ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ অবশেষে কুয়েতে জনশক্তি ব্যবসায় গুরুতর অনিয়ম এবং মানবপাচারে হাজার কোটি টাকার কারবারে অভিযুক্ত বাংলাদেশের অবৈধ সংসদ সদস্য কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল গ্রেপ্তার হয়েছেন। শনিবার রাতে কুয়েতের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট সিআইডি তাকে আটক করে।
দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এস এম আবুল কালাম রোববার দুপুরে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, সংসদ সদস্যের আটকের বিষয়টি সকালে জেনেছি। বর্তমানে সিআইডি হেফাজতে রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে কী অভিযোগ আনা হয়েছে, তাকে পুরোপরি গ্রেপ্তার না-কী জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে তা জানতে দূতাবাসের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবর চিঠি পাঠিয়েছি। সন্ধ্যায় দ্বিতীয় দফায় আলাপকালেও রাষ্ট্রদূত বলেন, চিঠির জবাব এখনও আসেনি, তবে এমপি মহোদয় সিআইডি হেফাজতেই আছেন এটা নিশ্চিত।
লক্ষীপুর-২ আসনের এমপি পাপুল বহু বছর ধরে কুয়েতে ব্যবসা করেন। তার কাজ কারবার নিয়ে বহু দিন ধরে কুয়েতের সংবাদ মাধ্যম সরব। আরবি এবং ইংরেজি উভয় ভার্সনের সংবাদ মাধ্যমেই তার কর্মকাণ্ড ছাপা হয়েছে। অবশ্য সেখানে তার ইঙ্গিতপূর্ণ বর্ণনা ছিল। তিনি এবং তার স্ত্রী দু’জনই যে বাংলাদেশের পার্লামেন্টের এমপি সেটি উল্লেখ করে কুয়েতের সংবাদ মাধ্যমে গত ফেব্রুয়ারিতে তার কুয়েতের কর্মকাণ্ড নিয়ে সিরিজ রিপোর্ট হয়।
মানবপাচারে হাজার কোটি টাকার কারবারে অভিযুক্ত ওই এমপি কুয়েতের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট সিআইডির অভিযানের মুখে দেশটি ত্যাগ করেন বলেও তখন রিপোর্টে উল্লেখ ছিল। মানবপাচারকারী সিন্ডিকেটগুলোর বিরুদ্ধে কুয়েত সরকারের সাঁড়াশি অভিযান বিষয়ে দেশটির সংবাদ মাধ্যমগুলোর রিপোর্টের বরাতে দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ সহ বহু সংবাদপত্র খবরটি ছেপেছিল। তখন পাপুল এ কাজে তার সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার এবং কুয়েতি প্রতিবেদনে সরাসরি তার নাম উল্লেখ নেই দাবি করে খোদ পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে দিয়ে এসব ‘ফেক নিউজ’ বলে প্রচার করানোর চেষ্টা করেছিলেন। যদিও কুয়েতি সংবাদ মাধ্যম তাদের রিপোর্টের ওপর শেষ পর্যন্ত অনড় ছিলো।
ওই নিউজের পর ঢাকায় ঘোষণা দিয়ে কুয়েতে ফিরেছিলেন মারাতিয়া কুয়েতি গ্রুপ অব কোম্পানীজ এর সত্বাধিকারী কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল এমপি। মার্চ থেকে তিনি দেশটিতে অবস্থান করছেন বলে বাংলাদেশ দূতাবাস এবং কমিউনিটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
তার বিরুদ্ধে যত অভিযোগঃ
কুয়েতি সংবাদ মাধ্যমে সেই সময় বাংলাদেশি এমপির ব্যবসা পেতে বিলাসবহুল গাড়ি উপহার দেয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশিত হয়েছিল। বলা হয়েছিলে- অর্থপাচার, মানবপাচার ও ভিসা জালিয়াতির অভিযোগে বাংলাদেশি ওই এমপির বিরুদ্ধে তদন্ত চালু করেছে কুয়েতের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। একই অভিযোগে অপর এক বাংলাদেশি নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কুয়েতের গণমাধ্যম আরবটাইমসঅনলাইন দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছিল। তবে তারা এ-ও বলেছিল- বাংলাদেশি এমপির বিষয়ে প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করে কুয়েতের দৈনিক আল-কাবাস। তারা জানায়, অজ্ঞাত এক বাংলাদেশিকে অর্থ ও মানবপাচার এবং ভিসা জালিয়াতির অভিযোগ গ্রেপ্তার করে কুয়েতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
