ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ভোটের আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভর্তির অভিযোগের আগুনে ঘি ঢেলেছে নির্বাচনের দিন সকালে চট্টগ্রাম মহানগরীর লালখান বাজার এলাকার একটি ভোট কেন্দ্রে ভোট গ্রহন শুরুর পুর্বেই প্রায় ভর্তি একটি ব্যলট বাক্স স্থানান্তর করার দৃশ্য দেখানো বিবিসির এক প্রতিবেদন।
ইতিমধ্যেই ভোটের আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভর্তির অভিযোগ তুলেছেন একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রায় সব পরাজিত প্রার্থী। এই প্রার্থীরা দল ও জোটের কাছে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার এমন অনিয়মের অভিযোগের তথ্য প্রমাণও জমা দিয়েছেন।
গত নির্বাচনের পর রাতের ভোট নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হলেও নির্বাচনে জয়ী আওয়ামী লীগ এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
শুরুতে নির্বাচন কমিশনও এ বিষয়ে সতর্ক অবস্থান প্রকাশ করলেও এখন কমিশন সংশ্লিষ্টদের বক্তব্যই রাতের ভোট নিয়ে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। একের পর এক কর্মকর্তারা রাতের ভোট নিয়ে কথা বলছেন। রাতের ভোট ঠেকাতে ইভিএম চালু, সকালে কেন্দ্রে ব্যালট পাঠানোর মতো প্রস্তাবনা রাখছেন তারা। তাদের এমন বক্তব্যে বিগত নির্বাচনগুলোতে রাতে ভোট পড়েছে বিরোধীদের এমন দাবি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের এমন বক্তব্য তাদের ব্যর্থতারই বহিঃপ্রকাশ। এমন ঘটনার দায় কমিশন এড়াতে পারে না।
উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের প্রথম ধাপের আগে গত ৮ই মার্চ এক বক্তব্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা রাতে জোর করে ব্যালট পেপারে সিল মারার বিষয়টি তুলে আনেন। সিইসির বক্তব্যের সূত্র ধরে কয়েকজন নির্বাচন কমিশনার ও ইসির কর্মকর্তারাও তাদের বক্তব্যে রাতে ভোটের বিষয়টি যে ঘটছে তা অনেকটা স্বীকার করে নেন। রাতে ভোট ঠেকাতে ইভিএমের ব্যবহার ও সবশেষ নির্বাচন কমিশন সচিব সকালে কেন্দ্রে ব্যালট পাঠানোরও প্রস্তাব দেন।
তবে, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বশীলদের এমন বক্তব্য ও রাতে ভোট দেয়ার মতো ঘটনাকে পুরোপুরি নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা বলে মনে করেন নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা। দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছেন এমন ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, নির্বাচন কমিশন নিজেদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে না পারার কারণে রাতে ভোট দেয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। ইসি এক্ষেত্রে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে বলেও মন্তব্য নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞদের। কমিশনের ব্যর্থতায় নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের মধ্যেও এক ধরনের অনাস্থা তৈরি হয়েছে।
গত ৮ই মার্চ নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে এক কর্মশালায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা বলেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হলে আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার কোনো সুযোগ থাকবে না। সিইসি বলেন, জেলা-উপজেলা সদর থেকে অনেক দূরে দূরে ভোটকেন্দ্র হয়।
এ কারণে আগের দিন এসব কেন্দ্রে ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স পাঠাতে হয়। এখানে ভোটের দিন সকালে ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স নিয়ে যাওয়া যায় না। কিন্তু যদি ইভিএমে ভোটের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে আর ভোটের আগের দিন রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করার সুযোগ থাকবে না। তিনি বলেন, সমাজের মধ্যে অনিয়ম ঢোকে। তা প্রতিহত করতে পদক্ষেপ নিতে হয়। এ কারণে কমিশন ভাবছে ইভিএমে ভোট নেয়া শুরু করবে। নির্বাচনের পরিবেশ ধীরে ধীরে অবনতির দিকে যাচ্ছে বলেও ওই অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তিনি বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করতে কমিশনকে আচরণবিধি তৈরি করতে হয়, নির্বাচনে আইন প্রণয়ন করতে হয়, কঠোর পদক্ষেপ নিতে হয়।
