দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ প্রতিবেদনঃ বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি বিএনপির নেতাকর্মীদের কাছে স্বপ্নের মতো। স্বপ্ন বললে ভুল হবে- অনেকটাই ফ্যান্টাসি। কারণ তাদের বাস্তব ভাবনা, এমনকি কল্পনার সীমাহীন যে জগৎ সেখানেও, খালেদা জিয়ার এমন মুক্তির ছবি আঁকা ছিলো না। যদিও বিএনপি নেত্রীর মুক্তির পর এখন উদ্ভট, অবাস্তব যুক্তি ও ব্যাখ্যা দিচ্ছেন দলটির অনেক নেতাকর্মী।
আইরিশ নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেট কিংবা ব্রিটিশ নাট্যকার হ্যারল্ড পিন্টারের মতো কেউ থাকলে, হয়তো খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে অ্যাবসার্ড নাটকের নতুন কোনো প্লট তৈরি হতো। আর সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতো হলে তো কথাই ছিলো না, বিএনপি নেতাকর্মীদের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে মনোজগতের নতুন কোনো তত্ত্ব দিতেন, যা কিনা কালের বিবর্তনে মনোবিজ্ঞানের সীমা ছাড়িয়ে রাজনীতির উদাহরণ হয়ে উঠতে পারতো।
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে বিএনপি, মামলা-হামলা আর নানামুখী নির্যাতন নিপীড়নে বিপর্যস্ত নেতাকর্মীরা। হতাশা নিরাশা গ্রাস করেছে বিএনপি’র কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে। খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে সোচ্চার থাকলেও স্বাভাবিকভাবেই এমন মুক্তি প্রত্যাশিত ছিল না বিএনপি’র কাছে।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারির পর থেকে নেত্রীর মুক্তির জন্য নানা ঘাটের জল খেয়েছে বিএনপি। সভা-সমাবেশের পাশাপাশি লিফলেট বিতরণ আর গণ-স্বাক্ষর সংগ্রহের মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করেছে দলটি। এমনকি জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপেও অগ্রাধিকার তালিকায় ছিল খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি। যদিও সরকার বরাবরই বলেছে এ মামলা আদালতের বিষয়, রাজনৈতিক কোনো ইস্যু নয়।
কিন্তু, বিষয়টি শেষ পর্যন্ত আদালতে সুরাহা হয়নি। আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাজপথের আন্দোলন ব্যর্থ হলে নেত্রীর মুক্তির দাবিতে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করে দলটি। বিদেশিরা ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও, দৃশ্যমান কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়নি, হয়তো সেটি সম্ভবও নয় তাদের পক্ষে।
গত বছরের মাঝামাঝি হঠাৎ করেই আলোচনায় আসে খালেদা জিয়ার প্যারোল প্রসঙ্গ। কিন্তু শুরু থেকেই প্যারোলের ব্যাপারে রাজি ছিলেন না বিএনপি চেয়ারপারসন। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, যারাই প্যারোলের প্রস্তাব নিয়ে তার কাছে গেছেন তাদের সঙ্গেই দুর্ব্যবহার করেছেন খালেদা জিয়া। রাজনীতির মাঠে যখন তুঙ্গে প্যারোল আলোচনা, তখন খালেদা জিয়ার সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করেন বিএনপির ৬ এমপি। প্রসঙ্গ তুলতেই ব্যাপক তোপের মুখে পড়েন তারা। সব কিছুই যখন ব্যর্থ; তখন খালেদা জিয়ার মুক্তির উদ্যোগ নেন তার স্বজনরা।