গ্রেপ্তার হওয়া ওই ব্যক্তি তিন ব্যক্তি নিয়ে গঠিত একটি চক্রের সদস্য ছিলেন। চক্রের বাকি দুই সদস্য কুয়েত ছেড়ে পালিয়েছেন। এদের মধ্যে একজনের পরিচয় হিসেবে বলা হয়েছে, তিনি সম্প্রতি বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্য হয়েছেন। অপর একজনকে ‘এস’ নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনি ইউরোপে পালিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতিবেদন অনুসারে, অভিযুক্তরা কুয়েতের তিনটি বড় প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে গৃহকর্মী হিসেবে ২০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি শ্রমিককে কুয়েতে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এসব শ্রমিকদের কুয়েতে পাঠানোর বিনিময়ে ৫ কোটি কুয়েতি দিনার বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকার বেশি নিয়েছেন।
আরবটাইমসঅনলাইন জানায়, সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, অভিযুক্তদের একজন সম্প্রতি বাংলাদেশের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। দেশের একটি বড় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যও তিনি। প্রায়ই তিনি কুয়েতে যাতায়াত করেন। তবে সেখানে কখনোই ৪৮ ঘণ্টার বেশি অবস্থান করতেন না। ফেব্রুয়ারির রিপোর্টে বলা হয়- এক সপ্তাহ আগে তার বিরুদ্ধে সিআইডির তদন্ত চালু হওয়ার তথ্য জানতে পারেন তিনি। এরপর সঙ্গে সঙ্গেই কুয়েত ছাড়েন তিনি। তার প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম স্থগিত করে দেয়া হয়েছে। তিনি যে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বে ছিলেন, সেটির কর্মীদের পাঁচ মাসের বেশি সময় ধরে কোনো বেতন দেয়া হচ্ছে না। উপরন্তু, বাংলাদেশ থেকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে সরকারি চুক্তির আওতায় কুয়েতে শ্রমিক নিতেন তিনি। তদন্তে বের হয়ে আসে, ভিসা জালিয়াতি করে ওই শ্রমিকদের কুয়েতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। চুক্তিতে তাদের নির্ধারিত বেতনের চেয়ে কম বেতন দেয়া হতো তাদের। সূত্র আরো জানিয়েছে, অভিযুক্ত তিন ব্যক্তি বাংলাদেশে ভিসা জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত বলে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে সিআইডি কর্মকর্তারা। আরো জানিয়েছে, বাংলাদেশে তাদের বড় ধরনের নেটওয়ার্ক রয়েছে। তাদের হয়ে কাজ করেন অনেক কর্মী। তদন্তে আরো বের হয়ে আসে, গড়পড়তা শ্রমিক প্রদানের জন্য ওই নেটওয়ার্কের প্রতি কর্মীকে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ২০০ দিনার করে পরিশোধ করা হয়। অন্যদিকে, ড্রাইভার ভিসা বিক্রি করা হয় ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩০০০ দিনার করে।
বাংলাদেশের সংসদে স্বামী-স্ত্রী দুজন একত্রে থাকা একমাত্র এমপি পাপুল। তাছাড়া কুয়েতে জনশক্তি ব্যবসায়ীও তিনিই একমাত্র এমপি। তার প্রোফাইল এবং নির্বাচন কমিশনে দেয়া হলফনামা ঘেটে দেখা যায়, নির্বাচনী হলফনামায় তিনি পেশা ‘ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বা আন্তর্জাতিক ব্যবসা দেখিয়েছেন। তার প্রোফাইল বলছে, কুয়েত ছাড়াও জর্ডান, ওমানে লোক পাঠান তিনি। কুয়েত আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষক দাবিদার কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল জাতীয় নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবে আপেল প্রতীকে নির্বাচন করেন। তার সহধর্মীনি সংরক্ষিত আসনের একজন সদস্য।
