ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ বলেছেন, বিডিআর বিদ্রোহের সময় আমি ব্যবস্থা নিলে আমাকেই বিদ্রোহী বলা হতো। এই কারণে ব্যবস্থা নিতে পারিনি। কারণ যখন কোন দেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকার থাকে সেখানে আমি সেনাবাহিনী প্রধান হিসাবে সরকারের একজন কর্মচারী মাত্র। ওই সময়ে চাইলেও নিজের সিদ্ধান্তে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। এই জন্য সরকারের সিদ্ধান্তের জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে।
সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে আমি বার বার তাগিদ দিয়েছি। আমার ওই সময়ের ভূমিকা নিয়ে কেউ কেউ না জেনে অনেক ভুল কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু অনেক কথা না জেনে বলা ঠিক না।
তিনি বলেন, আমি বিডিআর বিদ্রোহের ওই ঘটনা নিয়ে বই লিখছি। ইতোমধ্যে বইয়ের লেখা প্রায় শেষ পর্যায়ে। সেখানে সব ঘটনাই থাকবে। এমন অনেক বিষয় তুলে ধরবো যেই সব বিষয় মানুষ জানেন না। কারণ ওই সব ঘটনাও তুলে ধরা দরকার। এটা নিজের তাগিদ থেকেই লিখবো।
বিগত ২০১৪ সালের ১৭ই জুন নিউ ইয়র্কে তার বাসায় দেয়া তার সাক্ষাৎকারের তিনি এসব কথা বলেন। এখন তুলে ধরা হচেছ সাক্ষাৎকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
প্রশ্নঃ আপনি বলুনতো ওই ধরনের একটি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে এমন খবর আপনি আগে থেকে জানতেন না? কোন সতর্কবাণীও ছিল না?
জেনারেল মঈনঃ একেবারেই না। অন্তত আমার কাছে না। অন্য কারো কাছে থাকলেও সেটা আমার জানা নেই।
প্রশ্নঃ আপনার একজন অফিসার নাকি ওই ধরনের আশঙ্কার কথা সরকারকে বলেছিলেন এই জন্যই প্রধানমন্ত্রীর সেখানে ডিনার বাতিল হয়েছিল?
জেনারেল মঈনঃ দেখুন সেটা আমি জানি না। তবে আমি যতখানি জানি প্রধানমন্ত্রী আগেই ওই ডিনার বাতিল করেছিলেন।
প্রশ্নঃ এমনও শোনা যায়, ওই অফিসার নাকি অস্ত্র নিয়ে বিডিআরের সদর দপ্তরের ভেতরে আগের দিন প্রবেশ করেছিলেন, তাকে বাধাও দেয়া হয়েছিল, এটা কি আপনি জানেন ?
জেনারেল মঈনঃ এই ঘটনাটি ঠিক আমার জানা নেই। ওই ধরনের কোন অনুষ্ঠানে নিরাপত্তাজনিত দায়িত্বরত অফিসার ছাড়াও কেউ অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করতে পারার কথা নয়।
প্রশ্নঃ আপনি আসলে এই ব্যাপারে অনেক কথাই বলতে চাইছেন না, তাই কি?
জেনারেল মঈনঃ দেখুন আমি বইয়ে সব কথাই আমার জানার মধ্যে যা রয়েছে সব লিখবো। আর যদি আমার অফিসারদের মধ্যে ওই সময়ে কারো কাছে কোন তথ্য থাকে তারাও আমাকে দিতে পারেন। আমার কাছে যা আছে লিখবোই। এছাড়াও অন্য কারো কাছে তথ্য থাকলেও আমি সেগুলো আমার কাছে থাকা তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখব।
প্রশ্নঃ বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার তদন্ত হয়েছিল একটি সেনাবাহিনীর তরফ থেকে আরো একটি সরকারের তরফ থেকে, ওই দুটি রিপোর্ট কি পুরো প্রকাশ করবেন?
