DMCA.com Protection Status
title=""

চরম সংকটের সময়ও পেঁয়াজ আমদানির নামে ২০০ কোটি টাকা পাচার!!!!

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানির আড়ালে ২০০ কোটি টাকা পাচার করেছেন আমদানিকারকরা। গত আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চার মাসে দেশটি থেকে মোট ৩৪ হাজার ৮৬১ টন পেঁয়াজ আমদানির আড়ালে এ মুদ্রা পাচার হয়। দেশের শীর্ষ ৪৩ পেঁয়াজ আমদানিকারককে জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্ত শেষে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এ ব্যাপারে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। সংস্থাটি মনে করে, এসব মুদ্রাপাচারকারীকে ধরতে আরো বিশদ অনুসন্ধান প্রয়োজন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪৩ জন আমদানিকারক মোট এক হাজার ৮৩ জন সরবরাহকারীর কাছে তাঁদের পেঁয়াজ বিক্রি করেন। নিজেরা কেজিপ্রতি দুই থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ টাকা মুনাফা করেন বলে শুল্ক গোয়েন্দা কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা জানান। তবে সংস্থাটি মনে করে, একটি অসাধু ব্যবসায়ীচক্র সংকটের অজুহাতে পেঁয়াজ বিক্রিতে অতি মুনাফা করেছে।

মোট ৪৭ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর পেঁয়াজের বাজার সব সময় স্থিতিশীল রাখতে ভারত থেকে আমদানি অর্ধেক কমিয়ে অন্য দেশ থেকে আনার প্রস্তাবসহ বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। প্রতিবেদনটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ (এনবিআর) সরকারের বিভিন্ন মহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছে।

মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানির আড়ালে মুদ্রাপাচারের বিষয়ে বাংলাদেশ মিয়ানমার চেম্বারের সভাপতি এস এম নুরুল হক গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা যেখানে সুবিধা পাবেন সেখান থেকেই পণ্য আমদানি করবেন। তবে মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানির নামে মুদ্রাপাচারের বিষয়টি কতটা সত্য, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। শুল্ক গোয়েন্দারা কিসের ভিত্তিতে তাকে মুদ্রাপাচার বলছে, তা বুঝতে পারছি না। আমার ধারণা পণ্যের দাম কম দেখিয়ে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ে মুদ্রাপাচারের ক্ষেত্রে সাধারণত তা হুন্ডির মাধ্যমে পরিশোধ হতে পারে। এটার আরো বিশদ অনুসন্ধান দরকার। এ ক্ষেত্রে শুল্ক গোয়েন্দার পরিবর্তে অন্য সংস্থার মাধ্যমে তদন্ত করা যেতে পারে।’

এ বিষয়ে এনবিআর কিংবা শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কেউ কথা বলতে রাজি হননি। তবে এনবিআরের সাবেক সদস্য ও কাস্টমস কর্মকর্তা আবদুল মান্নান পাটোয়ারী কালের কণ্ঠকে বলেন, সাধারণত পণ্যের দাম কম দেখিয়ে মুদ্রা পাচার হয় অন্য পণ্যের দায় পরিশোধের জন্য। বিশেষ করে বেশি দামের পণ্যের দায় শোধ করা হয় এভাবে। পরে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে হুন্ডির মাধ্যমে টাকাটা পাঠানো হয়। মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রেও এ রকম ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। তবে শুল্ক গোয়েন্দা এর উচ্চতর তদন্ত করে সত্যিকারে কারা জড়িত তাদের বের করতে পারে। তিনি মনে করেন, একমাত্র ব্যাংকই এভাবে মুদ্রাপাচার বন্ধ করতে পারে। তারা যখন এলসি খোলে তখন পণ্যের সত্যিকার দাম যাচাই করে এলসি খুলতে পারে। তারা এটা করে না বলেই যে যেমন ইচ্ছা দাম দেখিয়ে এলসি খোলে এবং মুদ্রা পাচার করে।

