ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ করোনা মহামারী মোকাবেলায় গার্মেন্টস মালিকরা সরকারের কাছে চেয়েছিল প্রণোদনা, কিন্তু তাদেরকে দেওয়া হচ্ছে ঋণ। এই ঋণের টাকা গার্মেন্টস মালিকদের শোধ দিতে হবে ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জসহ। সরকারের এমন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছেন না গার্মেন্টস মালিকরা। তাই সরকারের কাছ থেকে ফের প্রণোদনা নেওয়ার কৌশল হিসেবে সাধারণ ছুটির মধ্যেও গার্মেন্টস কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে গার্মেন্টস মালিকরা। বেশ কয়েকজন গার্মেন্টস সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
এদিকে রবিবার (৫ এপ্রিল) থেকে পোশাক কারখানা খুলে দেওয়ার খবরে রাস্তাগুলোতে শ্রমিকদের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গাজীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে, টাঙ্গাইলে বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে, নারায়ণগঞ্জে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে, শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ফেরিতে হঠাৎ করে মানুষের ঢল দেখা গেছে। বিভিন্ন অঞ্চলের পোশাক কারখানার কর্মমুখী মানুষ পিকআপ, ট্রাক, ভ্যানগাড়িতে করে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকার উদ্দেশে ছুটছেন। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় অনেকে মহাসড়কে পায়ে হেঁটে গন্তব্যে রওনা হয়েছেন।
যখন করোনা ভাইরাসের কারণে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে, করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে যখন মানুষজনকে ঘরে রাখার জন্য সরকার সব ধরনের চেষ্টা করে যাচ্ছে, এমন সময় রাস্তায় শ্রমিকদের ঢল দেখে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা রকম প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
তবে গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমএইর সভাপতি রুবানা হক বলছেন, রাস্তার সব শ্রমিক গার্মেন্টস শ্রমিক নয়। যে কারণে গার্মেন্টস মালিকদের দায়ী করা ঠিক হবে না। কারণ, ২৫ মার্চ গণপরিবহন বন্ধ হয়েছে। আর আমরা ২৬ মার্চের পর গার্মেন্টস বন্ধ করেছি। আর আমাদের অধিকাংশ শ্রমিক কারখানার আশে পাশে থাকে। কাজেই সংক্রমণ বাড়ানোর জন্য গার্মেন্টস খোলা হচ্ছে না। তিনি উল্লেখ করেন, করোনার সংক্রমণ ঠেকানো আমাদের প্রথম কথা। দ্বিতীয়ত শ্রমিকদের মার্চ মাসের বেতন নিয়ে কোনও রকম অনীহার সুযোগ নেই। তৃতীয়ত, শ্রমিক যদি কোনও কারণে উপস্থিত না থাকেন, তাহলে মানবিক বিবেচনায় তার চাকরিটি যেন থাকে। বিজিএমইএর সব সদস্যের কাছে এই অনুরোধ আমি করবো।
তিনি বলেন, কলকারখানা এবং পরিদর্শন অধিদফতর আমাদের যে সার্কুলার দিয়েছিলেন তাতে বলা আছে, যেসব রফতানি মুখী প্রতিষ্ঠানে অর্ডার আছে এবং উৎপাদন চলমান আছে, সেসব কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য নিরাপত্তা একেবারে সুনিশ্চিতকরণ সাপেক্ষে শিল্প কলকারখানা চালু রাখতে পারে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত।
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক গার্মেন্টস মালিক বলেন, বেতন পেতে হলে শ্রমিককে আগামী কালকের মধ্যে অফিসে আসতে হবে- এমন নির্দেশনার পর প্রত্যন্ত গ্রামে চলে যাওয়া শ্রমিকরা দল বেঁধে ঢাকা আসছেন। তিনি বলেন, কারখানা বন্ধ করার সময় ধারণা করা হয়েছিল, শ্রমিকরা কারখানার আশপাশে থাকবে। কিন্তু ১০ দিন ছুটি পাওয়ার পর অধিকাংশই গ্রামে চলে গেছে। বিষয়টি সরকার জানে, গার্মেন্টস মালিকরাও জানে।
তবে একটি বড় গ্রুপের কর্ণধার বলেন, তার কারখানার যেসব শ্রমিক ছুটি পেয়ে গ্রামে গেছে, তাদের তালিকা করা হবে। গ্রামে যাওয়া শ্রমিকদের তালিকা করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। ধারণা করা হচ্ছে, অধিকাংশ কারখানার অন্তত ৩০ শতাংশ শ্রমিক ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে।