জেনারেল মঈনঃ সেনাবাহিনীর রিপোর্টটি হুবহু প্রকাশ করতে পারবো না, কারণ এটা নিয়মের মধ্যে পরবে না। এই কারণে প্রকাশ করা যাবে না। তবে ওই রিপোর্টের বেশিরভাগ তথ্যই প্রকাশিত হয়েছে।
প্রশ্নঃ সরকারী তদন্ত কমিটির রিপোর্টেতো সেনাবাহিনীর একজন অফিসার ছিলেন, তিনি রিপোর্টের সঙ্গে একমত হননি, অনেক ব্যাপারে আপত্তিও করেছেন এই জন্য ওই কর্মকর্তা রিপোর্টে স্বাক্ষর করতে চাননি। কিন্তু পরে বাধ্য হয়েছিলেন নোট অব ডিসেন্ট লিখে স্বাক্ষর করতে, তিনি বলেছিলেন, তদন্ত রিপোর্টে সব তথ্য আসেনি, অধিকতর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন, এই ব্যাপারে আপনি কি বলবেন?
জেনারেল মঈনঃ সরকারি রিপোর্টটি আমার কাছে আসেনি। তাই ওই রিপোর্টের ব্যাপারে পুরোটা বলতে পারবো না। তবে আমাদের যে অফিসার ছিলেন তিনি ওই ঘটনায় তদন্ত করেছিলেন। ওই রিপোর্টটি আমাদের কাছে আসলে আমাদের রিপোর্টের সঙ্গে কতখানি ব্যবধান তা বোঝা যেত। তবে এটাও ঠিক আমাদের রিপোর্টেতো সব দিকে তদন্ত করার সুযোগ ছিল না। সরকারি রিপোর্টে অনেক কাজ তারা করেছেন। আরো করতে পারতেন হয়তো।
প্রশ্নঃ বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হয়নি অভিযোগ বিএনপির, শহীদ কর্মকর্তাদের পরিবার পরিজনদের এই জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন এই ঘটনার পুন তদন্ত করার কথাও বলেছেন, বিচার করারও কথাও বলেছেন।
জেনারেল মঈনঃ এটা তারা চাইলে করতে পারেন।
প্রশ্নঃ সেই ক্ষেত্রে আপনাকেও হয়তো বিচারের মুখোমুখি করা হতে পারে?
জেনারেল মঈনঃ আমাকে বিচারের মুখোমুখি করার চেষ্টা করতে পারে। তবে সেই সুযোগ তেমন ভাবে নেই। কারণ আমিতো আর ওই ঘটনার জন্য দায়ী নই। অনেকেই বলার চেষ্টা করেন আমি নাকি চাইলেই ব্যবস্থা নিতে পারতাম। অফিসারদের জীবনও বেঁচে যেতে পারতো। কিন্তু এটা তারা অনেকটাই সাদামাটা হিসাবে ও সাধারন জ্ঞান থেকে বলেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো সেটা পারতাম না। কারণ সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে আমি কোন সিদ্ধান্ত নিলে আমাকে বিদ্রোহী বলা হতো। বলা হতো আমি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি। তখন আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হতো।তখন আমাকে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে ওই সময় পার করতে হয়েছে।
প্রশ্নঃ আপনি সময় মতো অভিযান চালালে, কিংবা নির্দেশ দিলে ৫৭ জন চৌকস সেনা কর্মকর্তাকে প্রাণ দিতে হতো না, এটা সেনাবাহিনীর অনেক কর্মকর্তাই মনে করেন, তারা এই কারণে আপনার উপরও ক্ষুব্ধ?
জেনারেল মঈনঃ দেখুন, আমার অফিসাররা মারা গেছে যখন জানতে পেরেছি তখন আমার অবস্থা কি হয়েছিল সেটা কাউকে বলে বোঝাতে পারবো না। তিনদিন তিনরাত আমাকে নির্ঘুম কাটাতে হয়েছে। অনেকেই ক্যান্টনমেন্ট থেকে বাইরে বের হয়ে গেছেন। আমাকেও বাইরে বের হয়ে যেতে বলা হয়েছে। না হলে আমার উপরও আক্রমণ হতে পারে তাও বলা হয়েছে তবুও আমি যাইনি। কারণ আমি আমার অন্য অফিসারদের কথাই চিন্তা করেছি। যারা আমার উপর ক্ষুব্ধ তাদের ক্ষোভটাকে আমি উপলব্ধি করি। কিন্তু তখন আমার কোন উপায় ছিল না। তারপরও দেড় ঘন্টার মধ্যে ফোর্স পাঠিয়েছি। বিডিআরের গেটে আমাদের ফোর্স যখন যায় তখন ভেতর থেকে আক্রমণ করে বিদ্রোহীরা। এতে আমাদের দুইজন মারা গেছেন। এরপর আর ওই সময়ে অভিযান চালানো সম্ভব হয়নি। এখন আর্মিতে এমন অবস্থা চাইলেই কোন অভিযান দেড়ঘণ্টার নীচে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। কারণ এগুলো সমন্বয় করার জন্য সময় লাগে। এছাড়াও আরো ——- অনেক বিষয় আছে। সেটা নিরাপত্তাজনিত কারণে প্রকাশ না করাই ভাল। এখন চাইলেও— অপারেশন চালানো সম্ভব হবে না। আমি এর চেয়ে কম সময়ে ফোর্স পাঠাতে পারতাম না।
প্রশ্নঃ আপনি ঘটনাটি কখন জানলেন?
