ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বাংলাদেশের নির্বাচনী ঝড়ে ওড়া ধুলো প্রায় থিতিয়ে এসেছে। ধীরে ধীরে তুলনামূলক ভাবে শান্ত হয়ে আসছে রাজনৈতিক দৃশ্যপট। এ সময়ই এসেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর অস্বস্তিকর রিপোর্টটি যা ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ‘মারত্মক অনিয়ম’ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা প্রকাশ করেছে।
টিআইবি ৫০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ৪৭টিতে পরিচালিত সমীক্ষায় অনিয়মের যে তালিকা দিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে নির্বাচনের দিনের আগের ঘন্টাগুলোতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখা, জাল ভোট ও ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসতে বাধাপ্রদান।
টিআইবি বলেছে, এসব অনিয়ম যখন ঘটে তখন ঘটনাস্থলে থাকা নিরাপত্তা বাহিনী নীরবে দাঁড়িয়েছিল।
টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ১৫ জানুয়ারি এক বিবৃতিতে বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের একটি অংশ ও নির্বাচন কর্তৃপক্ষকে নির্বাচনে পক্ষপাতিত্বমূলক ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ টিআইবি’র রিপোর্টকে মনগড়া ও কল্পকাহিনী বলে বাতিল করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, রিপোর্টটি বিএনপি ও তাদের মিত্র জামায়াতে ইসলামের প্রচার করা কথারই সমর্থন। নির্বাচন কমিশনও টিআইবির রিপোর্টকে প্রত্যাখ্যান করেছে। নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, এটি পূর্বনির্ধারিত ও মনগড়া।
একটি নতুন রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের কর্মীরা নির্বাচনের আগের দিন রাতে ব্যালট বাক্সগুলো ভরে ফেলে এবং ভোটারদের ভীতি প্রদর্শন করে। সে সময় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা দাঁড়িয়ে ছিলেন।
পরপর দু মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যাপক সাফল্য লাভের রেকর্ড রয়েছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৫০ শতাংশ, অন্যদিকে চরম দারিদ্র্যসীমার মধ্যে বসবাসকারীদের সংখ্যা ১৯ শতাংশ থেকে কমে ৯ শতাংশে এসেছে। ১৪ জানুয়ারি নিউইয়র্ক টাইমস এক সম্পাদকীয়তে লিখেছে যে, সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হল কর্তত্বপরায়ণতার দিকে অগ্রসরমানতা তার অর্জনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
এতে বলা হয়, শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী পদ্ধতি ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ তার প্রতিটি অর্জনকেই এখন কলঙ্কিত করবে। তার সমালোচক, যাদের নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে বা যারা আন্ডারগ্রাউন্ডে রয়েছেন তারা আরো বেশি কঠোর হয়ে উঠবেন এবং তার বিদেশী সমর্থক যারা আছেন তারা আরো সতর্ক হবেন।
২২ জানুয়ারি রয়টার্স প্রকাশিত বাংলাদেশের নির্বাচন বিষয়ে এক রিপোর্টে নতুন করে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। রিপোর্টে নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী একটি পর্যবেক্ষক গ্রুপের শীর্ষ কর্মকর্তা এবং গ্রুপের এক বিদেশী স্বেচ্ছাসেবীর বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয় যারা নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে অংশ নেয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তারা উভয়েই ভোটের বিশ্বাসযোগ্যতার ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেন।
সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আবদুস সালামকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, তিনি বলেছেন যে, নির্বাচনের আগের রাতে আওয়ামী লীগের কর্মীরা ব্যালটবাক্স ভরে রেখেছেন এবং ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছেন, ভোটকেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার ও ভোটারদের কাছ থেকে নির্বাচনের এমন বিবরণ শোনার পর তার কাছে এখন মনে হচ্ছে, নতুন করে নির্বাচন হওয়ার দরকার।
‘ফলস স্টোরি’
ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আসা কানাডার পর্যবেক্ষক তানিয়া ফস্টারও বলেন, তার কাছে এখন মনে হচ্ছে যে, নির্বাচন পর্যবেক্ষণে অংশ না নিলেই হয়ত ভালো হত।
ফাউন্ডেশনের পরের এক বিবৃতিতে রয়টার্সের রিপোর্টের নিন্দা করা হয়েছে। ফাউন্ডেশন বলেছে, জনাব সালাম সাক্ষাতকারে যা বলেছেন তা বার্তা সংস্থা বিকৃত করেছে। ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে মোহাম্মদ আবদুস সালাম বলেন, এই মিথ্যা রিপোর্টে আমার সম্মানহানি হয়েছে ও বিব্রত হয়েছি। রয়টার্স পরে বলেছে, নির্বাচন মনিটরকারীদের প্রকাশিত মন্তব্যের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে।
এসব রিপোর্টের ভিত্তিতে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক শত্রুরা বাগাড়ম্বরমুখর হয়ে উঠেছেন। বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভি ১৭ জানুয়ারি এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, টিআইবি রিপোর্টকে সরকার ও নির্বাচন কমিশন এক প্রচন্ড ধাক্কা বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, টিআইবি রিপোর্ট তাদের জন্য এক বড় রকমের ধাক্কা। টিআইবি তাদের ভোট জালিয়াতির বিষয় প্রকাশ করে দেয়ায় মন্ত্রীরা ও ইসি তাদের মুখ লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে নির্বাচনের সমালোচনা বিলীন হবে, তবে বিজয়ী শিবিরের উল্লাসে তা এক বিরাট বৈপরীত্য হয়েই এসেছে। একইভাবে তা ক্ষমতাসীন দলের বন্ধুদের শঙ্কিত করেছে। তারাও অপ্রীতিকর প্রশ্নের সম্মুখীন।
*প্রতিবেদক অরুণ দেবনাথ ঢাকাভিত্তিক সাংবাদিক। তার রিপোর্টটি ২৬ জানুয়ারি‘ দি হিন্দু’তে প্রকাশিত হয়।
এই খবরটি লিংকঃhttps://www.thehindu.com/news/international/bangladesh-election-under-new-scrutiny/article26100569.ece