ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ করোনাভাইরাস মহামারীতে পণ্য রপ্তানিতে ধস নামার পর এবার আমদানিও নেমেছে তলানিতে; যা বিনিয়োগে বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যার ফল হবে কর্মসংস্থান কমে যাওয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল মাসে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য মাত্র ১৬০ কোটি (১.৬ বিলিয়ন) ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খুলেছেন ব্যবসায়ীরা।
এই অঙ্ক গত বছরের এপ্রিল মাসের চেয়ে ২৬৮ শতাংশ কম। আর গত মাসের চেয়ে কম ২৬৩ শতাংশ।
গত বছরের এপ্রিল মাসে ৫২৬ কোটি (৫.২৬ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। আর গত মার্চ মাসে এলসি খোলা হয়েছিল ৪৯৭ কোটি ডলারের।
গত মার্চ মাসেই করোনাভাইরাস মহামারীতে দেশে দেশে লকডাউন ঘোষণার পর বিশ্বের অর্থনীতিতে নেমে আসে স্থবিরতা। এই পরিস্থিতি বিশ্বকে আরেকটি মহামন্দার দিকে টেনে নিচ্ছে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ শেষ কবে এক মাসে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল, তা মনে করতে পারছেন না বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক কাজী ছাইদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সামগ্রিক পরিস্থিতির কারণেই এলসি খোলার পরিমাণ তলানীতে নেমেছে।
“কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে এপ্রিল মাসে গোটা বিশ্বই অবরুদ্ধ ছিল। ওষুধ ও রমজানকে সামনে রেখে কিছু প্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্য কোনো পণ্যের জন্য এলসি খোলেননি কেউ। পোশাক শিল্পের কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারি, শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামালসহ অন্য সব পণ্য আমদানির এলসিও ওপেন হয়নি। সে কারণেই এই করুণ অবস্থা।”
‘অশনি সঙ্কেত’
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর আমদানি কমে যাওয়াকে অর্থনীতির জন্য ‘অশনি সঙ্কেত’ মনে করছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আমদানির এই দৈনদশার প্রভাব পড়বে বিনিয়োগে। এমনিতেই বেশ কিছুদিন ধরে বিনিয়োগে স্থবিরতা চলছিল; জিডিপির ৩১/৩২ শতাংশে আটকে ছিল। এখন ভবিষ্যতে বিনিয়োগের অবস্থা আরও খারাপ হবে।
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, আমদানি কমা মানে বিনিয়োগ কমে যাওয়া। আর বিনিয়োগ কমা মানে কর্মসংস্থান কমে যাওয়া।
“সবকিছু মিলিয়ে বড় ধরনের সঙ্কটের মুখে পড়েছি আমরা। বিনিয়োগে অশনি সঙ্কেত আসছে। সে কারণেই আমি বার বার বলছি, সামনে শুধুই অনিশ্চয়তা।”
কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা না থাকার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, “আর পরিস্থিতি ভালো হলেই যে মানুষের আগের মত ক্রয়ক্ষমতা থাকবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
“দীর্ঘদিন সবকিছু বন্ধ থাকার কারণে কাজকর্ম নেই। মানুষের হাতে টাকা না থাকলে চাহিদা বাড়বে না; আমদানিও বাড়বে না। তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, এপ্রিল মাসে ১ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে। গত বছরের এপ্রিলে এই অঙ্ক ছিল ৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। আর গত মার্চে এলসি নিষ্পত্তির পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার।
এ হিসাবে এপ্রিল মাসে গত বছরের এপ্রিলের চেয়ে এলসি নিষ্পত্তি কম হয়েছে ৬২ শতাংশ। আর মার্চ মাসের চেয়ে কম ৫৩ শতাংশ।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনে গত বছর ডিসেম্বরে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর বিভিন্ন দেশ সেখান থেকে কাঁচামাল আনা বন্ধ করে দেয়। এরপর অন্যান্য দেশে প্রাণঘাতী এই নতুন ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে বিশ্বের যোগাযোগ ব্যবস্থাই হয়ে পড়ে অচল। তার প্রভাব পড়ে পণ্য আমদানি ও এলসি খোলায়।
খালাস না হওয়ায় বন্দরে জমেছে পণ্যঃ
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশ থেকে মোট ৫৫ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি।
চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত আমদানির তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে অর্থাৎ জুলাই-জানুয়ায়ী সময়ে ৩২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ কম।
এদিকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, গত এপ্রিল মাসে বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি করে মাত্র ৫২ কোটি ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ।
এই একই মাসে ১০৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি যে রপ্তানি আয় রেমিটেন্সের চেয়ে কম হয়েছে।
গত এপ্রিল মাসে রপ্তানি আয় গত বছরের এপ্রিলের চেয়ে ৮২ দশমিক ৮৫ শতাংশ কম। গত বছরের এপ্রিলে রপ্তানি হয়েছিল ৩০৩ কোটি ৪২ লাখ ডলার।