ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার গুলশানের বাসভবন ‘ফিরোজা’কে সাবজেল ঘোষণা দিয়ে সেখানে তাঁকে বন্দি হিসেবে রাখার সুযোগ আছে কিনা, এ নিয়ে দলের ভেতরে আলোচনা শুরু হয়েছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়া একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। সেই বিবেচনায় জামিন না হওয়া পর্যন্ত তার গুলশানের বাসভবনটিকেই সাবজেল ঘোষণা করে তাকে সেখানে রাখতে পারে সরকার। এক্ষেত্রে আইনি কোনও বাধা নেই।
জানতে চাইলে অবৈধ হাসিনা সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘সাবজেল করার বিষয়টি আইনগত দেখবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে আমি বলতে পারি, আমরা এ ধরনের কোনও চিন্তা এখন করছি না। এরকম চিন্তাভাবনা করার কোনও সিদ্ধান্ত আমাদের হয়নি।’
পরে অবৈধ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে এ বিষয়ে জানতে চেয়ে ফোন করা হলেও ব্যস্ততার কারণে কথা বলেননি তিনি। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আইন সবার জন্য সমান। খালেদা জিয়াও আইনের বাইরে নয়। সুতরাং আইন অনুযায়ী সব ব্যবস্থা হবে।’
২০০৭ সালে ডিআইজি (প্রিজন্স) হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন শামসুল হায়দার সিদ্দিকী। মঙ্গলবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) রাতে তিনি বলেন, ‘আমার জানামতে, সরকার চাইলে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে যেকোনও জায়গায় সাবজেল করতে পারে। খালেদা জিয়ার বাসভবনকে যদি সাবজেল করা হয়, সেক্ষেত্রে সেই বাড়িটিতে এখন যারা আছেন, তাদের কী হবে। তাদের কিন্তু আর সেখানে থাকার সুযোগ নেই। এ কারণে প্রজ্ঞাপন করার আগে বাড়িতে কারা থাকছেন, সেই বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে।’
কারা অধিদফতরের ঢাকা বিভাগের ডিআইজি (প্রিজন্স) টিপু সুলতান বলেন, ‘বিষয়টি হেডকোয়ার্টার দেখভাল করছে, আমি কিছু বলতে পারবো না।’
এ বিষয়ে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক (প্রিজন্স) কর্নেল মো. ইকবাল হাসান বলেন, ‘আমরা আসলে বলার ব্যক্তি না। কোর্ট থেকে যে রায় হবে, আমরা সেটা ফলো করবো।’
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই সুধাসদনের বাসা থেকে পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার হন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন তাকে রাখা হয় সংসদ ভবন এলাকায় স্থাপিত অস্থায়ী কারাগারে। তিনি মুক্তিপান ২০০৮ সালের ১১ জুন। ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ভোরে খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের মইনুল রোডের বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়। সেখান থেকে তাকে সোজা নিয়ে যাওয়া হয় সিএমএম আদালতে। আদালতে জামিন না-মঞ্জুর হলে তাকে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় স্থাপিত সাবজেলে রাখা হয়। ওই কারাগারে ৩৭২ দিন কাটানোর পর ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি মুক্তি পান। কারাবন্দি থাকাকালেই তার মায়ের মৃত্যু হয়।
ওই সময়ে ডিআইজি (প্রিজন্স) ছিলেন শামসুল হায়দার সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘‘ওই সময় সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এরপর গেজেট নোটিফিকেশন হয়। আমাদের কথা হলো, এক্ষেত্রে যিনি বাড়ির মালিক, তিনি মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হন। তবে সেক্ষেত্রে ‘কোর্টের আদেশ লাগবে’— এমন কোনও বিষয় আমরা কিন্তু শুনিনি।’’
বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের দাবি, খালেদা জিয়ার জামিন হওয়া না হওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত অর্থে ‘রাজনৈতিক’। নিম্ন আদালত এবং উচ্চ আদালতে বিএনপি চেয়ারপারসনের মামলা বিচারাধীন থাকলেও সরকার হস্তক্ষেপ বন্ধ করলে তার জামিন হওয়াটাই স্বাভাবিক। নেতাদের অভিযোগ—যেহেতু খালেদা জিয়ার জামিন হচ্ছে না, তাই শারীরিক অসুস্থতার কারণে বাসভবনে থাকাটাই তার জন্য নিরাপদ এবং রাজনৈতিকভাবেও নেতাকর্মীদের মানসিক অবস্থা প্রশমিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানান, আগামী শুক্রবার (১ মার্চ) স্থায়ী কমিটির সদস্যদের বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ওই বৈঠকে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বলেন, ‘সরকার তো বেগম জিয়ার জামিনই আটকে রেখেছে। আমরা অনেক আগে থেকেই এমন চিন্তা করছি, ম্যাডামকে সাবজেলে রাখা যায় কিনা। আলোচনা হচ্ছে। এই আলোচনা হতে পারে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের বৈঠকেও। তবে আমরা এ বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিইনি।’
বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘আমরা ম্যাডামের জামিন চাই। যে পর্যন্ত তার জামিন না হবে, ততদিন তার বাসভবন ফিরোজা’কে সাবজেল করে সেখানে তাকে রাখা যেতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, তার শরীরের যে অবস্থা, ক্রমশ দুর্বল হচ্ছেন, সেক্ষেত্রে তিনি একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তি, সেই জায়গা থেকে তাকে সাবজেলে নেওয়া যেতে পারে।’
মাহবুব উদ্দিন খোকনের দাবি, ‘কোর্টে তো সরকারের প্রভাব সম্পর্কে সবাই অবগত। কোর্টে প্রভাব বিস্তার বন্ধ করতে হবে। প্রভাব না ফেললে তো ম্যাডামের জামিন নিয়ে প্রশ্নই উঠতো না, তিনি জামিন লাভ করতেন। কিন্তু এই যে অ্যাটর্নি জেনারেল, তার তো জনগণের হয়ে কাজ করার কথা। কিন্তু তিনি তো তা করছেন না। সরকারের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে, তাহলে খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে কোনও সমস্যা হবে না।’
বিএনপি প্রধানের স্বাস্থ্যের বিষয়টি দলের পক্ষ থেকেও জোরালোভাবে জানানো হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘সরকার অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে এক বছরের বেশি সময় পরিত্যক্ত কারাগারে খালেদা জিয়াকে আটকে রেখেছে। চিকিৎসার অভাবে তার কিছু হলে এই সরকারকে সব দায়-দায়িত্ব নিতে হবে। কারাগারে যাওয়ার সময় খালেদা জিয়া পায়ে হেঁটে এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে এসেও হেঁটেছেন। আর এখন তিনি কারও সাহায্য ছাড়া দাঁড়াতেও পারেন না। এছাড়া, তার ডায়বেটিসসহ অন্য রোগগুলো বেড়েছে।’
গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে (বুধবার) চকবাজারে ভয়াবহ আগুনের পর বিএনপির তরফে অভিযোগ তোলা হয়—পুরান ঢাকার যে কারাগারে খালেদা জিয়াকে আটক রাখা হয়েছে, ওই ভবনের অবস্থা ভালো নয়। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তাকে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখার পর থেকে বিএনপির অভিযোগ ছিল, পুরান ঢাকার ওই ভবনটি স্যাঁতসেঁতে, নোংরা। বরাবরই সরকারের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে অভিযোগ করেন, ‘দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে কেন এ ধরনের শ্বাসরোধী পরিবেশে আটকে রেখেছেন? কেন তার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন? আপনাকে এরকম বিস্ফোরোন্মুখ বারুদের মাঝে বন্দি রাখা হলে কেমন লাগতো? কেন আপনি ৭৩ বছর বয়সী গুরুতর অসুস্থ ও তিনবারের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বন্দি করে রেখেছেন?’