জেনারেল মঈনঃ ওই দিন সকালে আমি কনফারেন্সে ছিলাম। ৯টা ২৫ মিনিটে আমার কাছে খবর এল বিডিআরের ভেতরে গোলমাল হয়েছিল। এটা শুনেই পাঁচ মিনিটের মধ্যে কনফারেন্স শেষ করলাম। সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় সব জায়গায় যোগাযোগ করলাম। কাকে কাকে ফোন করেছি সবার লিস্ট আমার কাছে আছে। কোন ফোন থেকে কার কার নম্বরে কথা বলেছি, কতক্ষণ কথা বলেছি, এই সব প্রমাণও পরে সংগ্রহ করেছি। তারা ফোন করার জবাবে কি বলেছেন, তাও আছে।
আমি যাদের ফোন করেছি এরমধ্যে বিডিআরের ডিজি মেজর জেনারেল শাকিলও একজন। তাকেও ফোন করলাম। তখন ৯ টা ৩৫ মিনিট হবে। তিনি আমাকে বললেন, একটু ঝামেলা হয়েছে। কয়েকজন অফিসার বাইরে উঠে গেছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে। আমি আপনাকে জানাবো। তখনও তিনি আমার কাছে কোন সাহায্য চাননি। সব ঘটনা খুলেও বললেন না। হয়তো সেই অবস্থায় ছিলেন না। তবে এরপর আমি আর তাকে যোগাযোগ করে পাইনি। ১০ টা ৩৫ মিনিটে তাকে যোগাযোগ করে কথা বলতে পারিনি। আমার ধারণা সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটের মধ্যেই তাকে ও অনান্য অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে।
প্রশ্নঃ আপনিতো জরুরি ভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছেও যেতে পারতেন?
জেনারেল মঈনঃ আমি প্রধানমন্ত্রীর ওখানে গিয়েছি। কিন্তু ওখানে এত মানুষ দেখেতো আমি অবাক। দেখি সবাই চা বিস্কিট খাচ্ছে। তখন আমার মনে হলো এটা ঠিক না। কারণ ওই সময়ে সবাই ঘটনা শুনে সেখানে ছুটে গেছেন এমন হতে পারে। কিন্তু ওই সময়ে প্রধানমন্ত্রীকে একা করে দিলে ভাল হতো। তিনি আরো দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। নিয়ম হচ্ছে যখন কোন বিপদ হয় তখন যিনি সিদ্ধান্ত নেন তাকে একা করে দিতে হয় চিন্তা করার জন্য। এরপর তিনি সংশ্রিষ্ট মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও বাহিনী প্রধানদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন।
আমি প্রধানমন্ত্রীকে পুরো বিষয় জানিয়েছি। সিদ্ধান্ত নিতেও সহায়তা করেছি। তবে একটা কথা কি সেনাবাহিনী কোন জায়গায় ততক্ষণ পর্যন্ত অভিযান চালাতে পারে না যতক্ষণ না সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারেন।
প্রশ্নঃ এবার একুট ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি,ওয়ান ইলেভেনের সরকারের সময়ে আপনি নাকি বিএনপি চেয়ারপারসনকে জোর করে বিদেশে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলেন? কেন?
