ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কোনাবাড়ী অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন দেলোয়ার হোসেন। দীর্ঘদিন ধরেই সুনামের সঙ্গে চাকরি করে আসছিলেন। কোনো বাধা বা অদৃশ্য শক্তির কাছে মাথানত করেননি। নিয়মের মধ্যে থেকেই সবাইকে সহযোগিতা করতেন তিনি।
ঠিকাদাররা ফাইল ছাড়িয়ে নিতে নিয়মিত ঘুষ সাধতেন দেলোয়ার হোসেনকে। কিন্তু তিনি তা ফিরিয়ে দিতেন। এ নিয়ে অনেকের বিরাগভাজন হন দেলোয়ার। তাকে ওএসডি পর্যন্ত করা হয়েছিল। আর সৎ থাকাই যেন কাল হলো এ প্রকৌশলীর। সম্প্রতি রাজধানীর তুরাগ এলাকায় তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পর গাজীপুরে তোলপাড় শুরু হয়। থানায় মামলা হওয়ার পর র্যাবসহ বিভিন্ন সংস্থা ছায়া তদন্ত শুরু করলে চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকান্ডের রহস্য বের হয়ে আসছে। ঘুষের বিনিময়ে শতকোটি টাকার কাজের ফাইল ছাড়তে রাজি না হওয়ায় নিজ গাড়িচালকের সহায়তায় প্রকৌশলী দেলোয়ারকে হত্যা করা হয়েছে বলে তদন্ত সংস্থাগুলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে।
গতকাল রবিবার সকালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়-৭-এ গেলে প্রকৌশলী দেলোয়ারের মৃত্যুর বিষয়ে অধিকাংশ কর্মকর্তাই কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন ভালো লোক ছিলেন। অন্যায় তদবির ও অন্যায় কাজকে তিনি পছন্দ করতেন না। যার কারণে তার কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয় অনেকে। এজন্য তাকে খুন করতে হবে সেটা তারা মেনে নিতে পারছেন না।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, খুবই ঠান্ডা মাথায় খুনিরা দেলোয়ার হোসেনকে হত্যা করেছে। আর এ কাজে সহায়তা করেছে দেলোয়ারের গাড়িচালক। দেলোয়ার হত্যায় ইতিমধ্যে একজন প্রকৌশলী ও চালকসহ বেশ কয়েকজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে একটি সংস্থা। তবে তদন্তের স্বার্থে আটককৃতদের পরিচয় জানাতে চাচ্ছে না সংশ্লিষ্টরা। চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটনে মাঠে কাজ করছে পুলিশ, র্যাব, পিবিআই ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশসহ কয়েকটি সংস্থা।
তদন্তকারী কর্মকর্তারা প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছেন যে, ঘটনার দিন গাড়িচালক এক রিকশাওয়ালার মোবাইল ফোন থেকে কল করে দেলোয়ারকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যায়। এ হত্যাকান্ডের জন্য অন্তত কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে বেশ কয়েকজন ঠিকাদারকে নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছেন, শতকোটি টাকার ফাইল ছাড়াতে ঘুষ লেনদেন না করায় দেলোয়ারকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পেছনে কয়েকজন প্রভাবশালীও জড়িত।
তদন্তকারী সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘টেন্ডারসংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকা-টি ঘটেছে। দেলোয়ার হোসেন একজন সৎ কর্মকর্তা ছিলেন। ঘুষ তাকে কাবু করতে পারেনি। প্রাথমিক তদন্তে নিশ্চিত হয়েছি, খুনিরা দীর্ঘদিন ধরে খুনের পরিকল্পনা করে।’
