DMCA.com Protection Status
title="৭

ইন্টারপোলের সাহায্যে ৭০ ব্যাংক লুটেরাকে ফেরত আনতে দুদকের উদ্যোগ।

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ  বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল পরিমান অর্থ আত্মসাৎ করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৭০ আসামীকে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফেরত আনার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

তাদের মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বহিষ্কৃত হিসাবরক্ষক আবজাল হোসেন, তার স্ত্রী রুবিনা খানম ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদারসহ আটজনের অবস্থান ও বিস্তারিত তথ্যসহ ইন্টারপোলকে ইতিমধ্যেই চিঠিও দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ গতকাল মঙ্গলবার নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ আত্মসাৎ করে যারা কানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে গেছে তাদের মধ্যে সাত-আটজনকে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিস ইস্যু করার অনুরোধ পাঠানো হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘অর্থ আত্মসাৎ করে বিদেশে পলাতক থাকা আসামিদের মধ্যে আমরা ৬০-৭০ জনের নামের তালিকা প্রস্তুত করেছি। পর্যায়ক্রমে সবার বিষয়ে রেড নোটিস ইস্যু করে ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাদের ফেরত আনা হবে।’ ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘কাদের নামে রেড নোটিস ইস্যু করার চিঠি দেওয়া হয়েছে আমরা এই মুহূর্তে তাদের নামগুলো প্রকাশ করতে চাই না।

কারণ এতে তারা স্থান পরিবর্তন করে ফের আত্মগোপনে চলে যাবে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে প্রভাবশালী বা রাজনৈতিক পরিচয় বলতে কিছু নেই। আমরা দেখি ব্যক্তির অপরাধ। সে যদি অপরাধ করে থাকে তাহলে সে মন্ত্রী হোক বা এমপি হোক আমাদের কাছে বিবেচ্য নয়। দেশের অর্থ আত্মসাৎ করে সরকারি সম্পদ আত্মসাৎ করে বিদেশে আয়েশি জীবনযাপন করবে সেটা হবে না।’

যাদের নামে রেড নোটিস ইস্যুর জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে দুদক চেয়ারম্যান তাদের নাম প্রকাশ না করলেও দুদকের বিভিন্ন সূত্র আটজনের মধ্যে সাতজনের নাম দেশ রূপান্তরকে নিশ্চিত করেছেন। তারা হলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বহিষ্কৃত হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল হোসেন, তার স্ত্রী রুবিনা আক্তার, শেয়ারবাজার, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগ থাকা এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার, বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা মোসাদ্দেক আলী ফালু, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে জড়িত আইএফআইসি ব্যাংকের সাবেক পরিচালক লুৎফর রহমান বাদল, বেসিক ব্যাংকের সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলাম ও সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হুমায়ুন কবির।

দুদক থেকে কোনো তালিকা পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে কি না জানতে চাইলে ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো-এনসিবি-ইন্টারপোল শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মহিউল ইসলাম  বলেন, ‘আমরা দুদক থেকে এরকম কোনো চিঠি এখনো পাইনি। হয়তো পাব। পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’

 অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুদক ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনার জন্য যাদের নামে চিঠি দিয়েছে তাদের মধ্যে আবজাল-রুবিনা দম্পতি বর্তমানে আছেন অস্ট্রেলিয়ায়। দুদকের তথ্য অনুযায়ী, আবজাল বেতনভাতা পেতেন সব মিলিয়ে ৩০ হাজার টাকা। অথচ তাদের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ আছে। ঢাকার উত্তরায় এ দম্পতির পাঁচটি বাড়ি, অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে একটি বাড়ি, দেশের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ২৪টি প্লট ও ফ্ল্যাট আছে। এর বাইরে দেশে-বিদেশে আছে বাড়ি-মার্কেটসহ অনেক সম্পদ। আবজাল-রুবিনার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ করেছে দুদক।

পিকে হালদার বর্তমানে কানাডায় আছেন। তিনি মাঝেমধ্যে সিঙ্গাপুর ও ভারতে যাতায়াত করেন। তার বিরুদ্ধে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা অর্থ পাচারসংক্রান্ত তদন্ত ও অনুসন্ধান করছে দুদক।  গত ৮ জানুয়ারি তার বিরুদ্ধে ২৭৪ কোটি ৯১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৫ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক।  মামলার এজাহারে কমিশন তার যেসব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বিবরণ উল্লেখ করেছে, সেগুলো জব্দ করা হয়েছে। আরেক আসামি বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা মোসাদ্দেক আলী ফালু বর্তমানে দুবাই আছেন। তিনি ও তার স্ত্রী মাহবুবা সুলতানার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে দুদক। তার বিরুদ্ধে ১৭ কোটি ৮৬ লাখ ৬৮ হাজার ৩৯৮ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০১৭ সালের ১৫ মে মামলা করেন দুদকের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম। একই বছরের ১০ আগস্ট তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ৩ কোটি ৯৩ লাখ ৮৮ হাজার ৪৭২ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করা হয়। ভালুকায় খাসজমি দখলসহ কয়েকটি অভিযোগেও ফালুর বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক।

বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রে আত্মগোপনে থাকা অন্য আসামি শেয়ারবাজার কারসাজির অন্যতম হোতা ও আইএফআইসি ব্যাংকের সাবেক পরিচালক লুৎফর রহমান বাদলের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের ২৮ মে দুদকের উপপরিচালক শেখ আবদুস সালাম বাদী হয়ে রমনা থানায় মামলা করেন। পরদিন ২৯ মে তার স্ত্রী সোমা আলম রহমানের নামেও রমনা থানায় মামলা করা হয়। দুদক তাদের স্থাবর-অস্থাবর ২৫৩ কোটি টাকার দালিলিক সম্পত্তি জব্দ করেছে। বেসিক ব্যাংকের সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলাম কানাডায় আত্মগোপনে আছেন। বেসিক ব্যাংকের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে দুদক যে ৫৪টি মামলা করেছে তার অধিকাংশ মামলাতেই আসামি কাজী ফখরুল। হলমার্ক কেলেঙ্কারির অন্যতম হোতা সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হুমায়ুন কবিরও বর্তমানে কানাডায়। মালয়েশিয়ায়ও তার সেকেন্ড হোম আছে।

দুদকের বিভিন্ন মামলা ঘেঁটে প্রায় ৭০ জনের ওই তালিকায় আরও যাদের নাম পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে আছেন জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আবদুল আজিজ। তার বিরুদ্ধে জনতা ব্যাংক থেকে ক্রিসেন্ট গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান রিমেক্স ফুটওয়্যারের নামে ৯৯৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পাচারে অভিযোগ আছে। তিনি কানাডায় আছেন। তালিকায় আছেন যুবলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান, মোস্তফা গ্রুপের কর্ণধার হেফাজুতুর রহমান, ঢাকা ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী টিপু সুলতান, বেসিক ব্যাংকের শান্তিনগর শাখার সাবেক প্রধান ও মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, অটো ডিফাইনের মালিক ওয়াহিদুর রহমান ও তার স্ত্রী, বিসমিল্লাহ গ্রুপের এমডি খাজা সোলায়মান আনোয়ার চৌধুরী, তার স্ত্রী ও গ্রুপের চেয়ারম্যান নওরিন হাবিব, বিসমিল্লাহ গ্রুপের পরিচালক ও খাজা সোলায়মানের বাবা সফিকুল আনোয়ার চৌধুরী, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আকবর আজিজ মুতাক্কি, মহাব্যবস্থাপক আবুল হোসেন চৌধুরী, ব্যবস্থাপক রিয়াজউদ্দিন আহম্মেদ, নেটওয়ার্ক ফ্রেইট সিস্টেম লিমিটেডের চেয়ারম্যান আক্তার হোসেন এবং জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা মোস্তাক আহমদ খান ও এসএম শোয়েব-উল-কবীর।

তালিকায় আরও রয়েছে টিঅ্যান্ড ব্রাদার্সের পরিচালক তসলিম হাসান ও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান জিনাত ফাতেমা, হলমার্ক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান অ্যাপারেল এন্টারপ্রাইজের মালিক শহিদুল ইসলাম, স্টার স্পিনিং মিলসের মালিক আবদুল বাছির, ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের মালিক মীর জাকারিয়া, সেঞ্চুরি ইন্টারন্যাশনালের মালিক জিয়াউর রহমান, আনোয়ারা স্পিনিং মিলসের মালিক জাহাঙ্গীর আলম, নকশী নিটের এমডি আবদুল মালেক ও সাভারের হেমায়েতপুরের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জামালউদ্দিন সরকার। তালিকায় আছেন ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের (বর্তমান আইসিবি ইসলামী ব্যাংক) সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহ মোহাম্মদ হারুন ও আবুল কাশেম আহমদ উল্লাহ, সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ফজলুর রহমান ও মাহমুদ হোসেন, নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট কামরুল হোসেন, উপব্যবস্থাপক ইমামুল হক ও ব্যবসায়ী আবু বকর।

সূত্রঃ দৈনিক দেশ রুপান্তর।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!