জেনারেল মঈনঃ আমি সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে জোর করে বিদেশ পাঠিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র ও এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে কোন ভাবে সম্পৃক্ত ছিলাম না। তাকে বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা চলছে এমন খবর যখন আমি পেয়েছি তখন প্রকৃত ঘটনা জানার চেষ্টা করেছি। আমাকে বলা হয়েছে তিনি বিদেশে চলে যেতে চাইছেন। কিন্তু গণমাধ্যমে খবর এল তিনি বিদেশে যেতে চান না এবং সৌদি আরবও তার শরীরে উপস্থিতি ছাড়া ভিসা দিবে না। এটা জানার পর আমি এটাও বলেছি, আপনারা যারা তাকে জোর করে বিদেশে পাঠাতে চাইছেন এটা ঠিক করছেন না। তাকে বিদেশে পাঠাবেন না। তার ইচ্ছের বাইরে কোন কাজ করা যাবে না। তিনি যাতে কোন ধরনের অসম্মানিত না হন।
প্রশ্নঃ তার মানে কি ওই সরকারের সব কিছুই আপনি জানতেন না?
জেনারেল মঈনঃ আমি একটা গন্ডির মধ্যে ছিলাম। ওই সময়ের সরকার অনেক কিছুই তারা তাদের মতো করেছে। আমাদের সঙ্গে আলোচনারও প্রয়োজন মনে করেননি। তারা যে কাজ করতেন আমরা বাধা দেইনি। পরে জেনেছি ওই সময়ে অনেক কিছুই আমার নাম করে আমার অজান্তে হয়েছে। অর্ডার দেই বা না দেই বলা হতো স্যারের নির্দেশ। কিন্তু বাস্তবতা ছিল, সেটা জানতামই না। শুনেছি আমি করতে বলেছি এমন সব কথা বলেও অনেক কাজ করা হয়েছে। তবে আমি এটা বলতে পারি বিএনপি চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠানোর জন্য কাউকে নির্দেশ দেইনি।
প্রশ্নঃ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিদেশে থেকে দেশে ফেরত আসতেওতো বাধা দিয়েছিলেন, এটা কেন করেছেন?
জেনারেল মঈনঃ দেখুন, তাকে বিদেশ থেকে দেশে ফেরত আসতে না দেয়ার কথা যদি আমি ইংল্যান্ড সরকারকে বলি তাহলে ইংল্যান্ড সরকার আমার কথা শুনবে? নাকি আমাদের সরকারের কেউ তা বললে শুনবে। আমি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত আসতে দিবো না এমন কোন আদেশ দেইনি। যারা কাজটি করেছেন তারা খারাপ করেছেন। বরং তিনি যখন ফিরতে পারছিলেন না তখন আমি বলেছি যত দ্রুত সম্ভব তাকে দেশে ফেরত আনার ব্যবস্থা করেন। ২৪ ঘন্টার মধ্যে তিনি যাতে দেশে আসতে পারেন সেই জন্য সব ব্যবস্থা করা হয়। সেই হিসাবে প্রয়োজনীয় সবাইকে নির্দেশ দিয়েছি।
প্রশ্নঃ আপনি কোন নির্দেশই দেননি এই সব কথা মানুষ বিশ্বাস করবেন না, ভাববেন যে আপনি এখন বেশ গুছিয়ে মিথ্যে কথা বলছেন?
জেনারেল মঈনঃ কেউ কিছু ভাবলে সেটা নিয়ে আমার বলার কিছুই নেই। সেই ভাবনায় পরিবর্তন আনাও সহজ হবে না। তবে আমি যেটা বলছি সেটাই সত্য। কেউ প্রমাণ করুক যা বলছি তা সত্য নয়।
প্রশ্নঃ শোনা যায়, ওয়ান ইলেভেনের সময়ে আপনার সঙ্গে একটি বৈঠক করার মূল্য ছিল কোটি কোটি টাকা?