রাজনৈতিক নানা ক্যারিকেচারে শেষ পর্যন্ত স্বজনদের বিশেষ উদ্যোগে সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে সাময়িক মুক্তি পান বিএনপির চেয়ারপারসন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এমন মুক্তিতে কি ইমেজ সংকটে পড়েছেন খালেদা জিয়া? প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎ কিংবা মানবিক কারণে মুক্তি প্রক্রিয়ার কিছুই জানতেন না তিনি? জানলে প্রধানমন্ত্রীর সদয় বিবেচনায় মুক্তির বিষয়টিতে কি সায় ছিলো বিএনপি চেয়ারপারসনের? নাকি তাকে না জানিয়ে পরিবারই ঠিকঠাক করেছে সবকিছু? এসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো জানা যাবে আরো কিছুদিন পর। তবে দলের ভেতরে-বাইরে অনেকেই মনে করেন, বয়স আর রাজনীতির মারপ্যাঁচে এখন অনেকটাই ম্লান হয়েছে খালেদা জিয়ার ‘আপোষহীন ভাবমূর্তি’।
রাজনৈতিকভাবে যেহেতু মুক্তি নিশ্চিত হয়নি, তাই বিএনপির কিছু নেতা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলছেন, এমন মুক্তি নাকি খালেদা জিয়ার সঙ্গে মানায় না। প্রশ্ন জাগতেই পারে, খালেদা জিয়ার এমন মুক্তিতে দল হিসেবে বিএনপির ভাবমূর্তি কতটা বেড়েছে, নাকি কমেছে হাজার গুণ? এ কথাতো দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে খালেদা জিয়ার মুক্তিতে বিএনপি’র বিন্দুমাত্র ভূমিকা নেই। বিএনপি যাদেরকে এমপি-মন্ত্রী বানিয়েছে কিংবা জায়গা করে দিয়েছে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম- স্থায়ী কমিটিতে তারা কিছুই জানতেন না এ মুক্তির বিষয়ে।
নেত্রীর মুক্তির পর দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারণে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের ভেতরে কি রক্তক্ষরণ হচ্ছে? মনে যন্ত্রণা হচ্ছে ভীষণ? অনুতাপ- অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছেন প্রতিনিয়ত? যদি হয়েও থাকেন, সেসব প্রকাশের সাধ্য নেই তাদের। কারণ, খালেদা জিয়া নয়, ইমেজ সংকটে পড়ছে বিএনপি।
যদিও খালেদা জিয়াকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে বিএনপির সামগ্রিক রাজনীতি। তারপরও, প্রশ্নে জাগতে পারে, খালেদার মুক্তির দাবিতে একসময়কার ভ্যানগার্ড হিসেবে পরিচিত ছাত্রদল-যুবদল কতটা সফল রাজপথে? নির্বাচিত ৬ এমপি কিংবা ৩’শ আসনের বিপরীতে এমপি প্রার্থীরা কতটা সোচ্চার ছিলেন রাজপথে? স্থায়ী কমিটি, ভাইস-চেয়ারম্যান কিংবা উপদেষ্টারা কতখানি সম্পৃক্ত ছিলেন মুক্তির মিছিলে?
সময়ের পরিক্রমায় হয়তো এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজবেন খালেদা জিয়া। সাংগঠনিক দায়বদ্ধতা থাকলে আসবে জবাবদিহিতার প্রশ্নও। কারণ হুইল চেয়ারে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িতে ওঠা, এমনকি গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় পৌঁছানো পর্যন্ত অনেক নেতাই সালাম দিয়ে খালেদা জিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন, একবারের জন্যও ফিরে তাকাননি তিনি।
খালেদা জিয়ার স্বজনরা বলে থাকেন, প্রচণ্ড জেদের পাশাপাশি শিশু সুলভ মনোভাব আছে তার, আছে একটা সম্মোহনী শক্তিও। হয়তো সে কারণেই মুক্তির দিন প্রিয় নেত্রীকে এক নজর দেখার আশায় কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় ছুটে এসেছেন ৬৭ বছরের এক বৃদ্ধ বিএনপি সমর্থক। আর এসব মানুষই হচ্ছে বিএনপির প্রাণভোমরা-খালেদা জিয়ার শক্তির উৎস, সু-সময়ের ‘দুধের মাছিরা’ নয়।
সূত্রঃ যমুনা টেলিভিশন।