ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ রাষ্ট্রমালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকের ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে কানাডায় ‘আত্মগোপনে’ থাকা জাহাজ ব্যবসায়ী গাজী বেলায়েত হোসেন (জিবি হোসেন) মিঠুর অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত সপ্তাহে কমিশন সভায় তার অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের বিষয় অনুমোদন পাওয়ার পর কমিশনের উপপরিচালক শামসুল আলমকে অনুসন্ধান কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়। দুদকের একাধিক পরিচালক দেশ রূপান্তরকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
জাহাজা ভাঙা প্রতিষ্ঠান ‘বেলায়েত নেভিগেশন’সহ দেশ-বিদেশ বেশকিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে গাজী বেলায়েত হোসেনের। বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল
ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিভোয়া) সাবেক সাধারণ সম্পাদক, কোস্টাল শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (কোয়াব) সাবেক সভাপতি ও ওয়াটার ট্রান্সপোট কো-অর্ডিনেশন (ডব্লিউটিসি) সেলের সাবেক আহ্বায়ক তিনি
গাজী বেলায়েত হোসেনের অবৈধ সম্পদের বিষয়ে জানতে চাইলে অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক শামসুল আলম গত বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নোটিস দেওয়া হবে।’ দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য গাজী বেলায়েতের কানাডার নম্বরে বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তার মোবাইল ফোন ও ভাইবারে খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
গত বুধবার দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, ‘ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ আত্মসাৎ করে বাংলাদেশি বিপুলসংখ্যক নাগরিক কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আত্মগোপন করে আছে। যে বা যারা অবৈধভাবে ব্যাংকের বা সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে এবং ওই টাকা পাচার করে বিদেশে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন, তাদের প্রত্যেককেই অপরাধের জন্য বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। ইন্টারপোলসহ আন্তর্জাতিক সব আইনি টুলস-টেকনিক প্রয়োগ করে অপরাধীদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। একই সঙ্গে কমিশন দেশ থেকে পাচার করা সম্পদ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রাখবে।’ দুদক চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমরা কিছু কিছু তথ্য পাচ্ছি। আইনি প্রক্রিয়ায় ওইসব দেশের আদালতের সহায়তায় অপরাধীদের সম্পদ জব্দ ও বাজেয়াপ্ত করে তা ফিরিয়ে আনতে কমিশন কাজ করছে।’
দুদকের এক পরিচালক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গাজী বেলায়েতের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্র্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), রাজউক, সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয় এবং অর্থপাচার ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন প্রতিরোধের কেন্দ্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে চিঠি পাঠানো হবে। পাশাপাশি কানাডা সরকারের কাছে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকুয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠানো হবে।’
