- ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ
- ***নির্বাচনের পরদিন বলেছিলেন- “কানাডার মতোই ভোটের পরিবেশ এখানে”
- ***এখন বলছেন- “আমার মনে হচ্ছে আমি খুব অর্বাচীনের মতো কাজ করে ফেলেছি”
- ***স্ববিরোধী বক্তব্য দিচ্ছে সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন।
৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের মধ্যে কানাডা থেকে আসা তানিয়া ফস্টার নামের সেই পর্যবেক্ষক এখন তার অনুশোচনা হওয়ার কথা জানিয়ে বলেছেন, এই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত না হলেই তিনি ভালো করতেন। সেই সঙ্গে আগের বক্তব্য থেকে সরে এসে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও এখন তিনি প্রশ্ন তুলছেন। তাকে উদ্ধৃত করে আজ মঙ্গলবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।
সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন নামের যে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থার ব্যবস্থাপনায় তানিয়া ফস্টার বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে এসেছিলেন সেই সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুস সালাম রয়টার্সকে বলেছেন, ভোটের আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরানো ও ভয়ভীতি দেখানোর কথা খোদ ভোটার ও প্রিজাইডিং কর্মকর্তাদের মুখ থেকে শোনার পর এখন তিনি বিশ্বাস করেন যে নতুন করে নির্বাচন হওয়া উচিত।
তিনি রয়টার্সকে আরও বলেন, “আমি এখন সবকিছু জানতে পেরেছি, এবং একথা বলতে পারি যে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি।”
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনসহ আরেকটি পর্যবেক্ষক সংস্থার কর্মকাণ্ড নিয়ে গত ৭ জানুয়ারি দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনে “দু’টি নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা সমাচার” শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে সংস্থার প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছিল। সেই সব তথ্যের সঙ্গে রয়টার্সের প্রতিবেদনে তানিয়া ফস্টার ও কাঠমান্ডুতে সার্কের মুখপাত্রের বক্তব্যও যুক্ত করা হয়েছে।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন কানাডা, ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা থেকে যাদের নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে বাংলাদেশে এনেছিল তারা ৩০ ডিসেম্বর ভোটের দিন ও এর পরদিন গণমাধ্যমের সামনে নির্বাচন নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন।
নির্বচনের ফল ঘোষিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারি বাসভবনে সাংবাদিক ও নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেছিলেন, “মানুষ খুব উৎসাহ নিয়ে ভোট দিয়েছেন, বিশেষ করে নারী ও তরুণ প্রজন্মের ভোটাররা।” তিনি আরও বলেছিলেন, “আপনারা আমার দেশে আসায় গণতন্ত্র এদেশে কিভাবে কাজ করছে সেটা দেখানোরও ভালো সুযোগ পেয়েছি আমরা।”
নির্বাচনে জয়লাভ করায় তখন উপস্থিত পর্যবেক্ষকরা শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য দেন। সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনসহ ওআইসি’র পর্যবেক্ষকরাও প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দিত করেন।
সেদিন পর্যবেক্ষকদের মধ্যে যিনি প্রথম বক্তব্য দিয়েছিলেন তিনি কানাডার তানিয়া ফস্টার। তিনি বলেছিলেন, “খুব সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন হয়েছে। …কানাডার মতোই ভোটের পরিবেশ এখানে।”
রয়টার্সের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী ছেলে যিনি তার তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা তিনিও সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনায় আসা পর্যবেক্ষকদের বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে একাধিক টুইট করেছিলেন।
রাজনৈতিক সংযোগঃ
দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) নাম ও একই আদলের লোগো ব্যবহার করলেও আট দেশের আঞ্চলিক এই জোটের সঙ্গে সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের কোনো সম্পর্ক নেই। এর ব্যাখ্যায় সংস্থাটির মহাসচিব আবেদ আলী রয়টার্সকে বলেন যে তারা সার্কের অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছেন। এবং আশা করছেন শিগগিরই সার্ক তাদের অনুমোদন দিবে। তবে কাঠমান্ডুতে সার্কের একজন মুখপাত্র রয়টার্সকে বলেন, “এই সংগঠনের ব্যাপারে তারা কিছুই জানেন না। মুখপাত্র বলেন, এই সংগঠন সার্ক স্বীকৃত নয়। তাদের সঙ্গে সার্কের কোনো সম্পর্ক নেই।”
সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে থাকা তথ্য অনুযায়ী তাদের কার্যক্রম ঢাকা কেন্দ্রিক। এর উপদেষ্টা কমিটিতে রয়েছেন আওয়ামী লীগ ও এর জোটসঙ্গী জাতীয় পার্টির এমপি। বিএনপি সরকারের আমলের একজন সাবেক মন্ত্রীর নামও রয়েছে এই তালিকায়।
বাংলাদেশের বর্তমান আইন অনুযায়ী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি রয়েছেন এমন কোনো সংস্থাকে নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে অনুমোদন দিতে পারে না নির্বাচন কমিশন। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, এই পর্যবেক্ষক সংস্থার সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতার কথা তারা জানতেন না।