জেনারেল মঈনঃ আমাকে কেউ কোনদিন টাকা দিয়ে বৈঠক করেননি। তবে এটা শুনেছি আমার সঙ্গে একটি বৈঠক করার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করতে চাইতেন যারা দুর্র্নীতি করেছেন তাদের কেউ কেউ। আমি যখন নিউইয়র্কে আসি ওই সময়ে তখন দেশের একজন ব্যবসায়ী আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য হন্যে হয়ে চেষ্টা করেছেন। এই জন্য কয়েক কোটি টাকাও খরচ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি সফল হননি। পরে তার সম্পত্তি ক্রোক হয়েছে, বাড়ি পর্যন্ত ক্রোক হয়েছিল। শাস্তিও হয়েছিল। তারপরও একবারের জন্য দেখা করতে পারেননি তিনি। আরও কেউ কেউ চেষ্টা করেছেন। আমার নীতি ছিল এটাই যে যারা দুর্নীতির জন্য তালিকাভুক্ত ও অভিযুক্ত হয়েছেন তাদের কেউ, তাদের পরিবারের কেউ কিংবা তাদের তরফের কেউ আমার সঙ্গে কোন বৈঠক করতে পারবেন না।
আমার সিনিয়র স্যার কর্নেল অলি আহমেদ নাকি বলেছেন, আমাকে কারা কারা টাকা দিয়েছিলেন, আমি স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি স্যার যদি এর কোন প্রমাণ দিতে পারেন তাহলে আমি এই ব্যাপারে ব্যবস্থা নেব। তাছাড়াও আমাকে টাকা দিয়ে গেছেন স্যার যদি প্রমাণ দিতে পারেন তাহলে দ্বিগুণ টাকা ফেরত দিবো। আসলে এই কথাটি আমি এত জোর দিয়ে এই জন্য বলতে পারি যে, আমাকে কেউ কোন টাকা দিতে পারেনি। আমার সঙ্গে কোন দুর্নীতিদায়গ্রস্ত ব্যক্তিদের কেউ দেখা করতে পারেননি। অনেকেই বলে, আমি নাকি কোন কোন দুর্নীতিবাজকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছি। এটা সম্পূর্ণ ভুল। কেবল এটাই নয় অনেকেই বলেন, আমি নাকি দুই নেত্রীকে মাইনাস করতেও বলেছি।
প্রশ্নঃ দুই নেত্রীকে মাইনাস করার সিদ্ধান্ত নাকি আপনারই ছিল?
জেনারেল মঈনঃ দুই নেত্রীকে মাইনাস করার সিদ্ধান্ত আমার ছিল না এটা প্রথম কথা। আর দ্বিতীয় কথা হলো তাদের মতো নেত্রীকে মাইনাস করার কোন ক্ষমতাই আমার নেই। তাদেরকে জনগণ নেতা বানিয়েছেন। সেখানে তাদের দল রয়েছে। তাদের ব্যাপারে তারাই সিদ্ধান্ত নিবেন নেতা কে থাকবেন না থাকবেন। আমি বললে কিংবা আমার বলাতেই কিবা আসে যায়। আর তৃতীয়ত হলো আমি এই ধরনের কোন কথা বলিনি। বিশেষ করে তাদের কোন রাজনীতিবিদ বলতে পারবেন না আমি দুই নেত্রীকে মাইনাস করতে বলেছি। বাংলাদেশে এমন কোন রাজনীতিবিদ নেই যার সঙ্গে আমার এই সব বিষয়ে কথা হয়েছে। বরং এটা শুনেছি যে, উল্টো অনেক নেতাই নাকি আগ বাড়িয়ে তাদের নেত্রীদের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। ওই সময়ের সরকারকে বলতেন তাদের নেত্রীদের বিরুদ্বে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। তারা নিজেরাও দল করতে চাইতেন। তবে এগুলো নিয়ে আমার সঙ্গে কোন কথা হয়নি।
প্রশ্নঃ ওই সময়ে আপনার নির্দেশেই অনেকেই কিংস পার্টি গঠন করেন এবং দুই নেত্রীকে মাইনাস করার ফর্মুলার অংশ হিসাবে দেশে নতুন নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়?
জেনারেল মঈনঃ নতুন নতুন পার্টি হয়েছে এটা সত্য। কিন্তু যারা ওই সময়ে পার্টি করেছেন তাদের একজন বলতে পারবেন না আমি তাদেরকে পার্টি করতে বলেছি। তারা পার্টি করার জন্য উদগ্রীব ছিলেন বরং নিজেরা সুবিধা নেয়ার জন্যই নিজ উদ্যোগে পার্টি করেছেন। তাদের কি উদ্দেশ্য ছিল এটাতো আপনারা সবাই দেখেছেন। যদি তাই হতো তাহলে তারা অনেকেই নির্বাচন করে জয়ী হতে পারতেন। তাদের অবস্থা দেখেই বোঝা উচিত। এটা নিয়ে আমি কিছুই বলতে চাই না।
প্রশ্নঃ ওই সময়ের ঘটনাবলী নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন, আর কি কোন বই লিখছেন?