কানাডাপ্রবাসী কয়েকজন বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৩০০ কোটি টাকা বা কানাডীয় ৪৬ মিলিয়ন ডলার আত্মসাতের অভিযোগ থাকা গাজী বেলায়েত বর্তমানে টরন্টোয় অবস্থান করছেন। তিনি ও তার স্ত্রী নাহিদ আক্তার টরন্টোর লেক সংলগ্ন স্কারবরো ব্লাফসের ৯১, হিল ক্রিসেন্ট, স্কারবরো, অন্টারিও এম১এম ১জে৩, কানাডা ঠিকানায় একটি বিলাসবহুল প্রাসাদ কিনেছেন, যার মূল্য কানাডীয় অর্থে আনুমানিক ১৬ মিলিয়ন ডলার বা বাংলাদেশি টাকায় ১০৪ কোটি টাকা। এ ঠিকানায় তার নামে ২০১১ সালের ৫ অক্টোবর থেকে কানাডার কেন্দ্রীয় সরকারের নিবন্ধনভুক্ত কবডেন ট্রেভেল সেন্টার ইনকরপোরেটেড নামে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ২০১৯ সালের শেষদিকে বেলায়েত এজেক্সে কানাডিয়ান মুদ্রায় প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি টাকায় যার মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৭০ কোটি টাকা) দিয়ে একটা শপিং প্লাজা কিনেছেন। টরন্টোর শহরতলিতে ‘আলট্রামার’ ব্র্যান্ডের গ্যাস স্টেশন বা পেট্রলপাম্পও রয়েছে তার। টরন্টো শহরের ৩৪৫৪ ও ৩৪৫৬ ডেনফোর্থ অ্যাভিনিউ, অন্টারিও এম১এল ১ই৩, কানাডা ঠিকানাতেই রয়েছে এ দম্পতির কলাপাতা বুফে কুজিন এবং ভাসাবি’স নাহিদ’স কালেকশন নামে দুটি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি বিপুল পরিমাণ কালো টাকা সাদা করেছেন বলেও জানিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। তারা আরও জানান, গত ১৪ জানুয়ারি দেশ রূপান্তরে ‘৩০০ কোটি টাকা মেরে কানাডায়’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখেন বেলায়েত দম্পতি। ওই সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে কানাডায় অবৈধভাবে অর্থ পাচারকারীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবিতে আন্দোলনও করছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গাজী বেলায়েত দুটি পাসপোর্টের অধিকারী। দুদক প্রথমে তার বাংলাদেশি পাসপোর্ট দিয়ে বিদেশে আসা-যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা দেয়। কিন্তু তিনি কানাডিয়ান পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। ওই অবস্থায় গত ১৮ এপ্রিল দুদকের সহকারী পরিচালক এ কে এম ফজলে হোসেন তার দুটি পাসপোর্ট নম্বর উল্লেখ করে বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেন। তারপরও তিনি বিদেশে চলে যেতে সমর্থ হন।
দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বেলায়েত বেসিক ব্যাংকের বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছেন মেসার্স বেলায়েত নেভিগেশন ও বেশ কয়েকটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে। তার মূল ব্যবসা পুরনো জাহাজ এনে ভাঙা বা স্ক্র্যাপের। এসব ঋণ নেওয়ার জন্য বেলায়েত বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু ও তৎকালীন গুলশান শাখার ম্যানেজার শিপার আহম্মেদসহ কয়েক কর্মকর্তাকে ‘বিশাল অঙ্কের’ ঘুষ দেন। জাহাজ আমদানির নামে তার চারটি প্রতিষ্ঠান বেসিক ব্যাংকের দিলকুশা শাখা থেকে ১২৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর বিপরীতে কোনো জাহাজ আমদানি করা হয়নি। এর মধ্যে রিলায়েন্স শিপিং লাইনসের নামে ১৬ কোটি, বেলায়েত নেভিগেশন কোম্পানির নামে ২৪ কোটি, এসবিআই শিপিং লাইনের নামে ১৫ কোটি, বে নেভিগেশনের নামে ৭০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে এসব প্রতিষ্ঠান ছিল বেলায়েতের ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সিঙ্গাপুর থেকে জাহাজ রপ্তানিকারক একজন বাংলাদেশি। আবার আমদানিকারকও বাংলাদেশি। কিন্তু দেশে কোনো জাহাজ আসেনি। এলসির বিপরীতে দেনা শোধ করা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে দেশ থেকে টাকা পাচার হয়ে গেছে।’ যার নেপথ্য কারিগর বেলায়েত বলে জানিয়েছেন দুদক কর্মকর্তরা।
