সায়ন্থ সাখাওয়াৎঃ যে সব পলিটিশিয়ানকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় বলা হয়, ডাকসুর সাবেক ভিপি বা জিএস, তখন তাদের চোখেমুখে এক ধরনের ঔজ্জ্বল্য ধরা পড়ে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনা, স্বাধিকার আন্দোলন ও রাজনীতিবিদ তৈরির অন্যতম সূতিকাগার বলে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু যে কোনো পলিটিশিয়ানের কাছে একই সঙ্গে ঈর্ষা ও গর্বের।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলাদেশের সামগ্রিক ইতিহাসে গৌরবময় ভূমিকা রেখেছে এই ছাত্র সংসদ। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং পরে স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরাচার ও সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার থেকেছে ডাকসু’র নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
কিন্তু ১৯২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে শুরু হওয়া এ ছাত্র সংসদ দুই ডজনের বেশি ভিপি-জিএস দিতে পারেনি। ১৯৯০-৯১ সেশনে শেষবারের মতো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্যানেল থেকে আমান উল্লাহ আমান ও খায়রুল কবির খোকনকে ভিপি-জিএস হিসেবে পেয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়টি। সেই শেষ। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসনের শেকল থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম আঠারো বছরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছয়জন ভিপি-জিএস নির্বাচন করার সুযোগ পেলেও পরের আটাশ বছর শূন্য। সামরিক ও স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের আমলে ডাকসু নির্বাচন হতে পারলেও নব্বই পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের সময়ে তা মুখ থুবড়ে পড়ে।
গত আটাশ বছরে আটাশজন ভিপি ও আটাশজন জিএস দিতে পারত ডাকসু। যারা হতে পারতেন এদেশের গর্বিত পলিটিশিয়ান। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা হয়নি। নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধে কয়েকবার ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নিলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি বিভিন্ন কারণে।
১৯৯০ সালের ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সর্বশেষ নির্বাচন হয়। এরপর হয়নি ডাকসু নির্বাচন। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রায় নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়েছে সিনেটে শিক্ষক প্রতিনিধি, রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট প্রতিনিধি, সিন্ডিকেট সদস্য, ডিন, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠনসহ সব সংগঠনের নির্বাচন। হয়নি শুধু ডাকসু নির্বাচন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকি সবাই তাদের সংগঠনের নেতৃত্ব নির্বাচন করে অধিকার আদায়ের সুযোগ গ্রহণ করলেও তা পারেননি শিক্ষার্থীরা।
ছাত্রলীগ ও তাদের জোটের বাইরে থাকা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাকর্মীসহ সকলেই একসুরে বলছেন, নির্বাচন করার মতো সকল সংগঠনের সহাবস্থান ক্যাম্পাসে নেই।
এমনকি পদাধিকার বলে যিনি ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত (সিলেকটেড) হয়ে আছেন সেই ভাইস চ্যান্সেলের ভূমিকাও এতটাই পার্টিসান হয়ে পড়েছে যে তাকে ইসির কার্বন কপি ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছে না সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলো। ভিসি পদে যোগদানের প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন ইসুতে ভিসি মহোদয়ের বক্তব্য দেখে এটা অনেকটাই স্পষ্ট যে তার ব্যক্তিত্ব ইসি মহোদয়ের থেকে কোনো অংশে কম নয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা ইসি যে ভাষায় যে সুরে কথা বলেন, ভিসি মহোদয়ও সে ভাষায় সে সুরেই কথা বলছেন। সরকারি দলের প্রতিপক্ষকে তারা দুজনেই প্রতিপক্ষ জ্ঞান করেন বলে মনে হওয়ার যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ আছে। ফলে ইসি দেশে যেমন একটা ফ্যান্টাস্টিক নির্বাচন উপহার দিয়ে খুশিতে গদগদ হয়ে বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে অমরত্ব লাভের খায়েশ প্রকাশ করেছেন, ভিসিও তা করবেন না সেটা বিশ্বাস করা মুশকিল।
এরই মধ্যে ছাত্রলীগ ও তাদের জোটভুক্ত সংগঠন ছাড়া বাকি সব ছাত্র সংগঠন নির্বাচন ইস্যুতে বিভিন্ন দাবি জানিয়ে আসছে। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল পেশ করেছে সাত দফা দাবি। ন্যূনতম তিন মাস সব ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান ও স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকা- নিশ্চিত করার পরে আবার ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা, অংশগ্রহণমূলক ও ভীতিহীন পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে হলগুলো থেকে ভোটকেন্দ্র অ্যাকাডেমিক ভবনগুলোতে স্থানান্তর, ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রচারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দূর করা, ছাত্র সংগঠনগুলোর কোনো প্রার্থী ও নেতাকর্মীকে হয়রানি-মামলা অথবা গ্রেপ্তার না করার বিষয়টি নিশ্চিত করা, সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ সাত দফা দিয়েছেন তারা। কিন্তু ভিসি মহোদয় এখানে নীরব। এই দাবিগুলোর মধ্যে কোনোটাই কি মেনে নেওয়ার মতো নয়?