পরিবারের সদস্যরাও অভিযোগ করেছেন, কয়েক মাস ধরে ঠিকাদারদের সঙ্গে ঝামেলা চলছিল দেলোয়ারের। ওইসব ঠিকাদার খুবই প্রভাবশালী। তাদের সঙ্গে মেয়রসহ জিসিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সুসম্পর্ক ছিল। হত্যাকান্ডের পরের দিনই একটি সংস্থার কাছে নিহতের স্ত্রী খাদিজা আক্তার এসব বিষয়ে অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেছেন, এসব গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত বিনা কারণে গাজীপুর সিটি করপোরেশন থেকে দেলোয়ার হোসেনকে ওএসডি করে রাখা হয়। পরে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তাকে বদলি করা হয় কোনাবাড়ী অঞ্চলে। ঠিকাদাররা বিভিন্ন ফাইল নিয়ে আসত তার কাছে। ওইসব ফাইলে হিসাব-নিকাশে আকাশপাতাল পার্থক্য থাকত। ১০ টাকার কাজ ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা দেখানো হতো। আর এসব কারণে তিনি ফাইলে কোনো স্বাক্ষর করতেন না। তাছাড়া ফাইল ছাড়িয়ে নিতে মোটা অঙ্কের ঘুষের প্রস্তাবও দেওয়া হতো তাকে। কিন্তু তার স্বামী ওইসব প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতেন।
একটি তদন্ত সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘দেলোয়ার হোসেনকে ওএসডি করার পেছনে ঠিকাদারদের হাত রয়েছে। অভিযুক্ত কিছু ঠিকাদারের সঙ্গে মেয়রসহ অনেক কর্মকর্তার সুসম্পর্ক আছে। তদন্ত করে আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে, সিটি করপোরেশনের কোনাবাড়ী অঞ্চলের ঠিকাদারদের কাজের পাওনা শতকোটি টাকার একাধিক ফাইল আটকা রয়েছে। আর ওইসব ফাইল তদন্ত করে ঠিকাদারি কাজে গাফিলতি পেয়েছে সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখা। ফাইলগুলো দেলোয়ার হোসেনের টেবিলে আটকা পড়ে আছে। ঠিকাদারদের একটি চক্র ফাইল ছাড়পত্র দেওয়ার জন্য তার কাছে বেশ কয়েকবার তদবির করে। ঘুষের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু দেলোয়ার কোনো অবস্থাতেই ঘুষ নেবেন না বলে জানিয়ে দেন। এসব বিষয় নিয়ে মেয়রের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকও করেন তিনি। তাতেই দেলোয়ারের সঙ্গে ঠিকাদারদের প্রকাশ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। আর হত্যাকান্ডের পেছনে এসব কারণ রয়েছে।’
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘খুনিরা দেলোয়ারের গাড়িচালককে ম্যানেজ করেছে। গত ১১ মে গাড়িচালক তার মিরপুরের বাসার সামনে গিয়ে নিজের মোবাইল থেকে ফোন না দিয়ে এক রিকশাওয়ালার ফোন থেকে কল দিয়ে বলে, স্যার আজকে গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। আপনার জন্য অন্য একটি গাড়ি রাখা আছে। পরে তিনি চালকের কথামতো বাসা থেকে বের হয়ে যান।
আমাদের ধারণা, ওই গাড়িতেই খুনিরা আগ থেকেই বসা ছিল। গাড়ির ভেতরেই তাকে হত্যা করে তুরাগ এলাকায় ফেলে দেওয়া হয়। হত্যাকান্ডের মোটিভ মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে গেছে। বেশ কয়েকজন ঠিকাদারকে নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। শিগগির খুনিদের গ্রেপ্তার করা হবে।’
থানা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, পরিকল্পিতভাবেই দেলোয়ারকে হত্যা করা হয়ছে। প্রাথমিক তদন্তে একটি সংস্থা তিনজনকে শনাক্ত করেছে। আর তাদের গ্রেপ্তার করতে পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থা অভিযান চালাচ্ছে।
লাশ উদ্ধারের পর দেলোয়ার হোসেনের স্ত্রী বাদী হয়ে রাজধানীর তুরাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়। ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মো. শফিউল আলম বলেন, ‘হত্যার রহস্য উদঘাটনে ইতিমধ্যেই তার বাসা, আশপাশের লোকজন ও দপ্তরের অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আশা করছি শিগগিরই হত্যার রহস্য উদঘাটন সম্ভব হবে।’