তারা আরও জানান, রিলায়েন্স শিপিং লাইনসের স্বত্বাধিকারী জনৈক আসিফ ইকবাল ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর বেসিক ব্যাংকের দিলকুশা শাখায় একটি চলতি হিসাব খোলেন। যার শনাক্তকারী ছিল নাহিদ এন্টারপ্রাইজ নামের এক প্রতিষ্ঠান, যা বেলায়েতের স্ত্রী নাহিদের নামে। শনাক্তকারী এ প্রতিষ্ঠানটি অস্তিত্বহীন ও হিসাব পরিচালনাকারী হিসেবে আসিফ ইকবাল নামে যার কথা বলা হয়েছে তার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ২০১২ সালে ২ ফেব্রুয়ারি এই হিসাব পরিচালনাকারীকে জাহাজ কিনতে ১৬ কোটি ১২ লাখ টাকার ঋণ দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ‘অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে জাহাজ ক্রয় করার নিমিত্তে বের করে নিয়ে এই অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।’ ঋণ হিসাবটি পর্যালোচনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখেছে, এর থেকে ১৬ কোটি ৬ লাখ টাকা পে-অর্ডারের মাধ্যমে বেলায়েত নেভিগেশনের হিসাবে জমা হয়েছে।’ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বেলায়েত নেভিগেশনের মালিকানায় থাকা ‘এমভি ওয়াটার কিং’ নামের একটি জাহাজ ভাঙার কথা বলে দেশে আনা হয়। কিন্তু জাহাজটির প্রকৃত নাম ছিল এমভি নিনা। জার্মানি থেকে আনা জাহাজটি দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথে পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত হয়, যা নৌযান আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে জানানো হয়, বেসিক ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ৩০০ কোটি টাকার ঋণ ১২টি কোম্পানির নামে দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে এসএফজি শিপিং লাইন, এস রিসোর্সের শিপিং লাইন, এস সুহী শিপিং লাইন, শিফান শিপিং লাইন, এশিয়ান শিপিং লাইন, ল্যাবস এন্টারপ্রাইজ, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি, ডেল্টা সিস্টেমস লিমিটেড, ব্রাদার্স এন্টারপ্রাইজ, গ্রীন বাংলা হোল্ডিং কিয়েব ট্রেডিং এবং এম নাছিরউদ্দিন ও বাসগৃহ প্রোপাটিজ। কোম্পানিগুলো ১৭টি ব্যাংকের ২৪টি শাখা থেকে ৩৩টি প্রতিষ্ঠান ও ৮ ব্যক্তির নামে ৩০০ কোটি টাকা তুলে নেয়। এর মধ্যে একাধিক শিপিং লাইনের সঙ্গে বেলায়েতের সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
গত বছর ২৮ মার্চ পুলিশের বিশেষ শাখার কাছে দুদকের দেওয়া বেলায়েতের দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞার চিঠিতে বলা হয়, ‘বেসিক ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা থেকে অবৈধ প্রক্রিয়ায় ভুয়া ঋণের নামে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয় কমিশনে অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। এ বিষয়ে ৬১টি মামলা করা হয়েছে, যার তদন্ত চলমান। অবশিষ্ট অনুসন্ধান দ্রুত সম্পন্ন করে মামলা করার প্রক্রিয়া চলমান আছে। উক্ত অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট জিবি হোসেন তথা গাজী বেলায়েত হোসেন বেসিক ব্যাংক থেকে অবৈধ প্রক্রিয়ায় ভুয়া ঋণ হিসেবে ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পালিয়ে গেছেন। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, তিনি কানাডিয়ান পাসপোর্টের মাধ্যমে অতিসম্প্রতি দেশে ফিরেছেন এবং পুনরায় যেকোনো মুহূর্তে দেশত্যাগ করে চলে যাবেন। সুষ্ঠু অনুসন্ধান/তদন্তের স্বার্থে তার বিদেশ গমন রহিত করা প্রয়োজন।’ তার বাংলাদেশি পাসপোর্ট নম্বর বিআর ০৫০২১০৯, কানাডিয়ান পাসপোর্ট নম্বর এবি ৯৪৫৭২৭। ঢাকার ঠিকানা বাড়ি নং ২/এ, রোড নং ১১৯, গুলশান-২।
সূত্রঃ দৈনিক দেশ রুপান্তর।