জেনারেল মঈনঃ এখনও এই ব্যাপারে আগাম বলতে পারছি না। ওই সময়ে আমার বইয়ে অনেক কথাই লিখেছি। এখন বিডিআরের বিদ্রোহের বইটি নিয়েই ব্যস্ত আছি। বেঁচে থাকতেই বইটি প্রকাশ করতে চাই।
প্রশ্নঃ আচ্ছা বলুনতো আপনারতো সেনাবাহিনীতে সেনাপ্রধানের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল এরপর আবার চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে ছিলেন কেন?
জেনারেল মঈনঃ আমি চাকরিতে আমার মেয়াদ বাড়াইনি। এই জন্য প্রেসিডেন্টকে কোন অনুরোধও করিনি। বরং প্রেসিডেন্টই চেয়েছিলেন আমি যাতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন, গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজটি সম্পন্ন করতে সরকারকে ও তাকে সব ধরনের সহায়তা করি। এই জন্যই তিনি আমার চাকরির মেয়াদ বাড়িয়েছিলেন। আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। একটি অবাধ নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার ব্যবস্থায় সম্পৃক্ত ছিলাম। ওই নির্বাচনটি ছিল আন্তর্জাতিক মানের একটি নির্বাচন। নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন। এই জন্য বিভিন্ন দেশ থেকেও প্রশংসা মিলেছে।
প্রশ্নঃ আপনার ২০০৯ সালের নির্বাচন আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন, আর ২০১৩ সালের নির্বাচনতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন এটাকে কিভাবে দেখছেন?
জেনারেল মঈনঃ আমি মনে করি দেশের যে কোন নির্বাচন অবাধ, সষ্ঠু , নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়া উচিত। জনগনের সম্পৃক্ততা থাকা উচিত। আমাদের নির্বাচন ছিল বিশ্বমানের। ওই নির্বাচন নিয়ে কেউ আপত্তি করেনি। এটা ঠিক। এবার দেশে ছিলাম না তাই দেখতে পারিনি। মিডিয়ার সুবাধে যতটুকু জেনেছি। এই নির্বাচন নিয়ে কে কে বলছে সেটাও দেখছি । আমি আশা করি বাংলাদেশ ২০০৯ সালে যে নির্বাচনের উদাহরণ তৈরি করেছে ওই উদাহরণের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা দরকার।
প্রশ্নঃ আপনি যখন ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি, তখন দেশে দশ ট্রাক অস্ত্র আসার ঘটনা ঘটে এই বিষয় আগাম তথ্য পাননি?
জেনারেল মঈনঃ আমি তখন জিওসি ছিলাম। জিওসিরি দায়িত্ব সেনাবাহিনীর ভেতরে। বাইরে কি হচ্ছে না হচ্ছে এই সংক্রান্ত বিষয়ে গোপন খবর রাখা নয়। এই জন্য ওই সময়ে দেশে যে অস্ত্রের চালান আসছে এটা আমি আগাম জানতে পারিনি। তাছাড়াও আমাদের আরো অনেক কাজ আছে। নিয়ম হচ্ছে এই সব ব্যাপারে খবর রাখবেন গোয়েন্দারা, পুলিশ। এছাড়া নদী পথের জন্য কোস্টগার্ড রয়েছে। তাদেরই খবর রাখার কথা। কিন্তু আমি কেন জানলাম না এই জন্য অনেক কথা বলা হয়েছে। অনেকই বলে আমি নাকি ঘটনা আগেই জানতাম। আমাকে জানানো হয়েছিল, এগুলো ঠিক নয়। আমাদের এখতিয়ারের মধ্যে এটা পরে না। তাছাড়া ঘটনা যেখানে ঘটেছে সেখান থেকে আমার অফিস অনেক দূরে। আমরা যদি বাইরে ওই সব ব্যাপারে খবর রাখতে যাই তাহলে বলবে সেনাবাহিনী না জানি কি করছে।
তবে নিয়মের বাইরে গেলে বলতে হয় দেশে যখন এত বড় অস্ত্রের চালান আসে সেটার আগাম তথ্য আমরা কোন কারণে পেলে ব্যবস্থা নিতে পারতাম। একজন সেনাবাহিনীর জিওসির কতখানি কি এখতিয়ার আছে এটাও সবার জানা উচিত। ওই অস্ত্র আসার খবর আমাদের কাছে আসলে সংশ্লিষ্টদের আমরা জানাতে পারতাম। সেটা পারিনি।
প্রশ্নঃ আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?
