ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ক্রমেই অবনতি ঘটছে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির। খুন, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই কোনোটিই এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। একের পর এক নৃশংস ঘটনায় সর্বমহলে আতঙ্ক বিরাজ করছে। উপরন্তু ধর্ষণের পর শিশু হত্যার ঘটনায় অভিভাবক মাত্রই হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন। এ দিকে ধর্ষণকারীর লাশ উদ্ধারের বিষয়টি নিয়ে মানুষের মধ্যে রহস্য ছড়িয়ে পড়েছে। কোথায় কি হচ্ছে; তা নিয়ে মানুষের মধ্যে আলোচনার যেন শেষ নেই। কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাঠপর্যায়ের সদস্যদের দায়িত্ব অবহেলার কারণেই একের পর এক এমন ঘটনা ঘটছে। ঢাকায় মাত্র ১৬ টাকার জন্য অপহরণ করে হত্যা করা হয়েছে একটি শিশুকে। লোমহর্ষক এই ঘটনা বিস্মিত করেছে খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও।
রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকায় বাস ডাকাতির কথা ইদানীং শোনা যায়নি। গত সোমবার রাতে সেই ঘটনাও ঘটেছে। রাত ৯টায় মাসফি ক্ল্যাসিক নামে একটি বাস গাবতলী থেকে কুড়িগ্রামের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে যায়। রাত ১১টায় চন্দ্রা এলাকায় বাসটি ডাকাতের কবলে পড়ে। দুর্বৃত্তরা অস্ত্রের মুখে বাসযাত্রীদের মারধর করে সর্বস্ব কেড়ে নেয়। এ ঘটনায় বাসের চালক হেলপার জড়িত বলে সন্দেহ করছেন যাত্রীরা।
ঢাকার ধামরাইয়ে মুক্তিপণের ১০ লাখ টাকা না পেয়ে মনির হোসেন নামে পাঁচ বছর বয়সী এক শিশুকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। গত শনিবার ওই শিশুটিকে অপহরণ করা হয়। গতকাল শিশুটির বাড়ির পাশের একটি স্থান থেকে মাটি চাপা দেয়া অবস্থায় লাশটি উদ্ধার করা হয়। এর আগের দিন গত সোমবার ফেনীর পাঠানবাড়ি এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় আরাফাত নামে এক স্কুলছাত্রের লাশ। আগের রাতে দুর্বৃত্তরা তাকে অপহরণ করে লাশটি মাটির নিচে পুঁতে রাখে। আরাফাত ফেনী পুলিশ লাইনস স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র ছিল।
গাজীপুরের শরিফপুর সোন্ডা এলাকায় গত রোববারও এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। শিশুটির বয়স পাঁচ বছর বলে জানা যায়।
গত সোমবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে দেখা যায় এক গৃহবধূ কাঁদছেন মেয়ের ঘাতকদের বিচার চেয়ে। রাজিয়া সুলতানা নামে ওই গৃহিণী অভিযোগ করেন, গত ৫ জানুয়ারি রাজধানীর গেণ্ডারিয়ার দীননাথ সেন রোডের এক বস্তিতে তার শিশুকন্যা আয়েশা মনিকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। প্রতিবেশী নাহিদ শিশুটিকে ধর্ষণের পর হত্যা করে। রাজিয়া বলেন, নাহিদ এলাকায় খুবই প্রভাবশালী। তার লোকজন এখন তাকে ও তার পরিবারকে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে।
এ দিকে খুনের ঘটনা ঘটেই চলছে। গত দুই দিনে রাজধানীসহ সারা দেশে অন্তত ১০ জন খুন হয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিবদমান সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো বেপরোয়া অবস্থানে। প্রতিপক্ষ গ্রুপগুলোর মধ্যে প্রায়ই ঘটছে খুনোখুনির ঘটনা। গতকালও রাঙ্গামাটির লংগদুতে ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুমের কর্মী পবিত্র চাকমাকে প্রতিপক্ষরা গুলি করে হত্যা করে। ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের সংগঠক মাইকেল চাকমা অভিযোগ করেছেন জেএসএস এমএন লারমা গ্রুপের সদস্যরা পবিত্র চাকমাকে হত্যা করেছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, পাহাড়ে বিবদমান চারটি সশস্ত্র গ্রুপের কাছে বিপুল অবৈধ অস্ত্র মজুদ রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেফতার অভিযান চলা সত্ত্বেও হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড কমছে না।
দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না সাংবাদিকরাও। বিভিন্ন স্থানে প্রায়ই সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ করছে দুর্বৃত্তরা। গতকালও রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে দুর্নীতির খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে আক্রমণের শিকার হয়েছেন আরটিভির দুই সাংবাদিক। তাদের ক্যামেরা ভাঙচুর করা হয়েছে এবং তাদের মারধর করা হয়েছে।
এ দিকে ক্ষমতাসীনদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে প্রায়ই বিভিন্ন স্থানে সহিংস ঘটনা ঘটছে, যা আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। গতকালও চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে উপজেলা আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের বিবদমান দুই গ্রুপের সংঘর্ষে অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ কমপেক্ষ দেড় শ’ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করেছে বলে জানা গেছে।
গতকাল সকালে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার ভাটই দক্ষিণপাড়া গ্রামে আওয়ামী লীগের বিবদমান দুই গ্রুপের সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন।
এ দিকে ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে এমন ব্যক্তিদের লাশ মিলছে বিভিন্ন স্থানে। গত ১৭ জানুয়ারি সাভারে একটি পোশাক কারখানার এক নারী শ্রমিকের ধর্ষণের আসামি রিপনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। তার সাথে পাওয়া যায় একটি চিরকুট। যাতে লেখা ছিল, ‘আমি ধর্ষণের মূল হোতা’। গত ২৬ জানুয়ারি ঝালকাঠীর কাঁঠালিয়া উপজেলার শৌলজালিয়ার বলতলা গ্রামে সজল নামে এক যুবকের লাশ পাওয়া যায়। সজল ভাণ্ডারিয়া উপজেলার একটি ধর্ষণ মামলার আসামি ছিল। তার গলায় ঝুলানো একটি চিরকুটেও লেখা ছিল, ‘আমি ধর্ষক, ইহাই আমার পরিণতি।’ এ দিকে আসামির গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়ার পরে ধর্ষিতার পরিবার এখন বিপাকে পড়েছে। উল্টো তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামে এক মাদরাসাছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় সন্দেহভাজন শাহাবুদ্দিন পুলিশের সাথে সোমবার গভীর রাতে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়।
এ দিকে আইনশৃঙ্খলার এই ক্রম অবনতির বিষয়ে কেউ কেউ বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বে শৈথিল্যের কারণেই খুন-ধর্ষণসহ নানা অপরাধ বেড়ে চলছে। চন্দ্রার যে স্থানে বাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে সেখানে আগেও বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। ওই এলাকায় সার্বক্ষণিক পুলিশ ডিউটি থাকার কথা থাকলেও ঘটনার সময় আশপাশে কোনো পুলিশের টহল দল দেখতে পাননি বলে মনির নামে ওই বাসের এক যাত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
তবে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। যেসব ঘটনা ঘটছে তার সাথে জড়িতরা গ্রেফতারও হচ্ছে।
প্রতিটি ঘটনার তদন্ত হচ্ছে। দোষীদের ছাড় দেয়া হচ্ছে না।