ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ডাকসু নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কী না- এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে নির্বাচনে অংশ নেওয়া ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রার্থীরা জানান তাদের আশঙ্কার কথা। আগামী ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে কেউ কেউ গত জাতীয় নির্বাচনের প্রসঙ্গটিও টেনে এনেছেন। তবে সেরকম কিছু হলে তার দায় প্রশাসনকে নিতে হবে বলে জানিয়েছেন কোনো কোনো প্রার্থী।
প্রগতিশীল ছাত্র ঐক্য প্যানেলের সহ-সভাপতি পদপ্রার্থী লিটন নন্দী দ্য বলেন, “আমরা মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয় একটি পাতানো ছকে নির্বাচন করার চেষ্টা করছে। তবে আমরা প্রত্যাশা করি, শিক্ষার্থীরা সম্মিলিতভাবে তাদের ভোট দেওয়ার মধ্য দিয়ে সেই নীলনকশাকে প্রত্যাখ্যান করবে।”
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে পদ্ধতি গ্রহণ করেছে তা নির্বাচনের সুষ্ঠুতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, নির্বাচনটিকে সুষ্ঠু করার জন্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে আমরা অনেকগুলো দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু, প্রশাসন অধিকাংশ দাবি অগ্রাহ্য করেছে।
নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে কীভাবে তা প্রতিরোধ করবেন?- এর উত্তরে তিনি বলেন, “আমরা এই ক্যাম্পাস ছেড়ে দিবো না। তবে আমারা প্রশাসনের ওপর আস্থা রাখতে চাই। প্রত্যাশা করি, প্রশাসন এর মূল্য দিবে। এটি তাদেরও আস্থার পরীক্ষা হচ্ছে বটে। তারা যদি আস্থাটি ভেঙ্গে দেয় সেক্ষেত্রে আমাদের তখন প্রশাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে”
“কোনো শিক্ষার্থীকে ভোট দিতে বাধা দেওয়া হলে তা প্রতিরোধ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো,” উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “হলগুলোতে ক্ষমতাসীনরা দীর্ঘদিন থেকে থাকার কারণে সেগুলো তাদের দুর্গে পরিণত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা হলে হলে পাহারা দিবো। আমরা শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকারকে ছিনতাই করতে দিবো না। যেকোনোভাবেই হোক আমরা তা রক্ষা করার চেষ্টা করবো।”
স্বতন্ত্র জোট প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদপ্রার্থী অরণি সেমন্তি খান বলেন, “নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কী না তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। কারণ- হলগুলোতে ভোট কেন্দ্র হচ্ছে। ভোট গ্রহণের সময় অনেক কম। ছেলেদের হলগুলো ক্ষমতাসীনদের দখলে। এছাড়াও, আচরণবিধির যে লঙ্ঘন হচ্ছে সে বিষয়গুলো প্রশাসনের চোখে পড়ছে না। আমরা প্রশাসনকে যদি এমন দলকানা অবস্থায় দেখি তাহলে তো সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কা করতেই হয়।”
এখনই যদি এমন পরিস্থিতি হয় তাহলে নির্বাচনের সময় কী হবে?- প্রশ্ন অরণির। বলেন, “সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে অনেক ভোটারও শঙ্কিত। তবুও আমরা তাদেরকে বলছি- দলে দলে আসেন। ভয়ের কিছু নেই। আমরা রয়েছি। আমাদের কথায় অনেকে উৎসাহ প্রকাশ করেছে।”
অরণির মতে, “জাতীয় নির্বাচনে আমরা কারচুপি লক্ষ্য করেছি। কিন্তু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা শিক্ষার্থীরা ভোটচোরদের ছেড়ে দিবে না বলে আমি মনে করি।”
বাংলাদেশ সাধারণ শিক্ষার্থী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ভিপি প্রার্থী নুরল হক নুর বলেন, “সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের পুরোপুরি আস্থায় আনতে পারেনি। নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্যে আমরা বেশকিছু দাবি-দাওয়া জানিয়েছিলাম। নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্যে নিরপেক্ষ শিক্ষকদের নিয়ে একটি টিম গঠন করার দাবি আমরা জানিয়েছিলাম তা প্রশাসন মানেনি।”
“হলে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। তাই আমরা নির্বাচনটিকে লাইভ দেখানোর দাবি জানিয়েছিলাম। সেই দাবিও প্রশাসন মানেনি। ভোটের সময় বাড়ানোর দাবিও প্রশাসন মানেনি।”
তিনি বলেন, “সিসিটিভি থাকবে বলে প্রশাসন জানিয়েছে। কিন্তু, তা থাকলে কী লাভ? কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় গ্রন্থাগারের সামনে আমাদের ওপর যখন হামলা করা হলো তখন সেগুলোর ফুটেজ ছিলো। আমরা হামলাকারীদের নাম-পরিচয়সহ প্রশাসনকে জানিয়েছিলাম। কিন্তু, প্রশাসন এর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি, ভিসি স্যারের কার্যালয়ের সামনে নিপীড়ণবিরোধী আন্দোলনের সময় হামলা করা হয়েছিলো। সবাইকে চিহ্নিত করা হয়েছিলো। অথচ প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তাই সিসিটিভি থাকলেই কী লাভ হচ্ছে? সেই জায়গা থেকেই আমরা চাচ্ছিলাম সিসিটিভির পাশাপাশি নির্বাচনটিকে দৃষ্টিগোচর করার জন্যে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলাম। কিন্তু, প্রশাসন তা মানেনি। আর সেই কারণেই আমাদের মনে আশঙ্কা রয়েছে- আসলে প্রশাসন কি সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে নাকি একটি পরিকল্পিত বা নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে?”
