ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ দুর্নীতিতে বাংলাদেশের চার ধাপ অবনতি ঘটেছে। অর্থাৎ দেশে দুর্নীতি বেড়েছে। বাংলাদেশকে বিশ্বের ১৩তম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে টিআইবি। আর দণি এশিয়ায় দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। ২০১৭ সালে ১৮০টি দেশের মধ্যে দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭তম। ২০১৮ সালের সূচকে চার ধাপ পিছিয়ে হয়েছে ১৩তম। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের এই চিত্র উঠে এসেছে।
রাজধানীর ধানমন্ডি টিআইবি কার্যালয়ে গতকাল মঙ্গলবার এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের এই অবস্থান প্রকাশ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ২০১৮ সালে ০-১০০ স্কেলে ২৬ স্কোর পেয়ে ১৮০টি দেশের মধ্যে তালিকার নি¤œক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম, যা ২০১৭ সালের তুলনায় ৪ ধাপ এবং ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী ১৪৯তম, যা ২০১৭ সালের তুলনায় ৬ ধাপ অবনতি। এ ছাড়া ২০১৭ সালের তুলনায় বাংলাদেশের স্কোর ২ পয়েন্ট কমেছে, যেটা আমাদের জন্য বিব্রতকর। এক বছরে দুই পয়েন্ট স্কোর কমে যাওয়া উদ্বেগজনক। শুধু তাই নয়, সূচকে অন্তর্ভুক্ত দণি এশিয়ার ৮টি দেশের মধ্যে এবারও বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় সর্বনি¤œ। আর এশিয়া প্যাসিফিকের ৩১টি দেশের মধ্যে অবস্থান চতুর্থ সর্বনি¤œ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, দণি এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ভুটান। ২০১৮ সালের সিপিআই অনুযায়ী এ দেশটির স্কোর ৬৮ এবং ঊর্ধক্রম অনুযায়ী অবস্থান ২৫। এর পরের অবস্থানে রয়েছে ভারত, স্কোর ৪১ এবং অবস্থান ৭৮। দণি এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এরপরে শ্রীলঙ্কা ৩৮ স্কোর পেয়ে ৮৯তম অবস্থানে রয়েছে। ৩৩ স্কোর পেয়ে ১১৭তম অবস্থানে উঠে এসেছে পাকিস্তান এবং ৩১ স্কোর পেয়ে ১২৪তম অবস্থানে নেমে গেছে মালদ্বীপ। অপরদিকে ৩১ স্কোর পেয়ে ১২৪তম অবস্থানে রয়েছে নেপালও। বাংলাদেশের পরে ১৬ স্কোর পেয়ে সিপিআই ২০১৮ সূচকে ১৭২তম অবস্থানে রয়েছে আফগানিস্তান।
সূচকে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে ডেনমার্কের অবস্থান প্রথম। আর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ আফ্রিকার সোমালিয়া। ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৮০তম স্থান পাওয়া এ দেশটির স্কোর ১০। সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে এরপরের অবস্থানগুলো পর্যায়ক্রমে সিরিয়া, দক্ষিণ সুদান, ইয়েমেন, উত্তর কোরিয়া, সুদান, আফগানিস্তান, লিবিয়া।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়ে যাওয়ার কারণ এখানে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও ঘোষণা থাকলেও দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধ কার্যক্রমের বাস্তবায়ন সেভাবে নেই। দুর্নীতিগ্রস্ত উচ্চপর্যায়ের লোকদের বিচারের আওতায় আনার উদাহরণ কম। ব্যাংক খাতে অবারিত দুর্নীতি, জালিয়াতি, ভূমি-নদী-জলাশয় দখল, সরকারি ক্রয় খাতে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের কারণে দুর্নীতি এক ধরনের ছাড় পেয়ে যাচ্ছে।
২০১৭ সালের তুলনায় দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নি¤œমুখী হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, দুর্নীতি দমন কমিশন নি¤œ এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে যেসব দুর্নীতি হয় সেসব েেত্র অভিযান চালায়। কিন্তু উচ্চ শ্রেণীর মধ্যে অভিযান চালাতে তাদের দেখা যায় না। ফলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, দুদকের দুর্নীতি দমন নি¤œ ও মধ্যপর্যায়ে সীমাবদ্ধ উচ্চপর্যায়ে নেই। প্রধানমন্ত্রীর ‘জিরো টলারেন্সের’ যে ঘোষণা আছে সেটা কার্যকর করার জন্য পদ্ধতি নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় দুর্নীতিবিরোধী কৌশল প্রণয়ন করা দরকার। সংসদকে জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা দরকার। আসামিদের পরিচয় ও রাজনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে বিচারের আওতায় আনতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান এবং আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মন্জুর-ই-আলম।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০১৮ সালের সিপিআই অনুযায়ী ৮৮ স্কোর পেয়ে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে ডেনমার্ক। ৮৭ স্কোর পেয়ে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে নিউজিল্যান্ড এবং ৮৫ স্কোর নিয়ে যৌথভাবে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ফিনল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সুইডেন ও সুইজারল্যান্ড। ১৩ স্কোর নিয়ে তালিকার সর্বনি¤েœর দ্বিতীয় স্থানে যৌথভাবে রয়েছে সিরিয়া ও দণি সুদান এবং ১৪ স্কোর পেয়ে তালিকার সর্বনি¤েœর তৃতীয় দেশ হিসেবে রয়েছে ইয়েমেন ও উত্তর কোরিয়া।