ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ মিথ্যা মামলায় প্রায় ২বছর ধরে কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া “পঙ্গু অবস্থায়” উপনিত হয়েছেন এবং দৈনন্দিন কাজের জন্য তিনি অপরের সাহায্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন।অর্থাৎ খালেদার স্বাস্থ্যের গুরুতর অবস্থা সম্পর্কে মেডিক্যাল বোর্ডের রিপোর্ট পেয়েও তার জামিনের আবেদন নাকচ করেছে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগকে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য সম্পর্কে এই তথ্য দিয়েছিলো তার চিকিৎসার জন্য গঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের একটি মেডিক্যাল বোর্ড।
মেডিক্যাল বোর্ডের প্রতিবেদনের একটি কপি আমাদের হাতে এসেছে। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে বিএসএমএমইউয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের স্বাক্ষরিত একটি চিঠির সাথে মেডিক্যাল বোর্ডের রিপোর্টটি পাঠানো হয় ২০১৯ সালের ১১ই ডিসেম্বর।
পরদিন, অর্থাৎ ১২ই ডিসেম্বর, আপিল বিভাগ খালেদা জিয়ার জামিনের আবেদন বাতিল করে দেয়। খালেদার আইনজীবীরা তার অত্যন্ত দুর্বল এবং ভগ্ন স্বাস্থ্যের কথা তুলে ধরে ঐ জামিন আবেদনটি দাখিল করেছিলেন।
বিএসএমএমইউয়ের ঐ প্রতিবেদনে বলা হয় যে অধ্যাপক জিলান মিয়া সরকারের নেতৃত্বে গঠিত সাত সদস্য বিশিষ্ট মেডিক্যাল বোর্ড ১০ই ডিসেম্বর সত্তোরোর্ধ্ব খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে। পরীক্ষা শেষে মেডিকেল বোর্ড জানায় খালেদা জিয়ার শরীরে “রিউমাটোয়েড আর্থ্রাইটিস [সন্ধিবাত বা গাঁট-ফোলানো বাত] অত্যন্ত সক্রিয় অবস্থায় বিরাজমান, [তার] অঙ্গবিকৃতি হয়েছে অনেকখানি এবং [শারীরিক ও মানসিক] সামর্থ্যও কমেছে।”
মেডিক্যাল বোর্ডের প্রতিবেদনে বলা হয়, “বেগম জিয়ার রিউমাটোয়েড আর্থ্রাইটিস খুবই সক্রিয় অবস্থায় আছে। এটি তার একাধিক সন্ধিতে ক্ষয়সাধন করেছে। এর আগে তার উভয় হাঁটু প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এই সক্রিয় রোগ ও এর কারণে যা ক্ষতি হয়েছে, তার ফলে তিনি বর্তমানে পঙ্গু অবস্থায় আছেন এবং দৈনন্দিন কাজের ক্ষেত্রে তিনি অন্য কারও সহায়তার উপর প্রায় সম্পূর্ণই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন।”
মেডিক্যাল বোর্ডের চার সদস্যের স্বাক্ষরিত ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়, “বেগম জিয়ার ক্ষেত্রে, প্রথম দফায় প্রচলিত থেরাপির মাধ্যমে উপশম আসেনি। […] এখন পর্যন্ত রিউমাটোয়েড আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসা আগের মতোই নিম্নমানের। তার উন্নত থেরাপি প্রয়োজন। উন্নত থেরাপির সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাবসহ এর [চিকিৎসার] সম্ভাবনা, ব্যয় ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তাকে পর্যাপ্তভাবে অবহিত করা হয়েছে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী মেডিক্যাল বোর্ড তাকে উন্নত বিওলজিকস থেরাপি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞাত থেকেই মেডিক্যাল বোর্ড থেরাপি শুরু করতে প্রস্তুত আছে।”
এই “বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা”-র বিষয়টির কোন বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়নি মেডিক্যাল বোর্ড।
মেডিক্যাল বোর্ডের রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয় যে খালেদা জিয়ার ডায়বেটিস অধিকতর নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। তবে তার রক্তচাপ ও অ্যাজমা বেশ ভালোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আছে।
