ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বাংলাদেশে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন সবমহলে নতুন এক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ক্ষমতাসীন শিবির একরকমের উল্লাসে মেতে উঠলেও পুরো বিষয়টিই প্রশ্নবিদ্ধ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এবং রয়টার্সে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ভোটে চরম অনিয়ম আর কারচুপির বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ভারতীয় পত্রিকা দি হিন্দুর প্রতিবেদনে এ মন্তব্য উঠে এসেছে।
"বাংলাদেশ ইলেকশন আন্ডার নিউ স্ক্রুটিনি" শিরোনামের এই প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচনী উত্তাপের যে ঝড়টা বাংলাদেশে বইছিলো তা কিছুটা থিতু হয়ে এসেছে। তুলনামূলকভাবে শান্ত হয়ে উঠেছে দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনের দৃশ্যপটও। ঠিক তখনি ৩০ ডিসেম্বরের ভোট নিয়ে যেন বোম ফাটালো ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটির প্রতিবেদনে জানানো হলো ভোটে "মারাত্মক আকারের অনিয়ম" ঘটেছে।"
এতে বলা হয়, ৫০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ৪৭টিতে জরিপ চালিয়েছে টিআইবি। আর তাতে দেখা গেছে নির্বাচন শুরুর পূর্ব মুহূর্তে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয়েছে, জাল ভোট দেয়া হয়েছে ও ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশে বাধা দেয়া হয়েছে।
নির্বাচন যখন এসব অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে ঠিক তখনি ঘটনাস্থলে অবস্থান নেয়া আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ১৫ জানুয়ারিতে দেয়া এক বিবৃতিতে বলেন, "আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের একটি অংশ ও নির্বাচন কর্তৃপক্ষ সংসদ নির্বাচনে পক্ষপাতমূলক ভূমিকা পালন করেছে।"
কোনো প্রমাণ ছাড়াই টিআইবির এই প্রতিবেদনকে "ভিত্তিহীন" বলে মন্তব্য করেছে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন। সরকারের তরফ থেকে একই সুরে প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে।
এক নতুন রিপোর্টে বলা হয়েছে, "প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা নির্বাচনের আগের দিন রাতেই ব্যালট বাক্সগুলো ভর্তি করে ফেলে। এছাড়া নির্বাচনের দিন ভোটের লাইনে দাঁড়ানো ভোটারদের তারা ভয় দেখিয়ে বাধা দিয়েছে। অথচ সে সময় পাশেই দাঁড়ানো ছিলো নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা।"
১৪ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী গণমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস এক সম্পাদকীয়তে লিখেছে, "সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হল স্বৈরশাসনের দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণেই শেখ হাসিনার অর্জন বলতে যা রয়েছে তা ম্লান হয়ে যাচ্ছে।"
এতে বলা হয়, স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ আর নিপীড়নমূলক শাসন ব্যবস্থা গ্রহণ করার কারণে শেখ হাসিনার প্রতিটি অর্জনই কলঙ্কিত হবে। তার সমালোচক, যাদের নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে বা যারা আন্ডারগ্রাউন্ডে রয়েছে তারা আগের চেয়ে আরো বেশি প্রতিবাদী হয়ে উঠবেন। তার বিদেশী সমর্থকরা তখন সতর্ক হেঁটে চলার নীতি গ্রহন করবেন।"
নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয় প্রকাশের পর ২২ জানুয়ারি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী গণমাধ্যম রয়টার্স। এ প্রতিবেদনে বাংলাদেশে নির্বাচনে অনিয়ম আর কারচুপির বিষয় নিয়ে যে তথ্য প্রকাশ করেছে তা পুরো নির্বাচন নিয়ে নতুন এক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করা কথিত সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা এবং বিদেশী স্বেচ্ছাসেবীর বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলা হয়, "নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে অংশ নিয়ে তারা অনুতপ্ত।" ভোটের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে দু'জনই সন্দেহ প্রকাশ করেন।
সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আবদুস সালাম রয়টার্সকে বলেন, "ভোটকেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার ও ভোটারদের কাছ থেকে জেনেছি- নির্বাচনের আগের রাতে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা ব্যালটবাক্স ভরে রেখেছে। ভোটের সময় ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছে।এখন আমি চাই আরেকটি নতুন নির্বাচন হোক।"
কথিত এই সংস্থাটির আমন্ত্রণে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে অংশ নেওয়া কানাডার পর্যবেক্ষক তানিয়া ফস্টার বলেন, তার কাছে এখন মনে হচ্ছে যে, নির্বাচন পর্যবেক্ষণে অংশ না নিলেই ভালো হত।
রয়টার্সের কাছে কারচুপি আর অনিয়মের কথা স্বীকার করলেও এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর আবার ভোল পাল্টে নেয় কথিত এই মানবাধিকার ফাউন্ডেশনটি। বক্তব্য অস্বীকার করে তারা একটি বিবৃতি পাঠায়।
তবে রয়টার্স তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে জানিয়েছে, "নির্বাচন নিয়ে পর্যবেক্ষকরা প্রতিবেদনে যা বলেছেন এ ব্যাপারে আমাদের অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে।"
নির্বাচন নিয়ে এসব প্রতিবেদন প্রকাশের পর শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা আরো সোচ্চার হয়ে উঠেছেন।
বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভি ১৭ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, "টিআইবি প্রতিবেদনে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের আঁতে ঘা লেগেছে।"
তিনি বলেন, "টিআইবি রিপোর্ট তাদের জন্য বড় রকমের ধাক্কা। ভোট জালিয়াতির গোমর ফাঁস করে দেয়ায় মন্ত্রীরা ও নির্বাচন কমিশন তাদের মুখ লুকানোর জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন না।"
বাংলাদেশের ৩০ ডিসেম্বরের ভোট বড় একটা প্রশ্নের তৈরি করেছে মন্তব্য করে প্রতিবেদনে বলা হয়, "দিন যতো যাবো সমালোচনার বিষয়টা হয়তো গা সওয়া হয়ে যাবে কিন্তু ক্ষমতাসীন শিবিরে যে বিজয় উল্লাস সেটা নিয়ে বড় আকারের একটা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। বিষয়টি একইভাবে বেকায়দায় ফেলেছে ক্ষমতাসীন দলের বন্ধুদেরকেও, অপ্রীতিকর প্রশ্নের দায় তারাও যে এড়াতে পারবেন না।"