যা বলেছে কুয়েতের সংবাদ মাধ্যমঃ
কুয়েতের প্রতিষ্ঠিত সংবাদ মাধ্যম আল-কাবাস ফেব্রুয়ারি মাসে প্রচারিত মানবপাচার বিষয়ক তাদের একাধিক প্রতিবেদনে জানায়- বাংলাদেশি ওই এমপি সাম্প্রতিক সময়ে কুয়েতে একজন মার্কিন বাসিন্দার সঙ্গে আর্থিক অংশীদারিত্ব গড়ে তোলেন। কুয়েতে আয় করা বেশিরভাগ অর্থই তিনি আমেরিকা পাঠিয়ে দিয়েছেন। সূত্রের বরাতে আল কাবাসের খবরে জানানো হয়- প্রাথমিক পর্যায়ে কুয়েতের একটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সুপারভাইজার হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। পরবর্তীতে নিজেই প্রতিষ্ঠানটির একজন অংশীদার হয়ে ওঠেন। এরপর আর তার পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজের মতো করে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করতে শুরু করেন। ওই এমপি কুয়েতে এমন বেশকিছু টেন্ডার কেনেন, যেগুলো লাভজনক ছিল না। সেগুলো কেনার উদ্দেশ্য ছিল, চুক্তিগুলোর আওতায় কুয়েতে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী নেয়া। এসব কর্মী নেয়ার মাধ্যমে আয় করা অর্থ দিয়েই ওই টেণ্ডারগুলোর অর্থায়ন করতেন তিনি। অবৈধভাবে আয় করতেন ব্যাপক অর্থ। বাংলাদেশি শ্রমিক নেয়ার জন্য কুয়েতে তার প্রতিষ্ঠানটি যেন সরকারি চুক্তি পায় সেজন্য সরকারি কর্মকর্তাদের ৫টি বিলাসবহুল গাড়ি উপহার দিয়েছিলেন। আল কাবাসের প্রতিবেদনের বরাতে আরব টাইমসও জানায়, অভিযানের মুখে কুয়েতত্যাগী এমপির সঙ্গে সুলতান নামের অপর মানবপাচারকারী ছিল। সেও কুয়েত থেকে পালিয়েছে। তবে সুলতানের নিজের প্রতিষ্ঠানের উচ্চ-পদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। এক রিপোর্টে বলা হয়- ওই এমপি বাংলাদেশ থেকে বিপুল অর্থের বিনিময়ে সেখানে শ্রমিক নেন। এজন্য বহু দালালের ব্যবহার করেন তিনি। এসব কর্মকাণ্ডে প্রাপ্ত অর্থ কুয়েতের বাইরে একটি ব্যাংক একাউন্টে জমা রাখেন তিনি।
এমপি পাপুল কুয়েতে গ্রেপ্তার, লক্ষ্মীপুরে মিশ্র প্রতিক্রিয়াঃ
আমাদের লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি জানান, লক্ষ্মীপুর-২ রায়পুর আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল কুয়েতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তার সংসদীয় আসনের নেতাকর্মীরা। তার বিরুদ্ধে কুয়েতে মানবপাচারে হাজার কোটি টাকার কারবারের অভিযোগ উঠে ছিল চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে। এ দিকে এমপি পাপুলকে গ্রেপ্তারের খবর শুনে তার সংসদীয় এলাকায় দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল কুয়েতে মানবপাচার ও অর্থ পাচার করে আসছিলেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশ হলেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত কুয়েতে পাপুলকে গ্রেপ্তার করার খবর শুনে অনেকেই খুশি হলেও তার অনুসারীদের দাবি, এমপি পাপুল গ্রেপ্তার হয়েছে কিনা, সে বিষয়টি নিশ্চিত নয় তারা। এরপরও সংসদ সদস্য কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল ষড়যন্ত্রের শিকার বলেও দাবি করেন তার অনুসারীরা। শনিবার স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ৯টায় কুয়েতের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সদস্যরা কুয়েতের মুশরেফ আবাসিক এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে বলে জানা গেছে।