সঙ্গে চরম সাংঘর্ষিক।
সংবিধান হচ্ছে প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুন্ন রাখা এবং এর রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য হিসাবে প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা রয়েছে। যদি ১২৩(৩)ক এর শর্ত লঙ্ঘিত হয় তাহলে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭২, ৯৩, ৯৮, ১১৮, ১৩৩, ১৩৫, ১৩৮, ১৪১, ১৪২, ১৪৫, ১৪৭ ও ১৫৩ অনুচ্ছেদের সকল শর্ত অকার্যকর হয়ে পড়বে। এতে রাষ্ট্র ও সংবিধানিক শাসন ব্যবস্থা লন্ডভন্ড হয়ে পড়বে।
ভারতের সংবিধান প্রণেতা ড.আম্বেদকর বলেছেন, “সাংবিধানিক আইনকে সাংবিধানিক নৈতিকতার একটি বুনিয়াদের উপর ভর করতে হয়। ড.আম্বেদকর মতে, সাংবিধানিক নৈতিকতা স্বাভাবিক অনুভূতি নয়। এটা চর্চার মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। যতই সতর্কভাবে সংবিধান রচিত হোক না কেন, সাংবিধানিক নৈতিকতার অনুপস্থিতিতে সংবিধানের ক্রিয়া পদ্ধতি স্বেচ্ছাচারী, অযৌক্তিক ও খামখেয়ালী (arbitrary, erratic and capricious) হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আইনপ্রণেতা ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে সাংবিধানিক নৈতিকতার অনুপ্রবেশ না ঘটলে সংবিধানটি ক্ষমতার দালালদের হাতের খেলনা হয়ে দাঁড়ায়।” আমাদের সংবিধান লঙ্ঘন ও উপেক্ষা করার মধ্যমে ক্ষমতাসীনদের হাতের খেলনায় পরিণত হচ্ছে।
২৮শে জানুয়ারির পূর্বে একাদশ সংসদ সদস্যদের শপথ এবং সরকার গঠনের দ্রুত উদ্যোগ হবে অসাংবিধানিক ও রাষ্ট্রের জন্য বিপদজনক।
সংবিধানের প্রাধান্য, নির্দেশনা, বিধি বিধান, শর্ত লঙ্ঘন করে সংবিধানকে সরকারের অনুকূলে ব্যবহার করার প্রবণতা সাংবিধানিক ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দিবে।
সংবিধান ও সংবিধানিক চেতনাকে অস্বীকার করে রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা সম্ভব হবে না বরং ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মাকে ক্রমাগতভাবে অসম্মান করা হবে।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের এই মুহূর্তেই উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।