তারপরও সামাল দেয়া যায় না। এমন অবস্থা থেকে উত্তরণ দরকার। খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এমন বক্তব্যের পর মূলত দেশজুড়ে রাতে ভোটের বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। অনেকে প্রশ্ন করেন তাহলে, কমিশন কি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটগ্রহণে নিজেদের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরছে কি না? সিইসির এমন বক্তব্যের পাঁচ দিন পরই নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম আরেক অনুষ্ঠানে নির্বাচনে অনিয়ম ও কমিশনের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেন। গত ১৪ই মার্চ কিশোরগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, উপজেলা নির্বাচনে কোনো অনিয়ম সহ্য করা হবে না। প্রয়োজনে গুলি চলবে, ভোটগ্রহণ বার বার বন্ধ হবে। কিন্তু অনিয়ম মেনে নেয়া হবে না। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মসূচির সমাপনী অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি। রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নই।
আমরা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কাছে দায়বদ্ধ। বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ। তাই নিজের বিবেকের তাড়নায় সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের অংশীদার হোন। তিনি বলেন, ব্যালট যদি কেউ ছিনতাই করে আপনারা ঠেকানোর জন্য চেষ্টা করবেন। যদি ঠেকাতে না পারেন তাহলে নির্বাচন বন্ধ করে দিন। ভোট চুরি ঠেকাতে না পারলে আমার নির্বাচন করার দরকার নাই। যদি নির্বাচন চলার সময়ে কেউ স্ট্যাম্পিং করার চেষ্টা করে আমি কিন্তু আমার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দিচ্ছি জাস্ট ওপেন ফায়ার। তারপরও যদি না পারেন কী দরকার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নির্বাচন করার, জাস্ট স্টপ, বন্ধ করে দেন আপনার নির্বাচন। এরপর আরো একজন নির্বাচন কমিশনার তার বক্তব্যে রাতে ভোট দেয়ার বিষয়ে বক্তব্য দেন।
সিইসি ও তার কমিশনের অন্য সদস্যদের বক্তব্যে জনমনে প্রশ্ন উঠে তাহলে ইসির কাজটা কি? এদিকে, উপজেলা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে গত ১৮ই মার্চ ভোটগ্রহণ শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, আপনারা জানেন ভোটকেন্দ্রে যে সব অনিয়ম হয়ে থাকে তা রোধ করার জন্য নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। তার মধ্যে অন্যতম একটা পদক্ষেপ হলো ভোটে প্রযুক্তির ব্যবহার। আর দুই নম্বর হলো, যেখানে কেন্দ্রগুলো খুব কাছে সেখানে সকালে ব্যালট পেপার পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। ইসি সচিব আরো বলেন, আর আমরা একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি, সেটি হলো, আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে ব্যালট পেপারগুলো সকালে পাঠাব। এবং সকাল ৮টার পরিবর্তে সকাল ৯টায় ভোটগ্রহণ শুরু হবে। প্রিজাইডিং অফিসাররাও সকালে কেন্দ্রে যাবেন। যে যে কেন্দ্রগুলোতে সকালে ব্যালট পেপার পাঠানো সম্ভব সেখানে অবশ্যই সকালে পাঠানো হবে। হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, আগামী পৌরসভা নির্বাচনে সব কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করার চিন্তা আমাদের আছে। ইভিএম সকালে কিংবা রাতে যখনই পৌঁছাবে অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই।