আর আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির এমপিদের যুক্ত রাখার ব্যাপারে সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের মহাসচিব আবেদ আলীর ভাষ্য, “তারা শুধু আমাদের মানবিক কার্যক্রমে সহযোগিতা করছেন।” সেই সঙ্গে তার দাবি, দেশের কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
ডেইলি স্টারের কাছে তিনি রাজনৈতিক দলীয় উপদেষ্টাদের থেকে অর্থ প্রাপ্তির কথাও স্বীকার করেছিলেন।
স্ববিরোধী বক্তব্য হিউম্যান রাইট ফাউন্ডেশনেরঃ
সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আব্দুস সালাম রয়টার্সকে বলেন, তার সংস্থার ব্যবস্থাপনায় যে পর্যবেক্ষকরা এসেছিলেন তারা অল্প কয়েকটি ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করেছিলেন। তাই নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু হয়েছে সে ব্যাপারে তারা সুনির্দিষ্ট মূল্যায়ন করার মতো অবস্থায় নেই।
রয়টার্সকে এখন এই কথা বললেও গত ৩১ ডিসেম্বর রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন বলেছিল, “একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অতীতের চেয়ে অনেকাংশে ভালো, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে।”
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছিল, সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের ৫ হাজার ৭৬৫ জন সদস্য নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন। বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা তিনটি দলে ভাগ হয়ে রাজধানীর ২৪টি কেন্দ্র পরিদর্শন করেন।
আর সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট আব্দুস সালামের এখনকার বক্তব্য, কিছু প্রিজাইডিং কর্মকর্তা তাকে বলেছেন তাদেরকে ব্যালটে সিল মারে বাক্স ভরতে বাধ্য করা হয়েছিল। “আমি সত্য বলতে চাই। কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে আমি এ কথা বলছি না।”
তবে আব্দুস সালামের এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে ফাউন্ডেশনের মহাসচিব আবেদ আলী রয়টার্সকে বলেন, “কেউ কিছু বললেই তার ওপর ভিত্তি করে আপনি কিছু লিখতে পারেন না।”
দ্য ডেইলি স্টারের অনুসন্ধানে জানা যায়, এই আবেদ আলীই ইলেকশন মনিটরিং ফোরামের নির্বাহী পরিচালক। তবে খোঁজ করতে গিয়ে সংস্থাটির কার্যালয় ও ওয়েবসাইট পাওয়া যায়নি। তাদের কার্যক্রম সম্পর্কেও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
অথচ ৩১ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছিল, ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম দেশের ২১৪টি আসনের ১৭ হাজার ১৬৫টি কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করেছে।
এখন যা বলছেন তানিয়া ফস্টার
কানাডা থেকে বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আসার একটি প্রেক্ষপটের কথা রয়টার্সকে জানিয়েছেন তানিয়া ফস্টার। তিনি বলেন, সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন নামের একটি সংস্থা নির্বাচন পর্যবেক্ষক খুঁজছে এমন তথ্য তিনি প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকেই প্রথম শুনেছিলেন। তিনি বলেন, “এটা মজার একটা অভিজ্ঞতা হবে ভেবে নির্বাচন পর্যবেক্ষক হওয়ার যোগ্যতার ব্যাপারে আমি তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন ও নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন করার পর তারা আমাকে পর্যবেক্ষক হওয়ার আমন্ত্রণ জানায়।” তানিয়া ফস্টারের কন্যা ক্লোয়ি ফস্টারও পরে পর্যবেক্ষক প্যানালে যুক্ত হন যারা বিদেশে জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ব্যাপারে ছিলেন পুরোপুরি অনভিজ্ঞ।
তানিয়া ফস্টারের দাবি, যে সংস্থার ব্যবস্থাপনায় তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন তার সঙ্গে সার্কের সম্পর্ক না থাকা কিংবা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে তিনি কিছুই জানতেন না।
সবকিছু ঘটার পর এখন তার বক্তব্য, “ব্যাপারটি নিয়ে আমি সন্তুষ্ট নই। আমার মনে হচ্ছে আমি খুব অর্বাচীনের মতো কাজ করে ফেলেছি।”
রয়টার্সকে তিনি আরও বলেন, শুধুমাত্র ঢাকায় নয়টি নির্বাচন কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করেছিলাম আমরা। আমরা জানতামই না যে আমাদের প্রতিবেদন এতটা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হবে। অপেক্ষাকৃত গোলোযোগপূর্ণ এলাকাগুলো পরিদর্শনে যাইনি আমরা। নির্বাচন কমিশনসহ পোলিং এজেন্ট, প্রিজাইডিং কর্মকর্তাদের পূর্বের কর্মকাণ্ড আমরা নীরিক্ষণ করিনি।
তবে এ ব্যাপারে ক্লোয়ি ফস্টারের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নিয়ে নিজের অনভিজ্ঞতার কথা তানিয়া ফস্টার নিজে বললেও, সার্ক হিম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের মহাসচিবের দাবি, ওই নারীদের (তানিয়া ও ক্লোয়ি) দুজনেরই কানাডায় নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা ছিল। সেই সঙ্গে কোনো পর্যবেক্ষক সংস্থার পক্ষে সব কেন্দ্র পর্যবেক্ষণে যাওয়াও অসম্ভব।
সূত্রঃ ডেইলি স্টার অনলাইন।