ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০শে মে দেশের দক্ষিণ-পূর্বের বন্দর নগরী চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একদল বিপদগামী সেনা অফিসার কর্তৃক নৃশংসজনক ভাবে নিহত হন।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপি'র স্থানীয় নেতাদের মধ্যে সংঘটিত একটি বিবাদের মধ্যস্থতা করতে চট্টগ্রামে যান। ৩০শে মে রাতে একদল বিপদগামী সেনা অফিসার চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ আক্রমন করে জিয়াউর রহমানসহ আরও কয়েকজনকে গুলি করে। যার ফলশ্রুতিতে, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হন।
তার এই হত্যাকান্ডের ঘটনায় তৎকালীন সেনাপ্রধান লেঃ জেনারেল হুসেইন মোঃ এরশাদ সরাসরি জড়িত না থাকলেও এই ঘটনার পূর্বাপর তার সন্দেহজনক কার্যকলাপ এবং জেনারেল মন্জুর হত্যায় তার যোগসাজসের যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমান পাওয়া যায়।তদুপরি সকল মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের চট্টগ্রাম ডিভিশনে সন্নিবেশিত করে তিনি এক ঢিলে বহু পাখি শিকার করেছেন বলেও অনেকে মনে করেন।পরবর্তিতে অতি অল্প সময়ে তড়িঘড়ি করে এই হত্যার বিচার কাজ সম্পন্ন করে জড়িত মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের মৃত্যুদন্ড সহ বিভিন্ন শাস্তি দেয়া হয়।
৩০শে মে'র ঘটনাপ্রবাহঃ
৩০শে মে ভোরে জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অবস্থান করছিলেন। ভোর ৪টায় সেনাবাহিনীর অফিসারদের তিনটি দল চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ আক্রমণ করে। এ আক্রমণে সৈন্যরা অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকায় ১৬ জন অফিসার জড়িত ছিলেন। তাদের এগারটি সাবমেশিন গান, তিনটি রকেট লাঞ্চার এবং তিনটি গ্রেনেড ফায়ারিং রাইফেল ছিল। আক্রমণকারীদের সকলেই ছিলেন কমিশনপ্রাপ্ত সিনিয়র অফিসার।
আক্রমণকারী দলের মূল হোতা লে. কর্নেল মতিউর রহমান, লে. কর্নেল মাহবুব, মেজর খালেদ, এবং লে. কর্নেল ফজলে হোসেন সার্কিট হাউজে রকেট নিক্ষেপ করে ভবনের দেয়ালে দুটি গর্ত সৃষ্টি করার মাধ্যমে আক্রমণ শুরু করেন। এরপর অফিসাররা কক্ষগুলোতে জিয়াউর রহমানকে খুঁজতে থাকেন। মেজর মোজাফফর এবং ক্যাপ্টেন মোসলেহ উদ্দিন সর্বপ্রথম জিয়াউর রহমান কে খুঁজে পান। মোসলেহ উদ্দিন জিয়াউর রহমান কে জানান যে, তাকে তাদের সাথে সেনানিবাসে যেতে হবে। এরপর কর্নেল মতিউর রহমান আরেকটি দল নিয়ে উপস্থিত হন এবং জিয়াউর রহমান কে অনেক কাছ থেকে একটি এসএমজি দিয়ে গুলি করে।
আক্রমণকারীদের মধ্যে, লে. কর্নেল মতিউর রহমান এবং কর্নেল মাহবুবকে পলায়নরত অবস্থায় হত্যা করা হয়। মেজর খালেদ এবং মেজর মোজাফফর পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও ক্যাপ্টেন মোসলেহ উদ্দিন গ্রেফতার হন এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা লাভ করেন। তবে ২০১০ সাল পর্যন্ত পাওয়া তথ্যানুযায়ী এই খুনি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।
ফলাফলঃ
১৯৮১ সালের ৩০শে মে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চীফ অব আর্মি স্টাফ লেঃ জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আপাততঃ অনুগত থাকেন এবং মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুরের নেতৃত্বে জিয়াউর রহমানের সহযোগীদের দ্বারা সংগঠিত অভ্যুত্থান দমন করার জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন।