কারণ সফটওয়্যারের ব্যবহারের ফলে নির্দিষ্ট সময়ের আগে ইভিএম মেশিন কোনো কাজ করবে না। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও নির্বাচন পর্যবেক্ষক তোফায়েল আহমেদ মানবজমিনকে জানান, আমরা জাতীয় নির্বাচন থেকেই বলে আসছি যে নির্বাচন ভালো হয় নাই। নির্বাচন কমিশন যে পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। রাতে ভোট বলেন আর ভোটারহীন কেন্দ্র বলেন এর সম্পূর্ণ ব্যর্থতা নির্বাচন কমিশনের। জাতীয় নির্বাচনেরও আগ থেকে সকালে কেন্দ্রে ব্যালট পাঠানোর দাবি জানিয়েছিলাম আমরা। কমিশন তা আমলে নেয়নি। তবে রাতে ভোটের বিষয়টি স্বীকার করে নতুন করে সকালে কেন্দ্রে ব্যালট পাঠিয়েও খুব একটা লাভ হবে বলে মনে হয় না। কারণ আমরা ধীরে ধীরে আমাদের নির্বাচন পদ্ধতিটাকে নষ্ট করে ফেলেছি। নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতার কারণেই এমন সব হতে চলেছে। এবং ভোটাররা কমিশনের ওপর পুরোপুরি আস্থা হারিয়েছে। কেউ আর এখন কেন্দ্রে যেতে চাইছেন না।
এর দায়ভার ইসিকেও নিতে হবে। এক ঘণ্টা ভোটের সময় পিছিয়ে দিয়ে সকালে কেন্দ্রে ব্যালট পাঠালেও তেমন একটা লাভ হবে না বলে মন্তব্য এই নির্বাচন বিশেষজ্ঞের। তোফায়েল আহমেদ বলেন, নির্বাচন যেরকমভাবে চলছে সেভাবেই চলবে। এতে করে ভোটের পরিস্থিতি খুব একটা হেরফের হবে না। কারণ, প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রার্থীরা এখন আর নির্বাচনে আসতে চাইছেন না। রাতের ভোট বন্ধ করার উদ্যোগে বড় জোর ভোটের হার কমবে। এর থেকে বেশি কিছু হওয়ার সম্ভাবনা দেখি না। সবচেয়ে বড় বিষয় মানুষ ভোটবিমুখ হয়ে গেছে। রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন এর জন্য দায়ী। এখনকার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী ও কনটেস্টের প্রয়োজন হয় না। নির্বাচন কমিশন সে ধরনের পরিবেশ তৈরি করতে পারেনি। নির্বাচনের জন্য অসমতল পরিবেশ করাটা কমিশনের প্রধান কাজ, তারা সে কাজে ব্যর্থ হয়েছে।
খুব শিগগির এমন অবস্থার পরিত্রাণ ঘটবে বলেও মনে করছি না। এদিকে, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াৎ হোসেন ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার ঘটনায় তদন্তের দাবি করেছেন। তিনি মনে করেন, সিইসি হয়তো ইভিএম-এর বৈধতার জন্য আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার কথা বলেছেন। কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠেছে আগের নির্বাচনে এরকম হয়েছে কি না। কারণ গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখা নিয়ে অভিযোগ এবং ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। এখন নির্বাচন কমিশনের কাজ হলো এটা নিয়ে তদন্ত করা। তারা তো আর পরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় থাকবেন না। তাদের এই তদন্ত প্রতিবেদন ধরে তখন যারা নির্বাচন পরিচালনা করবেন তারা ব্যবস্থা নিতে পারবে। আর যদি তদন্তে আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার অভিযোগ প্রমাণ হয় তাহলে আইন ও সংবিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
এসব বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান ,বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি,হাসিনা সরকার সমর্থক শিক্ষাবীদ অধ্যাপক ড. নাজমুল আহছান কলিমুল্লাহ মনে করেন সিইসিসহ অনান্য নির্বাচন কমিশনাররা রাতে ব্যালট পেপারে সিল মারা নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা আসলে জনগণের ধারণা। তিনি বলেন, আমাদের বুঝতে হবে বাস্তবে কি ঘটেছে আর পাবলিক পারসেপশন কি? আমি বলবো, পাবলিক পারসেপশন এরকম বলেই হয়তো নির্বাচন কমিশন সেখান থেকে পরিত্রাণ চায়। তারা সকালে ব্যালট পেপার পাঠিয়ে নির্বাচন করতে চাইছে। মূলত রাতে ভোট হয় এরকম পাবলিক পারসেপশন যাতে আর না থাকে সেজন্য এসব বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলতে গিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এমন বক্তব্য দিয়েছেন।