মঙ্গলবার বিকালে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এজেএডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমরা প্রথমত খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি এবং তার সুচিকিৎসা চাই। কিন্তু কারাগারে তার সুচিকিৎসা হচ্ছে না। গত বছরের ৯ নভেম্বর থেকে তার কোনও পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হয় না। এখন প্রথমত আমরা তার মুক্তি চাই। দ্বিতীয়ত, জেলে যেহেতু তার সুচিকিৎসা হচ্ছে না (তার জন্য গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডও গত ২৪ ফেব্রুয়ারি এ কথা বলেছে), তাই অন্য কোথাও রেখে তার চিকিৎসা করানো যায় কিনা সেটাও সরকার ভেবে দেখতে পারে।’
খালেদা জিয়াকে সাবজেলে রেখে চিকিৎসা করানোর পক্ষে বিএনপির আইনজীবীরা আইনি কোনও বাধা না দেখলেও দুর্নীতি দমন কমিশনের একজন আইনজীবী বলেছেন, ‘বিএনপির তরফে এমন কোনও প্রস্তাব এলে পরবর্তী চিন্তা করা যাবে।’
বিএনপির উচ্চপর্যায়ের ঘনিষ্ঠ একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার পরিবারের তরফেও বাসভবনকে সাবজেল ঘোষণা করা হলে তাকে সেখানে রাখার পক্ষে। সেখানে রাখা সম্ভব হলে তার স্বাস্থ্যের নিবিড় পরিচর্যা করা সম্ভব হবে। এছাড়া, দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যেও সরকারের ওপর থেকে ক্ষোভ প্রশমিত হবে, এমন আশাবাদ করেছে দলের একটি সূত্র।
বিএনপির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ নেতা এজমল হোসেন পাইলট বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়ার জামিন কেন হচ্ছে না, তা সারা দেশের মানুষ জানেন। এখন জামিন না হওয়া পর্যন্ত যদি তার বাসভবনকে সাবজেল হিসেবে ঘোষণা তাকে করে সেখানে রাখা হয়, তাহলে তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উন্নতি হবে, এতে সন্দেহ নেই। তবে সবকিছুর ওপরে হচ্ছে, আইনকে তার নিজের গতিতে চলতে দিতে হবে। তাহলে বেগম জিয়ার মুক্তি স্বাভাবিকভাবেই হবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, গত সোমবার গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খানের বাসায় কূটনীতিকদের সঙ্গে ড. কামাল হোসেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর একান্ত বৈঠক হয়। ওই বৈঠকেও খালেদা জিয়ার প্রসঙ্গটি আলোচনায় আসে। বৈঠকে কূটনীতিকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত রবার্ট মিলার, ব্রিটিশ হাইকমিশনার এলিসন ব্লেক, অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার জুলিয়া নিব্লেট, জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী রবার্ট বি. ওয়াপকিনস।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘গতকালকের (সোমবার) বৈঠকে তেমন কোনও আলোচনা হয়নি। তবে বেগম জিয়ার বিষয়টি তো আমরা বলছি। আইনত কী, সেটা আমি দেখে বলতে পারবো। তবে রাজনৈতিকভাবে আমরা বলছি যে, পরিবেশ উন্নত করার জন্য সরকার যদি অন্যভাবে জিনিসগুলো ডিল করে, তাহলে বেটার। কেননা, আমরা তো বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। সেখানে বিভিন্ন দলের, একে-অন্যের প্রতি তো কিছুটা হলেও শ্রদ্ধা থাকা উচিত। কিছুটা সহনশীলতা হলে তো ভালো হয়। না হলে তো বহুদলীয় গণতন্ত্র বাধাপ্রাপ্ত হয়।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র জানায়, ২০১২ সালের ২১ এপ্রিল গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর রোডের বাসবভন ‘ফিরোজা’য় ওঠেন খালেদা জিয়া। এই বাড়িটি বিএনপি নেতা মেজর (অব.) কামরুল ইসলামের ছেলে তানভীর ইসলামের। বাড়িটিতে প্রায় সাতটি বেডরুম, লিভিং রুম, একটি সবুজ লন, বাগানসহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা আছে। ক্যান্টনমেন্টের মঈনুল হোসেন রোডের বাড়িটি আদালতের রায়ে হারানোর পর কিছুদিন খালেদা জিয়া তার ভাই শামীম ইস্কান্দারের বাড়িতে ছিলেন। এরপর ফিরোজায় বসবাস শুরু করেন। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি এই বাড়ি থেকেই পুরান ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠের অস্থায়ী আদালতে এসেছিলেন তিনি। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়ে সাজা হওয়ায় সেখান থেকে সরাসরি পুরান ঢাকার সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। বর্তমানে এখানেই বন্দি জীবন অতিবাহিত করছেন তিনবারের এই সাবেক প্রধানমন্ত্রী।