গার্মেন্টস মালিকদের বক্তব্য হলো- এমনিতেই রফতানির বিপরীতে তৈরি পোশাক কারখানার মালিকরা বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা পেয়ে থাকেন। কেউ ৪ শতাংশ প্রণোদনা পান, কেউ ৬ শতাংশ প্রণোদনাও পেয়ে থাকেন।
একজন গার্মেন্টস মালিক জানান, আগামীকাল যারা কারখানায় আসবে না, তারা বেতন পাবে না এমন ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ার কারণে গ্রামে যাওয়া শ্রমিকরা ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় আসছেন। তবে এতে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে তার ধারণা।
কেন ঝুঁকি নিয়ে গার্মেন্টস কারখানা খোলা হচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বেতন কিন্তু শ্রমিকদের ব্যাংক হিসেব বা মোবাইল ব্যাংক হিসেবে চলে যাবে। কাজেই বেতন বিষয় নয়। বিষয় হলো- প্রণোদনা । তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, গার্মেন্টস মালিকদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে প্রণোদনা চাওয়া হয়েছিল। সরকার প্রধান ঘোষণাও দিয়েছিলেন প্রণোদনার। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক যে সার্কুলার জারি করেছে, তাতে বলা হয়েছে, ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে আমরা ঋণ পাবো ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে। এটা প্রণোদনা নয়। কারণ, ঋণের টাকা ফেরত দিতে হবে। এই দুর্যোগকালীন মুহুর্তে এই ধরনের ঋণ চাইছিলাম না। চাইছিলাম প্রণোদনা, যা ফেরত দিতে হবে না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ২ শতাংশ ইন্টারেস্ট দিয়ে ঋণ নিতে হবে।
তিনি উল্লেখ করেন, আগামীকাল প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন হওয়ার কথা রয়েছে। ওই সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে গার্মেন্টস খাতের জন্য অফেরতযোগ্য একটি প্রণোদনার ঘোষণা আশা করছেন এই খাতের নেতারা। যে প্রণোদনায় কোনও সার্ভিস চার্জ দিতে হবে না। এর আগে গত ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রাণঘাতী করোনার প্রতিঘাত মোকাবিলায় দেশের রফতানিমুখী খাতের শ্রমিকদের বেতন দিতে ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এদিকে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির সঙ্গে সমন্বয় রেখে গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ রাখার যে নির্দেশনা নেওয়া হয়েছিল, তা বাতিল করেছে নিট তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ। গত ২ এপ্রিল গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়। সংগঠনটি জানায়, ৪ এপ্রিলের পর থেকে কারখানা মালিকরা প্রতিষ্ঠান খুলতে পারবেন, কোনও বিধি নিষেধ থাকছে না।
সংগঠনের সদস্যদের উদ্দেশে বলা হয়, ৪ এপ্রিলের পর থেকে কারখানা খুলবেন কিনা তা একান্তই আপনাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। কারখানা খুললে সেক্ষেত্রে অবশ্যই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের রক্ষা করার জন্য সকল স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে শ্রমিকের সব ধরনের দায়-দায়িত্ব মালিকদের।
কারখানার মালিকদেরকে আরও বলা হয়, কারখানা পরিচালনাকালীন সময়ে যেমনভাবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে চলতে হবে, তেমনি ছুটির পরে ফ্যাক্টরি খোলার সময় অবশ্যই শ্রমিক-কর্মকর্তাসহ সকলের মেডিক্যাল চেকআপ করতে হবে। তাদের কোনও রোগ না থাকার বিষয়টি সুনিশ্চিত হয়ে তবেই ফ্যাক্টরিতে প্রবেশ করতে দিন। পাশাপাশি তাদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।