DMCA.com Protection Status
title="৭

শহীদ জিয়া যখন স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তখন আমি তার পাশেই ছিলাম: কর্নেল অলি আহমদ।

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ  ১৯৩৯ সালের ১৩ মার্চ ডক্টর কর্নেল (অব:) অলি আহমদ বীর বিক্রম চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার বিখ্যাত কুতুব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৭ সালে নিজ উপজেলার গাছবাড়িয়া এন জি উচ্চবিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করেন।  করাচির ন্যাশনাল কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। আইনশাস্ত্র অধ্যয়নরত অবস্থায় মিলিটারি একাডেমিতে যোগদান করেন।  ১৯৬৫ সালে কমিশন প্রাপ্ত হন এবং চতুর্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করেন। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বদলী হয়ে চট্টগ্রামের ষোলশহর সিডিএ মার্কেটে অবস্থিত নবগঠিত ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করেন এবং ঐ রেজিমেন্টের প্রথম কোয়ার্টার মাস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত্রি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে সাথে নিয়ে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি সর্বপ্রথম বিদ্রোহ করেন।  তৎকালীন মেজর জিয়াকে আগ্রাবাদ এলাকা থেকে ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টারে ফিরিয়ে আনেন। চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকায় দায়িত্বে নিয়োজিত বাঙালী অফিসার ও সেনাসদস্যদের নিরাপদে হেড কোয়ার্টারে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নেন। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাকে সমগ্র চট্টগ্রাম জেলার যুদ্ধ পরিচালনার সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব দেন। পরবর্তীতে সাব-সেক্টর নির্ধারিত হওয়ার পূর্বে তিনি চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই হইতে বেলুনিয়া পর্যন্ত এলাকার সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন।  ১৯৭১ এর জুলাই মাসে তিনি একমাত্র বাঙালী অফিসার, যিনি জেড ফোর্সের প্রথম ব্রিগেড মেজর হিসাবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। সাহসী বীর যোদ্ধা হিসেবে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রথম ‘বীর বিক্রম’ উপাধি পান। ১৯৭২ সালের অক্টোবরে মেজর হিসেবে পদোন্নতি পান।  ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি পান এবং সৈয়দপুরে অবস্থানরত ২৪তম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন।

১৯৮০ সালে তিনি কর্নেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন।  রাজনীতিতে যোগদানের লক্ষ্যে ঐ বছরের ১০ই জানুয়ারি চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন। ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। রাজনৈতিক জীবনে তিনি চট্টগ্রাম ১৩ ও ১৪ আসন থেকে বহুবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং যোগাযোগ মন্ত্রণালয়সহ একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ২৬ অক্টোবর ২০০৬ সালে বিএনপি থেকে বের হয়ে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি গঠন করেন। বর্তমানে তিনি এ দলের প্রেসিডেন্ট। ২০০১ সালে তিনি লন্ডন অক্সফোর্ড ব্রুকস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল করেন এবং ২০০৩ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ক্যাম্পেইন স্টার, ওয়ার মেডেল, তমগা-ই-জং, লিবারেশন স্টার, ভিক্টরি মেডেলসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত প্রয়োজনে তিনি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। তিনি দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক।

১৯৭১ এর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহকারী এই বীর সেনানী সেই অগ্নিঝরা মার্চ মাসের বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরেন। তৎকালীন পাক সরকারের কর্মকাণ্ড দেখে তিনি নিশ্চিত ছিলেন ও বলেন, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে আগ্রহী ছিলেন না। বিধায় সময়ক্ষেপন করার জন্য পূর্বপাকিস্তানের নেতাদের সাথে আলোচনার ব্যবস্থা করেছিল, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অস্ত্র ও সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানে আনা হচ্ছিল। ২৫ মার্চ পর্যন্ত এ অবস্থা অব্যাহত থাকে।

কর্নেল অলি বলেন, ২৫ মার্চ থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত স্বাধীনতা যুদ্ধে সেনাবাহিনীর ভূমিকাই ছিল মুখ্য। ১৭ই এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠন ও ঘোষণা করা হয়।
২রা মার্চ তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এ স্থগিতাদেশ পূর্ব পাকিস্তানিদের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চের জনসভায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেন; তা হল, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এছাড়াও পরবর্তীতে তিনি অসহযোগ আন্দোলন ও হরতালের ডাক নেন। তাঁর এই ভাষণ নিঃসন্দেহে সমগ্র জাতিকে উজ্জীবিত করেছিল। ইতিমধ্যে সামরিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করে, পাকিস্তানি জেনারেলরা ২৫ মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ পরিচালনা করে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সমগ্র দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম ও গণহত্যা চালায়। ওই রাতে আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি জেনারেলদের হাতে বন্দী হন। বাস্তবতা ছিল, অন্যান্য নেতারাও জনগণকে কোনো দিক নির্দেশনা না দিয়ে, নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ভারতে চলে যান। কারণ তারা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ছিল না। তাদের জায়গায় আমি থাকলেও একই কাজ করতাম। এই সন্ধিক্ষণে পূর্বপাকিস্তানে অবস্থানরত সশস্ত্র বাহিনীর কিছু অফিসার সাহসীকতার সাথে অত্যন্ত সক্রিয় ও সময়োপযোগী ভূমিকা পালন করেন।

