ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘বাঁশি’ কবিতায় লিখেছিলেন- ‘হঠাৎ খবর পাই মনে, আকবর বাদশাহর সঙ্গে হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই।’ বাস্তবে হরিপদ নামে কোনো কেরানির সঙ্গে মোগল সম্রাট আকবরের কোনো সম্পর্ক ছিল কি না, জানা নেই।
তবে বর্তমান জমানায় এই রাজধানীতে এক কেরানির সন্ধান পাওয়া গেছে, যার সম্পদের হিসাব করতে গিয়ে খোদ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যমতে, তার সম্পদের অর্থমূল্য নাকি ১৫ হাজার কোটি টাকার মতো। সেদিক থেকে এই কেরানির সঙ্গে সেকালের রাজা-বাদশাহর তুলনা চলতেই পারে। তাকে বলা যেতে পারে ‘কেরানিরাজ’! কারণ যেভাবেই হোক তিনি যে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, তা বিস্ময়কর।
আবজাল হোসেন নামে এই ব্যক্তি চাকরি করতেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের চিকিৎসা শিক্ষা শাখার অ্যাকাউন্টেন্ট পদে। বেতন পেতেন সব মিলিয়ে ৩০ হাজার টাকার মতো। কিন্তু দেশ-বিদেশে তার সম্পদের পরিমাণ অঢেল।
রাজধানীর উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর সড়কেই রয়েছে তার চারটি পাঁচতলা বাড়ি ও একটি প্লট। এছাড়া রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আছে আরও অন্তত ২৪টি প্লট ও ফ্ল্যাট। মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর ও কানাডায় রয়েছে তার নানা ব্যবসা, হোটেল ও বাড়ি। তিনি চলাফেরা করেন বিলাসবহুল গাড়িতে। গাড়ির মডেল বদলান ঘন ঘন। হাতে দামি ঘড়ি, আঙুলে হীরার আংটি।
প্রশ্ন হল, একজন কেরানি কীভাবে এত বিপুল সম্পদের অধিকারী হলেন?
অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের সিনিয়রদের যোগসাজশে কেনাকাটার টেন্ডারের নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে। বদলি বাণিজ্যও করতেন। তার স্ত্রী রুবিনা খানম একই অধিদফতরের স্টেনোগ্রাফার ছিলেন। তার বিরুদ্ধেও হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।
তদন্তে জানা গেছে, আবজাল হোসেন ২০০৫ সালে ‘রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এ প্রতিষ্ঠানের ‘মালিক’ ছিলেন তার স্ত্রী।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের কয়েকজনের মদদে প্রতিষ্ঠানটি দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সরঞ্জাম কেনার নামে টাকা নিয়ে নিুমানের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে হাজার হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় করে। বস্তুত স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতিবাজরা কী পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন তার একটি খণ্ডচিত্র এটি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর ‘সেবা খাতে দুর্নীতি : জাতীয় খানা জরিপ ২০১৭’ শীর্ষক জরিপে সেবা খাতগুলোর মধ্যে যেসব খাত সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, স্বাস্থ্য খাত তার একটি। এ খাতে সেবা নিতে গিয়ে ৪২.৫ শতাংশ খানা অর্থাৎ পরিবার বা ছোট গোষ্ঠী কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির শিকার হয়েছে।
দুর্নীতি এখন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। একে নির্মূল করতে হবে কঠোর হাতে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। কাজেই সরকার এ ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ।
দুর্নীতি নির্মূলে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান, দফতর-অধিদফতরে কর্মরত আবজালের মতো দুর্নীতিবাজদের খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নেয়া এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। আবজালের বিষয়ে অনুসন্ধান এখনও চলছে। তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। তবে শুধু আবজালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াই যথেষ্ট নয়, যাদের সহায়তায় ও যোগসাজশে তিনি দুর্নীতি করেছেন, তাদেরও খুঁজে বের করে নিতে হবে ব্যবস্থা।