সরকার বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দিয়ে সময়সীমা প্রদান করে। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অপারেশনে অংশগ্রহণকারী অফিসাররা এবং অধিকাংশ সৈন্য আত্মসমর্পণ করে। নেতৃত্ব প্রদানকারী অফিসাররা সহ জিওসি মঞ্জুর পার্বত্য চট্টগ্রামে পালানোর চেষ্টা করেন। পথিমধ্যে সরকার প্রেরিত বাহিনী কর্তৃক তারা গ্রেফতার হন। কর্নেল মতিউর রহমান এবং লে. কর্নেল মাহবুব (২১ ইস্ট বেঙ্গলের প্রধান, মঞ্জুরের ভাগ্নে) মেজর মান্নান (পাকিস্তান ফেরত অফিসার, ১২ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়নের ২আইসি) কর্তৃক নিহত হন।
জেনারেল মঞ্জুর তার স্ত্রী ও সন্তানদের খাওয়ানো অবস্থায় ফটিকছড়ির একটি চা বাগানের জীর্ণ কুটিরে পুলিশ ইন্সপেক্টর গোলাম কুদ্দুসের হাতে ধরা পড়েন। পুলিশ ইন্সপেক্টর গোলাম কুদ্দুস তাকে গ্রেফতার করে হাটহাজারী থানায় নিয়ে যায়। সেখানে তিনি একজন আইনজীবীর জন্য আবেদন করলে তা নাকচ করে দেওয়া হয়। তিনি বারবার পুলিশের হেফাজতে থেকে চট্টগ্রামে জেলে প্রেরিত হওয়ার জন্য আবেদন করতে থাকেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন পুলিশের হেফাজত থেকে নিষ্কৃতি পেলেই সেনাবাহিনী তাকে হত্যা করবে। কিন্তু যখন তাকে পুলিশ ভ্যানে উঠানো হয়, তখন সেনাবাহিনী একটি দল থানায় উপস্থিত হয়। কিছুক্ষণ বিতর্কের পর ক্যাপ্টেন এমদাদ জেনারেল মঞ্জুরের হাত-পা বেঁধে প্রায় টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তুলে চট্টগ্রাম অভিমুখে রওয়ানা হয়। পরবর্তীতে কী ঘটেছিল তা সরকার কখনো প্রকাশ করেনি। তবে সরকারের রেডিও-টেলিভিশনে ঘোষিত হয়- চট্টগ্রাম সেনানিবাসে একদল উচ্ছৃংখল সৈন্যের হাতে জেনারেল মঞ্জুরের নিহত হয়েছেন।জেনারেল মন্জুরকে আটকের পুরস্কার হিসাবে এই পুলিশ ইন্সপেক্টর গোলাম কুদ্দুস পরবর্তিতে এরশাদ শাসনামলে বিপুল ভাবে পুরস্কৃত হন,সেই অর্থে পুলিশের চাকরী ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেন। আজ তিনি বাংলাদেশে অন্যতম তৈরী পোষাক রফতানীকারক প্রতিষ্ঠান ড্রাগন গ্রুপের কর্নধার।
চট্টগ্রাম বিদ্রোহের অন্যান্য পরিকল্পনাকারীদের সামরিক আদালতে বিচারের আওতায় আনা হয় এবং জেল ও ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। ১৯৯৫ সালে মঞ্জুরের বড় ভাই জেনারেল এরশাদসহ বেশ কয়েকজনকে মঞ্জুর হত্যায় দায়ী করে মামলা দায়ের করেন।
জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পরে বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পান। তিনি ১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেও ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ এরশাদ কর্তৃক সংঘটিত এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে অপসারিত হন।
জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড মামলার অন্যতম একজন আসামি, ক্যাপ্টেন (অব.) গিয়াসউদ্দিন আহমেদ ময়মনসিংহ জেলার জাফরগঞ্জ উপজেলা থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।
১২ জন অফিসার মুক্তিযোদ্ধাকে জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডে ভূমিকা রাখার জন্য সামরিক আদালতে মাত্র ১৮ দিনের দ্রুত বিচারকার্যে ফাঁসি দেওয়া হয়। ১৩তম মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে চট্টগ্রামে ৩০শে মের ঘটনাপ্রবাহে বুলেটের আঘাতে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন থাকার জন্য দুই বছর পরে ফাঁসি দেওয়া হয়।