তিনি বলেন, ৭ই মার্চ যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হতো তাহলে অপেক্ষাকৃত কম রক্তপাতে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হতো। কারণ তখনও পাকিস্তানীরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিকে যুদ্ধের জন্য তৈরি করেন, কিন্তু বাঙালি অফিসার, সৈনিক ও জনসাধারণের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুহূর্তে তিনি নেতৃত্ব দিতে পারেননি। আমি তখন ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের প্রস্তুত সমন্বিত করি এবং ২৫ মার্চ রাতের সঙ্কটময় মুহূর্তে বিদ্রোহে প্রধান ভূমিকা পালন করি। মেজর জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং আমি তাঁর পাশে উপবিষ্ট ছিলাম।

কর্নেল অলি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য ছিল, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বর্বরতা থেকে দেশের জনগণকে রেহাই দেওয়া, বৈষম্য থেকে মুক্তি দেওয়া, সর্বোপরি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি দিয়ে গণতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠা করা এবং জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা, যা এখন ভূলুণ্ঠিত এবং আমাদের মধ্যে মুন্যুষত্ব লোপ পেয়েছে। সমগ্র দেশ আজ মিথ্যার উপর ভিত্তি করে চলছে। ৮১ বছর বয়সী এই নেতা নিজের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, মানুষ যখনই বিপদগ্রস্ত হয়, তখন আল্লাহর কাছ থেকে সাহায্য আসে। আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহ এ দেশের জনগণকে রক্ষা করবেন এবং সঠিক পথ প্রদর্শন করবেন, যা জনগণের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। মানবধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে, সমাজ দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও মাদক মুক্ত হবে, অন্যায় অত্যাচার থেকে জনগণ মুক্তি পাবে।

অসম সাহসী এ যোদ্ধা আক্ষেপ করে বলেন, সর্বপ্রথম বিদ্রোহ এবং অনেক সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। মন্ত্রী এবং এমপি হিসেবে রয়েছে জনগণের ভালবাসা ও সফলতা। সৎভাবে জীবন যাপন করেছি। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার চেষ্টা করেছি। তিনি আরো বলেন, আমি সফল যোগাযোগমন্ত্রী ছিলাম। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাগুলো আমিই প্রথম সমাধান করি এবং ১৯৯৫ সালে ভারতের ত্রিপুরা থেকে ১০ হাজার শরণার্থী বিনা চুক্তিতে ফিরিয়ে আনি। ১৯৯১ সালের ২৯ মার্চ প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে এক লাখ ২০ হাজার মানুষ মারা যায়। অত্যন্ত সফলতা ও দিবা-রাত্রি পরিশ্রমের সাথে সেনাবাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন ও বিভিন্ন দফতরের সহায়তায় তাদের দাফন সম্পন্ন, বিদ্যুৎ, পানি ও যোগাযোগব্যবস্থা পুনঃস্থাপন করি। বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবারের কাছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করি। অল্প দিনের মধ্যে মানুষকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হন। তথাপিও দীর্ঘ ৪৮ বছরে, কোনো সরকারই আমাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করেনি, আমি এখনও পর্যন্ত স্বাধীনতা বা জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে পারিনি।

কর্নেল অলি বলেন, বর্তমানে অনেকে মুক্তিযুদ্ধের ওপর বই লিখছে, কথা বলছে এবং নিজেদেরকে মুক্তিযুদ্ধের ধারক-বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। অথচ তাদের অনেকেই সেই সময় জন্মগ্রহণই করেনি, সম্মুখযুদ্ধ দেখেনি। অনেকে সেই সময় পাকিস্তানীদের অধীনে প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত ছিল। তারা নেতা-নেত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বা অনুকম্পা পাওয়ার জন্য মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিজের বাহাদুরি দেখানোর জন্য বই লিখেছেন। জাতিকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন। মিথ্যাই হল তাদের একমাত্র ভিত্তি, কারণ তারা আল্লাহ্কে ভয় পায় না।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!