মেডিক্যাল বোর্ডের এই প্রতিবেদনটি অবশ্য বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষের প্রকাশ্য মন্তব্যের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। ইতিপূর্বে, বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যগত সমস্যা অত গুরুতর নয় বলে মন্তব্য করেছিল। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে বিএসএমএমইউ একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে, যেখানে অধ্যাপক জিলান মিয়া সরকার বলেছিলেন খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের কোন অবনতি হয়নি। তিনি বলেছিলেন, “[খালেদা জিয়ার] চিকিৎসা ভালোভাবেই চলছে। তিনি ঠিক আছেন। চিকিৎসা নিয়েও তিনি সন্তুষ্ট।” একই সংবাদ সম্মেলনে বিএসএমএমইউয়ের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. একে মাহবুবুল হক বলেন, “তাকে [খালেদা জিয়া] এই মুহূর্তে বিশ্বমানের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তার অবস্থার অবনতি হওয়ার কোন সুযোগ নেই।
মেডিক্যাল বোর্ডের প্রতিবেদনের ব্যাপারে বক্তব্য জানতে চেয়ে আমাদের পক্ষ থেকে অধ্যাপক জিলান মিয়া সরকারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমি কোন সংবাদমাধ্যমকেই কোন তথ্য দিতে পারবোনা, কারণ আমি খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে কথা বলার জন্য মনোনীত ব্যক্তি নই। যেই হাসপাতালে তিনি চিকিৎসা নিচ্ছেন সেই হাসপাতালের পরিচালক এই ব্যাপারে কথা বলতে পারবেন।
তবে বিএসএমএমইউয়ের পরিচালকও ফোনে কোন বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকেও খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যগত সমস্যাকে খাটো করে দেখানো হয়েছে।
গত ডিসেম্বরের শুরুর দিকে, মেডিক্যাল বোর্ড সমবেত হওয়ার এক সপ্তাহ আগে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়ার কারাগারে সহায়তার প্রয়োজন নিয়ে বিদ্রুপ করেন। তিনি বলেন, “কারাগারে খালেদা জিয়া রাজার হালে আছেন। […] পৃথিবীতে শুনিনি সাজাপ্রাপ্ত আসামির জন্য আবার কাজের বুয়া থাকে। মানুষ এমনি কাজের বুয়া পায় না, আর খালেদা জিয়ার জন্য স্বেচ্ছায় একজন কারাবরণ করেছে, খালেদা জিয়ার সেবা করার জন্য। এই বাড়তি সুবিধা পর্যন্ত তাকে দেওয়া হচ্ছে। […] পৃথিবীর কোনও দেশে এই দৃষ্টান্ত কেউ দেখাতে পারবে না যে কোনও সাজাপ্রাপ্ত আসামি তার সেবার জন্য কাজের বুয়া রাখতে পারেন। কিন্তু খালেদা জিয়া সেটা পাচ্ছেন।”
গত ১২ই জানুয়ারি তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা হাসান মাহমুদ দাবি করেন যে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ে অপরাজনীতি করছে বিএনপি, তিনি যতটুকু অসুস্থ তার চেয়ে বেশি বলে বিএনপি জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করছে।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট সম্পর্কিত দুর্নীতির অভিযোগে দণ্ডিত হয়ে কারান্তরীণ হন খালেদা জিয়া। তবে তার দুর্বল স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিএনপি বাংলাদেশের বাইরে তাকে উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে।
বিশেষ অবস্থা ও জনস্বার্থ বিবেচনায়, আমরা খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ে মেডিক্যাল বোর্ডের রিপোর্টটির একটি কপি প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সূত্রঃ নেত্র নিউজ।