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ২০০১ থেকে ২০০৫ সালের মাতা আমরা সর্বনি¤œ অবস্থানে না থাকলেও আমাদের আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। আমাদের অবস্থান এখনো অত্যন্ত দুর্বল এবং বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় অত্যন্ত নিচে। অথচ বাংলাদেশের অবস্থান আরো অনেক ভালো হতে পারত এবং সে অবস্থা বা যোগ্যতাও বাংলাদেশের আছে। যেসব কারণে আমাদের অবস্থান আরো ভালো হয়নি বলে মনে করি, তার অন্যতম হচ্ছে, আমাদের দুর্নীতিবিরোধী অঙ্গীকার বা রাজনৈতিক ঘোষণা থাকলেও তার বাস্তব প্রয়োগ হয় না। বিশেষ করে উচ্চপর্যায়ে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে খুব কম েেত্রই তাদের বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। আমাদের প্রশাসন ও রাজনীতিতে স্বার্থের দ্বন্দ্ব ব্যাপকভাবে বিদ্যমান। এছাড়া আমাদের ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক খাতে দুর্নীতির যে বিচারহীনতা, সারা দেশে ভূমি, নদী, জলাশয় দখলের যে প্রবণতা, রাষ্ট্রীয় ক্রয় খাতে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, ক্রমবর্ধমান এবং বিব্রতকরভাবে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অর্থ পাচার এবং রাষ্ট্রীয় নিয়োগের েেত্র রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক যে প্রভাব সেগুলোও আমাদের ভালো স্কোর না হওয়ার েেত্র প্রভাব রাখতে পারে।
পৃথিবীর কোনো দেশেই শীর্ষপর্যায়ের রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও তার প্রয়োগ ছাড়া দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ হয় না মন্তব্য করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অতি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার যে ঘোষণা দিয়েছেন এটি তার রাজনৈতিক সদিচ্ছারই বহিঃপ্রকাশ। তবে এই ঘোষণার কার্যকর ব্যবহার, প্রয়োগ এবং কারো প্রতি ভয় বা করুণা প্রদর্শন না করে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনদের সম্পৃক্ত করে একটি জাতীয় দুর্নীতিবিরোধী কৌশল প্রণয়ন অপরিহার্য। বহুমুখী ও সময়াবদ্ধ এমন একটি কৌশল স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ায় সুষ্ঠুভাবে পরিবীণসহ বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশ অবশ্যই এ সূচকে ভালো ফল করবে।
সংবাদ সম্মেলনে বৈশ্বিক দুর্নীতি পরিস্থিতির তথ্য তুলে ধরে জানানো হয়, ২০১৮ সালের সিপিআই অনুযায়ী পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক। সূচকে অন্তর্ভুক্ত ১৮০টি দেশের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের অধিক দেশই ৫০ থেকে কম স্কোর পেয়েছে। সিপিআই সূচক অনুয়ায়ী ২০১২ সাল থেকে দণি এশীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ষষ্ঠবারের মতো এবারো দ্বিতীয় সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে। ২০০৯, ২০১১, ২০১২ ও ২০১৫ সালের সিপিআইয়েও নিম্নক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশ ১৩তম অবস্থানে ছিল।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সিপিআই সম্পর্কে যথাযথ ধারণার অভাবে অনেক সময় বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত বা বাংলাদেশের অধিবাসীরা সবাই দুর্নীতি করে এ ধরনের ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়। যদিও দুর্নীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য দূরীকরণ সর্বোপরি, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের পথে কঠিনতম অন্তরায়, তথাপি বাস্তবে দেশের সাধারণ জনগণ দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। তারা দুর্নীতির কারণে তিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগী মাত্র। মতাবানদের দুর্নীতি এবং তা প্রতিরোধে দেশের নেতৃত্ব ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতার কারণে দেশ বা জনগণকে কোনোভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত বলা যাবে না।
ডিজিটাল আইন ঢেলে সাজানোর দাবি : দুর্নীতি প্রতিরোধে সংবাদমাধ্যমের কার্যকর ভূমিকার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ঢেলে সাজানোর দাবি জানিয়েছেন ড. ইফতেখারুজ্জামান। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, সংবাদমাধ্যমসহ সাধারণ মানুষ যাতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারেন, সেই পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। সাম্প্রতিক ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টসহ বিভিন্ন আইনিপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাকস্বাধীনতা, প্রতিবেদনের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। তিনি বলেন, এক দিকে সরকার এগুলো খর্ব করছে। অন্য দিকে সহনশীলতার ঘোষণা দিচ্ছে। দুটি কিন্তু পরস্পর সাংঘর্ষিক। এজন্য আমরা দাবি করছি, একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশনেই ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। এটি করতে পারলে বাংলাদেশে যে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম, সেটি আরো ভালো হবে। দুর্নীতি শূন্য ঘোষণা কার্যক্রম আরো কার্যকর হবে।
সংবাদ সম্মেলনে দুর্নীতি প্রতিরোধে টিআইবি কিছু প্রস্তাবনাও তুলে ধরে। এগুলো হলোÑ দুর্নীতি দমনে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও এক্সপার্টদের নিয়ে অংশীজনদের সমন্বয়ে জাতীয় কৌশল প্রণয়ন করা। দুর্নীতি করলে যে শাস্তি পেতে হয়, সেটি নিশ্চিত করা। কার্যকর প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সংসদ, দুদক, বিচারিক ব্যবস্থা, অ্যাটর্নি জেলারেলের অফিস, এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট অফিসগুলোর সক্রিয় ভূমিকা প্রশাসন বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় পেশাগত উৎকর্ষ, শুদ্ধাচার এবং নিরপেতা নিশ্চিত করা। তথ্য অধিকার আইন ব্যাপকভাবে বাস্তবায়ন করা। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট সংশোধন এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্রেফতারসংক্রান্ত আইন সংশোধন করা।