ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যাপারে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ‘নেতিবাচক’ মনোভাব দেখিয়েছেন বলে তার আইনজীবিরা জানিয়েছেন। বিশেষ সূত্র মতে, বেগম জিয়া বলেছেন, ‘ঐক্যফ্রন্টে আমাদের লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হয়েছে। তারা (ঐক্যফ্রন্টের নেতারা) শুধু নিয়েছে কিছু দিতে পারেনি। তাদের কথাবার্তায় বিএনপি সম্পর্কে মানুষের ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছে।’
রোববার দুপুরে নাইকো দুর্নীতি মামলার হাজিরা দিতে এসে খালেদা জিয়া দলের আইনজীবী এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের সঙ্গে দলের নীতিনির্ধারণী বিষয় নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলেছেন বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, বেগম জিয়া নাকি এও বলেছেন, ২০ দলীয় ঐক্যজোট এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এই দুই জোটের মধ্যে যদি কোনোটিকে ছেড়ে দিতেই হয় তবে যেন ঐক্যফ্রন্টকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কোনো অবস্থতেই যেন ২০ জোটে ভাঙ্গনের সৃষ্টি না হয়।
পুরাতন ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের কারাগারে ঢাকার ৯ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের অস্থায়ী এজলাস বসে। এই মামলায় দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে বেগম জিয়াকে হুইল চেয়ারে হাজির করা হয়। এসময় মামলার অন্য আসামি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ তার নিজের শুনানি করছিলেন। মামলার চার্জ গঠনের বিরোধিতা করে তিনি বক্তব্য রাখছেন। আদালতে প্রবেশের খানিকপর তিনি বিরোধী দল প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন। মওদুদ আহমেদের শুনানি অসমাপ্ত রেখেই দুপুর দেড়টায় শুনানি ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত মূলতবি ঘোষণা করা হয়। এরপর বেগম জিয়া তার আইনজীবী এবং ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের সঙ্গে প্রায় দশ মিনিট কথা বলেন।
বেগম জিয়া সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত কোনো অবস্থাতেই যাতে পরিবর্তন না হয় সে নির্দেশনাও দিয়েছেন বলে জানা গেছে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ বলেছেন, ‘আমরা সংসদ সদস্যদের শপথ না নেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ম্যাডাম তা সমর্থন জানিয়েছেন।’ ‘তথাকথিত এই নির্বাচনে আমাদের যে ক’জন, তারা শপথ নিলেই এই সংসদ বৈধতা পাবে। সেটা আমরা চাই না। ম্যাডামও চান না।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বেগম জিয়া ২০ দলের ঐক্যকে অটুট রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। কোন অবস্থাতেই ২০ দলের ঐক্য যেন বিনষ্ট না হয় সেদিকে নজর রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। সেইসঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যাপারে বিএনপি চেয়ারপারসন ‘নেতিবাচক’ মনোভাব দেখিয়েছেন। বেগম জিয়া বলেছেন, ‘ঐক্যফ্রন্টে আমাদের লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হয়েছে। তারা (ঐক্যফ্রন্টের নেতারা) শুধু নিয়েছে কিছু দিতে পারেনি। তাদের কথাবার্তায় বিএনপি সম্পর্কে মানুষের ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছে।’
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ বলেন, ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আমাদের ছিলো নির্বাচনকালীন কৌশলগত ঐক্য। আর আমাদের ২০ দলের ঐক্য হলো চিন্তা-চেতনা এবং আদর্শের ঐক্য। যেহেতু নির্বাচন শেষ তাই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ম্যাডাম প্রশ্ন তুলেছেন। তবে তিনি সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের পক্ষে মত দিয়েছেন।’