“এটি ছাত্রদের জন্যে নির্বাচন অথচ প্রশাসন ছাত্রদের দাবিগুলো আমলে নিচ্ছে না,” উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সচেতন। তারা এতোদিন ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির নামে যে অপরাজনীতির শিকার হয়ে আসছেন তার প্রতিবাদ ভোটের মাধ্যমে দিতে পারবেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা কোনো মহল যদি তাদের সেই সুযোগ কেড়ে নেয় তাহলে শিক্ষার্থীরাই এর দাঁতভাঙ্গা জবাব দিবে।”
“ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য সব সংগঠনের সঙ্গে কথা হয়েছে- কোনো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হলে সবাই মিলে প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলবো,” মন্তব্য এই ছাত্রনেতার।
“জাতীয় পর্যায়ে নির্বচনে যখন কারচুপি হয়ে থাকে তখন বিশ্ববিদ্যালয় তো এর বাইরে না” বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, “কিছু শিক্ষককে দেখেছি শিক্ষকতার জায়গা থেকে সরে গিয়ে তারা অনেক ক্ষেত্রে দলীয় নেতাকর্মীর মতো আচরণ করেন। তাদের দ্বারাও কারচুপির একটা আশঙ্কা থেকে যায়।”
“ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য সব সংগঠনগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে আমরা দল গঠন করবো যাতে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে তা তাৎক্ষণিকভাবে জানতে পারি এবং সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পারি।”
তার মতে, “২৮ বছরের আবেগ-ভালোবাসা এই নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত। এতো বছর পর ফিরে পাওয়া অধিকার কেউ যদি কেড়ে নেওয়া চেষ্টা করে তাহলে তার প্রতিবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৩ হাজার শিক্ষার্থীই জানাবে।”
ছাত্র ফেডারেশন সমর্থিত প্যানেল থেকে জিএস পদপ্রার্থী হাবিবা বেনজীর বলেন, “যেভাবে আচরণবিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে তাতে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হবে কী না তা নিয়ে আশঙ্কা থাকছেই। প্রশাসনকে সেগুলো জানিয়েছি। আমরা জানি সেগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। তারপরও আমরা আস্থা রাখতে চাই।”
তিনি বলেন, “নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে সবাই মিলে এক সঙ্গে এর প্রতিরোধ করবো। যদি এমন হয় যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয় তাহলে আমি নির্বাচন বর্জনও করতে পারি।”
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্যানেলের ভিপি পদপ্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৩ হাজারের বেশি ভোটার। অথচ ভোট দেওয়ার সময় খুবই কম বলে আমি মনে করি। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ভোটের আগে দীর্ঘ সারি তৈরি করে এবং হলের বাইরে থেকে যেসব ভোটর আসবেন তারা যেনো ভোট দিতে না পারে সে ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি করার কথা শুনতে পারছি।”
তিনি বলেন, “সাধারণ শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ অভিযোগ করছেন তাদেরকে বলা হয়েছে তারা ভোট দেওয়ার পর তা মোবাইল ফোনে তুলে যেনো নিশ্চিত করে যে ভোটগুলো ছাত্রলীগের প্রার্থীদের দেওয়া হয়েছে।”
“দেশে ভেঙ্গে পড়া নির্বাচন ব্যবস্থার যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ডাকসু নির্বাচনে ভোট দেওয়ার মাধ্যমে তা প্রতিরোধ করা হবে” বলেও মনে করেন এই ছাত্রনেতা।
তার মতে, “দেশে এক ধরনের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। তা হলো- ভোট দিলে কী হবে। ফলাফল তো তাদের ক্ষমতাসীনদের পক্ষেই যাবে। শিক্ষার্থীদের অনেকের মধ্যেও সেই ধরনের বিশ্বাস দেখতে পাচ্ছি। তাই অনেকে ভোট দিতে অনাগ্রহ দেখিয়েছে। তবে, ভোটের দিন কোনো অনিয়ম দেখলে সব সংগঠনকে নিয়ে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলবো।”
প্রশাসনকে অন্ধ-কালা-বোবা বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “অনেক সময় লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। ভিসি স্যার, প্রক্টর স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু, তারা উদাসীন ভাব দেখিয়েছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে যে তারা একটি লোক দেখানো নির্বাচন করতে চায়।”
“ক্ষমতাসীনরা চাচ্ছে ভোটার উপস্থিতি কম রাখতে। আর আমরা ভোটারদের বলছি যে আপনার ভোট দিতে আসেন। নির্বাচনে আমরা ভোটারদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের বাইরে থাকে। সেদিন বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস বন্ধ রাখার কথা শুনতে পাচ্ছি। এর ফলে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা ক্যাম্পাসে এসে ভোট দিতে নিরুৎসাহিত হবে বলে আমি মনে করি। যদি এমন হয় তাহলে সব প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে আমাদের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করবো,” জানান মোস্তাফিজুর রহমান।
কিন্তু, এ বিষয়ে কথা বলার জন্যে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ভিপি, জিএস এবং এজিএস প্রার্থীদের সঙ্গে টেলিফোনে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করা হলেও তারা ফোন ধরেননি। এমনকি, ক্ষুদে বার্তা দিয়েও তার কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।