বিচারকার্যঃ
সামরিক ট্রাইবুনালে জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে ১৮ জন অফিসারকে অভিযুক্ত করা হয়। এদের মধ্যে ১৩ জন মৃত্যদণ্ড এবং বাকি ৫ জন বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড লাভ করেন। এ অফিসারদের ১৯৮১ সালের ১লা জুন থেকে ৩রা জুনের মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছিল। মেজর জেনারেল আবদুর রহমানের সভাপতিত্বে ১০ই জুলাই ১৯৮১ থেকে ২৮শে জুলাই ১৯৮১ পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলে সামরিক আদালতের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। রায় অনুযায়ী ১২ জন অফিসারের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। পাকিস্তান-ফেরত অফিসার মেজর জেনারেল আবদুর রহমানকে পরবর্তীতে ১৯৮৩/৮৪ সালে ফ্রান্সে রাষ্ট্রদূত হিসেবে প্রেরণ করা হয় এবং সেখানেই তিনি রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। জেনারেল রহমানের পরিবারের দাবি- তার মৃত্যুর সাথে বাংলাদেশ সরকার জড়িত।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণঃ
১. ব্রিগেডিয়ার মহসিন উদ্দিন আহমেদ
২.কর্নেল নওয়াজেশ উদ্দিন
৩. কর্নেল এম আব্দুর রশীদ
৪. লেঃ কর্নেল এওয়াইএম মাহফুজুর রহমান
৫.লেঃ কর্নেল এম দেলোয়ার হোসেন
৬.লেঃ কর্নেল শাহ মোঃ ফজলে হোসেন
(শারীরিকভাবে অক্ষম থাকা সত্ত্বেও ১৯৮৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়)
৭. মেজর এজেড গিয়াসউদ্দীন আহমেদ
৮. মেজর রওশন ইয়াজদানী ভূঁইয়া
১০. মেজর কাজী মোমিনুল হক
১১. মেজর এম মজিবুর রহমান
১২. ক্যাপ্টেন মোঃ আব্দুস সাত্তার
১৩. ক্যাপ্টেন জামিল হক
১৪.লেঃ রফিকুল হাসান খান, মাত্র ২৩ বছর বয়সে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।
(রফিক দাবি করেন তিনি উপর মহলের আদেশে এ বিদ্রোহ সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকা সত্ত্বেও অংশগ্রহণ করেন)
এই ১৩ জন অফিসারের পক্ষের আইনজীবীরা বিচারের সময় আত্মপক্ষ সমর্থনের সামান্যতম সুযোগ না পাওয়ায় পরবর্তীতে বিচারকার্যটিকে "প্রহসনমূলক বিচার" বলে দাবি করেন।
কারাদণ্ডপ্রাপ্তঃ
1 লেঃ মোসলেহ উদ্দীন। (যাবজ্জীবন কারাদন্ড)
(এই অফিসারটি ব্রিগেডিয়ার মহসিনের ভাই ছিলেন, মহসিনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও তাকে দেওয়া হয়নি।)
বহিষ্কৃত অফিসারগণঃ
নিম্নলিখিত অফিসাররা সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত হন।
১. ব্রিগেডিয়ার আবু সৈয়দ মতিউল হান্নান শাহ
২. ব্রিগেডিয়ার একেএম আজিজুল ইসলাম
৩.ব্রিগেডিয়ার গিয়াস উদ্দীন আহমেদ চৌধুরী (বীর বিক্রম)
৪. ব্রিগেডিয়ার আবু জাফর আমিনুল হক (বীর বিক্রম)
৫.কর্নেল মোঃ বজলুল গনি পাটোয়ারী (বীর প্রতিক)
৬. লেঃ কর্নেল এএস এনামুল হক
৭. লেঃ কর্নেল মোঃ জয়নাল আবেদিন
৮. লেঃ কর্নেল মোঃ আব্দুল হান্নান (বীর প্রতিক)
৯. মেজর মঞ্জুর আহমেদ (বীর প্রতিক)
১০. মেজর ওয়াকার হাসান (বীর প্রতিক)
১১. মেজর মোঃ আব্দুল জলিল
১২. মেজর রফিকুল ইসলাম
১৩. মেজর মোঃ আব্দুস সালাম
১৪. মেজর একেএম রেজাউল ইসলাম (বীর প্রতিক)
১৫. মেজর মোঃ আসাদুজ্জামান
১৬. ক্যাপ্টেন জহিরুল হক খান (বীর প্রতিক)
১৭. ক্যাপ্টেন মাজহারুল হক
১৮. ক্যাপ্টেন এএসএম আব্দুল হাই
১৯. ক্যাপ্টেন ইলিয়াস (ব্রিগেডিয়ার মোহসিনের সঙ্গে রাজশাহী জেলে ছিলেন)
২০. লেঃ আবুল হাসেম।