প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর—এই চার মাসে মিয়ানমার থেকে মোট ৩৪ হাজার ৮৬১ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়ে আসে। এর মধ্যে আগস্ট থেকে অক্টোবর তিন মাসে আসে ২১ হাজার ৯২৯ টন পেঁয়াজ। এসব পেঁয়াজের প্রতি কেজিতে গড়ে ৩৮ টাকা পাচার হয়। আর নভেম্বরে আমদানি হয় ১২ হাজার ৯৩২ টন পেঁয়াজ। এসব পেঁয়াজে কেজিপ্রতি পাচার হয় ৯১ টাকা। সব মিলিয়ে পাচার হয়েছে অন্তত ২০১ কোটি টাকা।

মিয়ানমার থেকে আনা প্রতি টন পেঁয়াজের দাম ৫০০ মার্কিন ডলার ঘোষণা করলেও প্রকৃতপক্ষে আমদানিকারকরা প্রতি টন এক হাজার ২০০ ডলারে ক্রয় করেছেন। অর্থাৎ প্রতি টন পেঁয়াজ ক্রয়ে প্রায় ৭০০ ডলার আন্ডারইনভয়েসিং করেছেন। ফলে মিয়ানমার থেকে আমদানিকারকরা পেঁয়াজের আমদানি মূল্য ৪৪ টাকা কেজি দেখালেও বাজারে ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রয় হয়। এই আন্ডারইনভয়েসিংয়ের টাকা আমদানিকারকরা ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে হুন্ডি ও মানি লন্ডারিং করে পাঠিয়েছেন বলে মনে করছে শুল্ক গোয়েন্দা। সংস্থাটি এর বিশদ অনুসন্ধানের জন্য এনবিআরের অনুমতি চেয়েছে প্রতিবেদনে। তারা অনুসন্ধানের সূত্র ধরে জানায়, আমদানিকারকরা পেঁয়াজের কেজিপ্রতি দাম যখন ৪৪ টাকা কেজি দেখান, তখন মিয়ানমারের বাজারেই এসব পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১২০ থকে ১৫০ টাকায়।

প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায়, বাংলাদেশের মোট পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ টন। এ বছর উৎপাদন হয় ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন। চলতি বছরের ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত আমদানি হয় সাত লাখ ৮০ হাজার টন। উৎপাদন ও আমদানি মিলিয়ে দেশে পেঁয়াজের সরবরাহ ছিল ৩১ লাখ দুই হাজার টন। এর একটি অংশ পচে নষ্টে হয়ে যায়। তবে শুল্ক গোয়েন্দার অনুসন্ধান বলছে, ২০১৭ ও ২০১৮ সালের চেয়ে আমদানি কম হয়েছে বলেই পেঁয়াজের কিছুটা ঘাটতি হয়েছে। সংস্থাটির মতে, আমদানি করা পেঁয়াজের ৯৮.৫৩ শতাংশই আসে ভারত থেকে। সংকটের পর ভারতের বাইরেও কয়েকটি দেশ থেকে আমদানি শুরু হয়। এতে বোঝা যায়, ভারতের বাইরে অন্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি অব্যাহত রাখলে দেশে পেঁয়াজের দাম স্বাভাবিক থাকবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ১ থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতি কেজি পেঁয়াজ ১৭ থেকে ৩৪ টাকায় আমদানি হলেও নভেম্বরে সর্বোচ্চ ৭১ টাকা ৮৫ পয়সায় ওঠে।

ভারতের রপ্তানি বন্ধের পর মিয়ানমার থেকে আসে মোট পেঁয়াজের ৬৮ শতাংশ। এ ছাড়া মিসর থেকে সাড়ে ১৫ শতাংশ, চীন থেকে ৭ শতাংশ ও তুরস্ক থেকে ৬ শতাংশ পেঁয়াজ আসে।