মওদুদ বলেন, ‘আমরা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সকল রাজনৈতিক দলকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দেলন করতে চাই, তবে তা ২০ দলকে বিসর্জন দিয়ে নয়।’ এছাড়া বেগম জিয়া জামাত নিয়ে ড. কামাল হোসেনের বক্তব্যেও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বেগম জিয়া বিএনপির আদর্শ অটুট রাখার জন্য নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন।
এবার নিজের দলকে নিয়ে কঠোর মন্তব্য করলেন খালেদা জিয়া: বিএনপির চেয়ারপারসান খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘বিরোধী দল শুধু পার্লামেন্টে থাকলেই হয় না, বাইরে থাকলেও হয়। বিএনপি যে অবস্থাতেই থাকুক, সব চাইতে জনপ্রিয় দল।’ আজ রোববার রাজধানীর পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে স্থাপিত বিশেষ আদালতের এজলাসে নাইকো দুর্নীতির মামলার আসামিদের অব্যাহতির আবেদনের শুনানিকালে তিনি এ কথা বলেন।
আজ মামলাটির আংশিক চার্জগঠনের শুনানির পর আগামী ২১ জানুয়ারি পরবর্তী শুনানির দিন ঠিক করেছেন আদালত। একই মামলার আরেক আসামি ব্যারিস্টার মাওদুদ আহমদের পক্ষের একটি আবেদনের শুনানি আগামী ১৫ জানুয়ারি ঠিক করা হয়েছে। ঢাকার ৯ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক শেখ হাফিজুর রহমান আজকের শুনানি শেষে এ তারিখ ঠিক করেন। আজ মামলার শুনানি শুরু হওয়ার আগে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলামগীর আদালতে উপস্থিত হন। তিনি মামলার শুনানিরত অবস্থায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে ১০ মিনিটের মতো কথা বলে আদালত থেকে বেরিয়ে যান। এর আগে দুপুর ১২টা ২৪ মিনিটের দিকে খালেদা জিয়াকে হুইল চেয়ারে আদালতে হাজির করা হয়। ওই সময় তার সঙ্গে গৃহকর্মী ফাতেমাও ছিলেন। খালেদা জিয়া আদালত কক্ষে প্রবেশের এক মিনিট পর বিচারক এজলাসে উঠলে মামলার কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথমে আসামি ব্যারিস্টার মাওদুদ আহমদ নিজের অব্যাহতির আবেদনে শুনানিতে গত ৩ জানুয়ারি ধারাবাহিকতায় এজাহার থেকে পড়া শুরু করেন। এজাহারে পড়ার অংশে নাইকোর পক্ষে আইনজীবী হিসেবে এবং মন্ত্রী হিসেবে তার মতামত দেওয়ার সময় আসলে তিনি ওই ডকুমেন্ট আদালতের কাছে দেখতে চান। আর ওই ডকুমেন্ট না হলে শুনানি করতে পারবেন না বলে জানান। ওই সময় বিচারক বলেন, ‘গত তারিখেই আপনার আবেদন দেওয়ার কথা, আপনি তো আবেদনই দেননি।’ এরপর মওদুদ বলেন, ‘আজ একটি আবেদন দিয়েছি। আদেশ দিলে, ফটোকপি সার্টিফাইড কপি দ্রুত পাওয়া যাবে।’ বিচারক এ বিষয়ে দুদকের প্রসিকিউটর মোশারফ হোসেন কাজলের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উনার (মাওদুদ আহমদ) চাহিদামতো তো পাবেন না। মামলায় যা জব্দ আছে তা পাবেন। তবে ডকুমন্টেগুলো অনেক পৃষ্ঠার, আমরা কোনগুলো উনাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করব তা নিশ্চিত নয়। তাই উনারা চাইলে ডকুমেন্টগুলো দেখতে পারেন।’ এরপর বিচারক বলেন, ‘আপনি যেভাবে আবেদন দিয়েছেন, এটা গ্রহণযোগ্য নয়, প্রেসক্রাইব ফর্মে আবেদন দেন, আইন অনুযায়ী পেয়ে যাবেন। আর আপনার মনে হয়, ওই ডকুমেন্টগুলোর বাইরেও অনেক বক্তব্য আছে, সেগুলো বলুন।’ এরপর মাওদুদ আহমেদ এজাহারের বাকি অংশ পড়া শেষে করে চার্জশিটের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ধরে পড়া শুরু করেন। তিনি চার্জশিটের বক্তব্য ধরে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারই নাইকোর সঙ্গে চুক্তি করেছিল। আমরা শুধু ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছি। যারা করেছে তারা আজ আসামির বাইরে। বলতে দ্বিধা নেই, আমরা এখন বিরোধী দলে তাই…।’ মওদুদ আহমদের ওই বক্তব্য শেষ হওয়ার আগেই তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আইনজীবী বোরহান উদ্দিন তাকে বলেন, ‘আমরা তো এখন বিরোধী দলেও নেই।’ তখন মওদুদ আহমদ বিচারকের উদ্দেশে বলেন, ‘মাই লর্ড, আমরা তো এখন কোথাও নেই।’ ওই সময় হুইল চেয়ারে বসে থাকা খালেদা জিয়া বলে ওঠেন, ‘বিরোধী দল শুধু পার্লামেন্টের ভেতরে থাকলেই হয় না, বাইরে থাকলেও হয়। আবার এখন দেখি, বিরোধী দল সরকারের সঙ্গে থেকেও হয়। যারা জনগনের জন্য কথা বলেন, তারাই বিরোধী দল।’
এ সময় যে অবস্থাতেই থাকুক, বিএনপি সব চাইতে জনপ্রিয় দল বলে মন্তব্য করেন খালেদা জিয়া। তখন ‘ঘরেও নেই, বাইরেও নেই, বিএনপি এমন দল’-এ কথা বলেন দুদকের প্রসিকিউটর মোশারফ হোসেন কাজল। জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, ‘অফকোর্স বিএনপি জনপ্রিয়দল।’
এরপর মাওদুদ আহমেদ আবার চার্জশিট থেকে পড়া শুরু করেন এবং বেলা ১টা ৩৫ মিনিটের দিকে বলেন, ‘আমাকে হাইকোর্টে কিছু আগাম জামিনের জন্য যেতে হবে। আজ আর পারব না।’ তখন আদালত তাকে যাওয়ার অনুমতি দেন। এরপর জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব খন্দকার শহীদুল ইসলামের ‘গায়েবি মামলা’য় হাইকোর্ট থেকে জামিন নিতে হবে জানিয়ে আইনজীবী আসাদুজ্জামান আজ শুনানি করতে পারছেন না মর্মে সময় চান। এরপর আসামি ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের পক্ষে আইনজীবী মো. জাহেদুল ইসলাম কোয়েল অব্যাহতির শুনানিতে বলেন, ‘মামলার এজাহারের তার নাম ছিল না। সেলিম ভূঁইয়া নামে এক আসামির স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে তাকে আসামি করা হয়। তবে ওই স্বীকারোক্তিতে এমন কোনো বক্তব্য নেই যে তাকে আসামি করা যায়। তাই তিনি অব্যাহতি পাবেন।’ এরপর আসামি সাবেক সিনিয়র সহকারী সচিব সি এম ইউছুফ হোসাইন নিজেই নিজের অব্যাহতির শুনানিতে বলেন, ‘আমার ওপরে সচিবসহ আরও কর্মকর্তারা ছিলেন। একজন সিনিয়র সহকারী সচিব কি ডিসিশন মেকার? আমাকে ডিসিশন মেকার করে দিয়ে আসামি করা হয়েছে। আমার কোনো দোষ নেই। এই ভুয়া মামলায় আমার পেনশনও বন্ধ করে রাখা হয়েছে। আমি অব্যাহতি চাই।’
এরপর আসামি সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একে এম মোশাররফ হোসেন অসুস্থ উল্লেখ করে তার আইনজীবী সময় প্রার্থনা করেন। সর্বশেষ গত ৩ জানুয়ারি অব্যাহতির আবেদন করে শুনানি করা ঢাকা ক্লাবের সাবেক সভাপতি সেলিম ভূঁইয়ার আরেক আইনজীবী এদিন নাইকো সংক্রান্তে কোনো টাকা আসামি মামুনকে দেননি বলে শুনানি করে তার অব্যাহতির আবেদন করেন। মামলাটিতে নাইকোর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট কাশেম শরীফ, তখনকার প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও বাপেক্সের সাবেক মহাব্যবস্থাপক মীর ময়নুল হকও আসামিরা। তারা পলাতক রয়েছেন।
প্রসঙ্গত, ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় মামলাটি দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলাটির তদন্তের পর ২০০৮ সালের ৫ মে খালেদা জিয়াসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন।
চার্জশিটের বৈধতা চ্যলেঞ্জ করে খালেদা জিয়া হাইকোর্টে রিট আবেদন করলে ২০০৮ সালের ৯ জুলাই হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের কার্যক্রম স্থগিত করে রুল জারি করেন। ২০১৫ সালের ১৮ জুন হাইকোর্ট রুল ডিসচার্জ করে স্থাগিতাদেশ প্রত্যাহার করেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র পরিত্যক্ত দেখিয়ে কানাডিয় কোম্পানি নাইকোর হাতে ‘তুলে দেওয়ার’ অভিযোগে রাষ্ট্রের প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার ক্ষতির অভিযোগে মামলাটি করা হয়।