DMCA.com Protection Status
title="৭

স্মৃতির মনিকোঠায় ভয়াল ২৫শে মার্চ ১৯৭১ঃ যেমনটি দেখেছি আমি

ক্যাপ্টেন (অবঃ)মারুফ রাজুঃ ফিরে দেখা ১৯৭১ সালের ভয়াল ২৫শে মার্চের রাত।আমার বয়স তখন অতি অল্প হলেও সব ঘটনা পরিষ্কার মনে আছে।

আমরা তখন থাকতাম চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির রোড-৩ এর ৭৮/এ প্লটের  নিজস্ব বাড়িতে।আমাদের পাড়ায় বাঙ্গালী বলতে ছিল আর মাত্র ৩টি পরিবার বাদবাকি সবাই ছিলো উর্দু ভাষী পশ্চিম পাকিস্থানি ব্যবসায়ী/শিল্পপতি ও তাদের পরিবার।

25m1বাঙ্গালীরা ছিলেন রোড -২ এর সৈয়দ হোসেন আলী চাচা, সোসাইটি বিল্ডিং এ ইন্জিনিয়ার আবদুর রউফ চাচা (হানাদার পাক বাহিনীর হাতে শহীদ ) এবং রোড-৩ এর ৬২নং বাড়িতে থাকতেন ৮ম ইস্ট বেংগল রেজিমেন্টের উপ অধিনায়ক মেজর জিয়া ও তার পরিবার।

প্রথমক্ত ২টি পরিবারের সাথে যথেষ্ট আসা যাওয়া থাকলেও মেজর জিয়ার পরিবারের সাথে আমাদের প্রায় যোগাযোগ ছিলো না বললেই চলে। মাঝে মাঝে বিকেলে সোসাইটি পার্কে মেজর জিয়ার  শিশু পূত্র তারেক রহমান  আর্দালী বা ব্যাটম্যানদের সাথে মাঠে খেলতে আসলেও তার সাথে খুব বেশী খেলার সুযোগ হয়নি।

 

25mআমাদের বাসার ঠিক পিছনে ছিলো ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের  ক্যাম্প (পরবর্তি কালে তা হয় টিসিবির গোডাউন এবং অধুনা চট্টগ্রাম শপিং কম্প্লেক্স )।আমরা ভাইবোনরা প্রায়শঃই গভীর আগ্রহে সৈনিকদের প্যারেড / পিটি সহ বিভিন্ন কর্মকান্ড লক্ষ্য করতাম।

ক্যাম্পের বিপরিতেই ছিলো একটি হিন্দু বস্তি।ওখান থেকে রোজ আমাদের বাসায় গরুর দুধ আর কাঁচা মাখন আসতো।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বাধীকার আদায়ের অসহযোগ আন্দোলন তখন তুঙ্গে।যাই হোক দেশের তৎকালীন বিরাজমান অস্থির অবস্থার সুফল মানে অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্কুল ( জামাল খান  রোডস্থ সেইন্ট মেরীস স্কুল ) বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আনন্দে আমরা ভাইবোনেরা বেশ খুশী ছিলাম।

রেডিওতে তখন রাতদিন বাজছিলো দেশাত্ববোধক গান (চট্টগ্রামে তখনও টিভি আসেনি)।আব্বাকে প্রায়ই বলতে শুনতাম দেশের অবস্থা খুবই খারাপ,পশ্চিমারা আমাদের এতো সহজে ছেড়ে দেবে না,গৃহযুদ্ধ অনিবার্য,এদের সাথে আর থাকা যায় না, ইত্যাদি।

এসব কথা খুব ভালো না বুঝলেও যুদ্ধ শব্দ টা শুনে বেশ পুলকিত বোধ করতাম।সেই ভয়াল রাতে যথারীতি রাত ১০টার ভিতরেই আমরা ভাইবোনেরা ঘুমিয়ে পড়ি।গভীর রাতে প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়।

আমাদেরকে আব্বা খাটের নীচে শুইয়ে দিয়ে বলেন "যুদ্ধ মনে হয় শুরু হয়ে গেছে,সবাই আল্লাহ আল্লাহ করো",বলেই তিনি রেডিওর নব ঘোরাতে লাগলেন।আম্মা পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করতে লাগলেন।কিন্ত রেডিওতে দেশের গান ছাড়া আর কিছুই হচ্ছিলোনা।

গোলাগুলির প্রচন্ডতা কমবেশী রাতভর চলে।এভাবে আস্তে আস্তে ভোরের আলো ফুটলে গোলাগুলি অনেকটা থেমে যায়।আব্বা তখন কৌতুহলবশতঃ আম্মার প্রবল আপত্তি সত্তেও ছাদে যান,আমি যথারীতি উনার সাথে যাই।

সেনা ক্যাম্পের কম্পাউন্ডে বেশ কিছু মানুষকে পড়ে থাকতে দেখি।পরে আব্বা আনিস ভাই (আমাদের বাবুর্চি) কে খোজ নিতে পাঠান,জানা যায় ঢাকার গনহত্যার খবর পাবার পরপরই  ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙ্গালী সৈনিকরা ইউনিটের বাঙ্গালী উপ অধিনায়ক মেজর জিয়া ও অন্যা্ন্য বাঙ্গালী অফিসারদের নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষনা করে।

প্রথমে নিজেদের কিছু হতাহতের পরে বাঙ্গালী সৈনিকরা অচিরেই ক্যাম্প দখল করে নেয়।সেদিন সকালেই আটক পশ্চিম পাকিস্থানী অফিসারদের(ইউনিটের অধিনায়ক সহ)সবাইকে জবাই করে হত্যা করা হয়।

দুপুরের পর থেকেই ক্রমাগত ভাবে রেডিওতে প্রচার করা হতে শুরু করে মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষনা। বস্তুত চট্টগ্রামের এই ৮ম ইস্ট বেঙ্গলের প্রতিরোধ থেকেই শুরু হয় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ .,মেজর জিয়ার দৃপ্ত কন্ঠে জাতি খুজে পায় দিশা।,পথহারা ,নেতৃত্বহীন  জাতি খুজে পেলো আলোক বর্তিকা।

আমরা ২৫শে মার্চের ভয়াল রাতে ঢাকার ঘটনাবলীই বারংবার শুনি, চট্টগামের  অকুতভয় ইস্টবেঙ্গল টাইগারদের এই প্রথম প্রতিরোধ যা আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের শুভ সূচনা করেছিল,তা খুব একটা শুনতে পাই না। সেই নাম না জানা বীর যোদ্ধাদের প্রতি রইলো আমার হ্রদয়নিংরানো ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!