শুল্ক গোয়েন্দার তদন্ত বলছে, আমদানিকারকরা মজুদ না করলেও ব্যবসায়ীরা সাময়িক সময়ের জন্য পেঁয়াজ মজুদ করেছেন। ঢাকার আড়তে সব সময় পাঁচ হাজার টন এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন আড়তে ১০ হাজার টন পেঁয়াজ মজুদ থাকে। সংস্থাটি জানায়, শীর্ষ পেঁয়াজ আমদানিকারকদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় ভীতির কারণে যাতে বাজার আরো অস্থির না হয় সে জন্য আড়তে আড়তে অভিযান পরিচালনা করা হয়নি। তবে ভবিষ্যতে এনবিআর অনুমতি দিলে সংস্থাটি বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। আমদানিকারকরা ভবিষ্যতে বাজার স্থিতিশীল রাখতে ভারতের বাইরে অন্য দেশ থেকে এলসি খুলে পেঁয়াজ আমদানি করবেন বলে শুল্ক গোয়েন্দাকে আশ্বস্ত করেছেন। তাঁরা এটাও জানান, এরই মধ্যে তাঁরা যেসব এলসি খুলেছেন, ওই পেঁয়াজও ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে আসবে এবং তাঁরা স্বল্প মুনাফায় তা বাজারে ছাড়বেন।

শুল্ক গোয়েন্দা তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। তা হলো পেঁয়াজের উৎপাদন, চাহিদা, আমদানি ইত্যাদি পর্যালোচনা করে এনবিআর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে পেঁয়াজের আমদানি ও সরবরাহ কার্যক্রম মনিটর করবে। আমদানির একক উৎসর পরিবর্তে বিভিন্ন উৎস থেকে পেঁয়াজ আমদানিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। দেশীয়ভাবে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের উৎসাহ প্রদান ও পেঁয়াজ উৎপাদনে নগদ ভর্তুকি দেয়া যেতে পারে। দেশে উৎপাদিত বছরব্যাপী পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য সংরক্ষণাগার স্থাপনের উদ্যোগ নিতে হবে। ভারতের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে মোট আমদানির অন্তত ৫০ শতাংশ অন্য উৎস থেকে আমদানির শর্ত আরোপ করা এবং আমদানিতে প্রণোদনা, বিশেষ করে সুদমুক্ত এলসির ব্যবস্থা, শূন্য টলারেন্সে এলসি, সরকার থেকে থোক বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর—এই চার মাস ভারতের বাইরে অন্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির আগাম ব্যবস্থা নেওয়া, পেঁয়াজের বাজারব্যবস্থাকে দক্ষ করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া।

প্রতিবেদনে বলা হয়, যে ৪৩ জন শীর্ষ আমদানিকারককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, তাঁরা সারা দেশের মোট এক হাজার ৮১ জন সরবরাহকারীর কাছে তাঁদের পেঁয়াজ বিক্রি করেন। এর মধ্যে টিএম এন্টারপ্রাইজ ১২৮ জন, ফারহা ইন্টারন্যাশনাল ১৮৮ জন, রিজু রিটু এনআরপ্রাইজ ৮৮ জন, সাইফুল এন্টারপ্রাইজ ৫০ জন, সুমাইয়া এন্টারপ্রাইজ ৭৪ জন, শামীম এন্টারপ্রাইজ ৪৪ জন, গোল্ডেন এন্টারপ্রাইজ ৪১ জন, বাদার্স ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ৩৪ জন, সুপ্তি এন্টারপ্রাইজ ৩৯ জনসহ অন্যরা এক থেকে ৩০ জনের কাছে তাঁদের পেঁয়াজ বিক্রি করেন। এসব পেঁয়াজ সাধারণত ৫০ থেকে ৫৫ কেজির বস্তায় আনা হয়। মোট চার ধরনের ক্রেতার কাছে আমদানিকারকরা পেঁয়াজ বিক্রি করেছেন। তাঁরা হলেন স্থলবন্দরে অবস্থিত বেচানদার বা স্থানীয় ব্রোকার, ঢাকার শ্যামবাজার ও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন পেঁয়াজের মোকাম ও আড়তদার।

শুল্ক গোয়েন্দা তাদের অনুসন্ধানে দেখেছে, পেঁয়াজের ঘাটতির সুযোগে সরবরাহ লাইনে থাকা সুবিধাভোগী অসাধু ব্যবসায়ী, বিশেষ করে বন্দরের বেচানদার, এজেন্ট, আড়তদার ও খুচরা ব্যবসায়ীরাই পেঁয়াজে অতি মুনাফা করেছেন।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!