সাত দফা দিলেও ডাকসু নির্বাচনে প্রধান ইস্যু দুটি। এক. হলে ভোটকেন্দ্র ও দুই. শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ। এ দুটি বিষয়ে সব পক্ষের আস্থা অর্জন ছাড়া কোনো ভাবেই একটি গ্রহণযোগ্য ডাকসু নির্বাচন সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতি কোনো কালেই পুরোপুরি মসৃণ ছিল না। ১৯৭৪ সালে ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৎকালীন ছাত্রলীগের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল সাত ছাত্রকে যা ‘সেভেন মার্ডার’ নামে পরিচিত। এমন লোমহর্ষক হত্যাকা-ের জন্য পুরোপুরি দায়মুক্ত নয় কোনো সরকারই। ছাত্রদের হাতে অস্ত্রের ঝনঝনানিও কমবেশি ছিল সব সরকারের আমলেই। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের মোটামুটি হলেও সহাবস্থান ছিল ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। কোনো নেতা বা ক্যাডার হয়তো ঝুঁকির মধ্যে ছিলেন, হলে থাকতে পারেননি, নির্বিঘেœ ক্যাম্পাসে আসতে পারেননি। কিন্তু সরকারবিরোধী পক্ষের কোনো নেতাকর্মীই হলে থাকতে পারবেন না, এমন প্রকট চিত্র দেখা যায়নি আগে। ২১ বছর পরে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মনে হলো তাদের সব চাই। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেই একচেটিয়া অবস্থান নিশ্চিত করে সরকার দলীয় সংগঠন ছাত্রলীগ। সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কার্যত নিষিদ্ধ করা হয় সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম। ফলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো বটেই, কলেজগুলো থেকেও নির্বাসিত হয়ে যায় ছাত্র সংসদ নির্বাচন।
২০০১ সালে বিএনপি জোট ক্ষমতায় আসার পরও সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করে ছাত্রলীগের পলিসি। ফলে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলতে থাকে এক অদ্ভুত ধরনের একদলীয় ছাত্ররাজনীতি, যা প্রকৃত অর্থে রাজনীতি নয়। তা ছিল একদলীয় মাস্তানি, চাঁদাবাজি ও লুটপাট। যা অব্যাহত আছে এখনো। এ কারণে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে প্রাণ দিতে হয়েছে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের অনেক নেতাকর্মীকে।
টানা দশ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার কারণে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে একচেটিয়া অবস্থান কায়েম করেছে ছাত্রলীগ। যাদের পরিচিত কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন তারা নিশ্চয়ই জানেন, হলে থাকতে হলে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীর কথা মতো না চললে তার হলে থাকা কতটা দুরূহ হয়ে পড়ে। আর হলের গণরুমে যে কোনো নেতার আশীর্বাদ ছাড়া থাকার সুযোগ নেই সেটা সবাই জানেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ১৯টি আবাসিক হল, চারটি ছাত্রাবাস রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে প্রায় ৪০ হাজারের মতো শিক্ষার্থী থাকলেও সবগুলো হল ও ছাত্রাবাস মিলিয়ে ঠঁাঁই হয়েছে প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থীর। বাকি অর্ধেক শিক্ষার্থীর কেউ কেউ নিজস্ব বাসা অথবা বিভিন্ন মেস ও ব্যক্তিমালিকানাধীন হোস্টেলে থেকে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন (ডেইলি স্টার, ১৮ জানুয়ারি ২০১৯)।
এই পরিস্থিতিতে হলে থাকা প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে যে ছাত্রলীগের ব্যাপক প্রভাব থাকবে সেটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। এই ছাত্রলীগই থাকছে ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন দলের লাঠিয়াল হয়ে। সেখানে হলগুলোতে ভোটকেন্দ্র করা হলে ছাত্রলীগের আধিপত্যের বিপরীতে অন্য কোনো দলের পক্ষে হলের কোনো আবাসিক ছাত্র বা বাইরের কোনো ছাত্র ভোট দিতে আসবে কি না সে সন্দেহ প্রবল।
প্রায় তিন দশক ধরে বন্ধ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদগুলো আবার শুরু করার একটা শুভ উদ্যোগ হতে পারে ডাকসু নির্বাচন। এ নির্বাচনে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ হেরে গেলেও শুধু এ কারণে তো আর সরকারের পতন হবে না। বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় কোনো জালিয়াতির আশ্রয় নিতে গেলে সেটা সামাল দেওয়া সরকারের জন্য সহজ নাও হতে পারে। এক কোটা সংস্কার আন্দোলন সামাল দিতে গিয়ে সরকার নিশ্চয়ই টের পেয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সাধারণ ছাত্র মার খেতে শিখে গেছে। তারা সকালে ছাত্রলীগের হাতে মার খেয়ে আবার বিকালে ঘুরে দাঁড়ায়, বিকালে মার খেলে আবারও দাঁড়ায় সকালে। তা ছাড়া তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়টি শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরেও।
তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সরকারের বেশি আস্থাভাজন হওয়ার প্রচলিত প্র্যাকটিস করতে গেলে তা সরকারের জন্য বুমেরাং হতে পারে। সে দিকটা বিবেচনায় রেখে ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিপীড়নের মুখে থাকা ছাত্র সংগঠনের দাবিগুলো গুরুত্বের সঙ্গে না নিলে ভুল করবে প্রশাসন। সে ভুলের মাশুল কীভাবে কতটা দিতে হবে তা হয়তো এখনই বলা মুশকিল। তাই প্রশাসনের এ ভুল শুধরে দিতে এগিয়ে আসতে পারেন সরকারি দলের সাবেক ছাত্রনেতারা।
লেখকঃ বিশিষ্ট গনমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।