জেনারেল মঈনঃ আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনার একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে দেশে যাওয়ার বিষয়টি। সেখানে গেলে আবার নতুন করে মানুষের জন্য কিছু করবো। তবে যাওয়া হবে কিনা এটা নিয়ে আমি নিজেই সন্দিহান। এখন চিকিৎসার মধ্যে রয়েছি। যত দিন বেঁচে আছি ততদিন থাকতে হবে। ছয় বছর পর আবারও বোন মেরু ট্রান্সপ্লানটেশন করা হবে। ওই সময়ে বাঁচার কোন সম্ভাবনা আছে কিনা জানি না। সাধারণত দ্বিতীয় বার এই ধরনের চিকিৎসায় কেউ বাঁেচ না। আমি বেঁচে গেলে সেটা হবে মিরাকেল। সেই রকম কোন কিছু হলে আবার কিছু করতে পারবো, না হলে না।
দেখুন আমি অসুস্থ এটা নিয়েও কত কথা উঠেছে। বলে আমি নাকি ঢং করছি। ভঙ্গি করছি। আমার অসুখ হয়নি। বিদেশে থাকার জন্য এমন করছি। বিদেশে থাকতে হলেতো এমনিতেই থাকতে পারবো এই জন্য ঢং করার কিংবা ভঙ্গি করার দরকার আছে? সেটারতো কোন প্রয়োজন নেই। তাছাড়া একজন সুস্থ মানুষে কেমন করে চার বছর ধরে টানা ঢং করতে পারে। আরো অনেক কথা অনেকেই বলে। সেই সব কথাও কানে আসে। এখানে আমি খুব ঘনিষ্ঠজন ছাড়া কারো সঙ্গে মিশিনা। কারো দাওয়াতেও যাই না। কোন মিডিয়াতেও কথা বলি না। শান্তিপূর্ন ভাবে থাকতে চাই। কোন আলোচনায় থাকতে চাই না। এই জন্য সবাইকে এড়িয়ে চলি। এটা নিয়ে বলে আমি নাকি বাইরে গেলে আমাকে মানুষ আক্রমণ করবে, মানুষ আমাকে দেখতে পারে না আরো কত কিছু। এই সব নিয়ে এখন আর ভাবি না।
প্রশ্নঃ শোনা যায়, আপনার দেশের বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন?
জেনারেল মঈনঃ এই কথাটিও ঠিক নয়। আমার বাড়ি এখনও আছে। সেটা বিক্রি করিনি। দেশে ফিরে যেতে হবেতো। আর বেঁেচ থাকলে বাড়ি যাওয়ার পর সেখানেই উঠবো। বাড়ি বিক্রি করার কোন পরিকল্পনা নেই।
প্রশ্নঃ আচ্ছা আপনার বিরুদ্ধে সাবেক এক প্রতিমন্ত্রী মামলা করেছিলেন, সেটার কি অবস্থা?
জেনারেল মঈনঃ ওই মামলা চলছে। ওই মামলাটি উচ্চ আদালতে নিস্পত্তির জন্য ছিল। কিন্তু নিম্ম আদালতে চলবে এমন নির্দেশের কারণে এখনও চলছে। তবে ওই মামলায় বাদী যে অভিযোগ করেছেন, সেটা তিনি না করলেই পারতেন। আদালতের বিচারধীন বিষয় বলে কোন কথা বলতে চাই না।
প্রশ্নঃ শোনা যায় বিএনপি আগামীতে কখনো ক্ষমতায় আসতে পারলে ওয়ান ইলেভেনের ঘটনা ঘটানোর জন্য ও বিএনপি চেয়ারপারসন, তারেক রহমান, বিএনপি নেতাদের উপর নির্যাতন করার কারণে ও দুর্নীতি বিরোধি অভিযানের কারণে আপনার বিরুদ্ধে আরো ব্যাপক সংখ্যায় মামলা করবে?
জেনারেল মঈনঃ তারা মামলা করলে তো করতেই পারেন। তবে সেই সব মামলায় আমাকে আসামি করেও কোন লাভ হবে না। কারণ আমি এই সবের কোনটি নিজে করিনি। যারা করেছেন তাদেরকেই দায় নিতে হবে। আমি কি করেছি সেটাতো আমি ওয়ান ইলেভেন নিয়ে নিজের লেখা বইয়েই লিখেছি।