ব্যারিস্টার আবু সায়েমঃ ২০১৫ সালের ৮ই জানুয়ারি স্বাস্থ্য মন্ত্রী থাকাকালে মোহাম্মদ নাসিম বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অসুস্থতাকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, “আপনি নাটক করছেন। আপনি যদি সত্যিকারের অসুস্থ হয়ে থাকেন, তাহলে আমাকে বলেন। আমি স্বাস্থ্যমন্ত্রী হয়ে কথা দিচ্ছি, মেডিকেল বোর্ড পাঠিয়ে আপনাকে সুস্থ করে তুলব।” তিনি চ্যালেন্জ ছুঁড়ে দিয়ে আরও বলেছিলেন, “আগামী নির্বাচনে আপনাকে পরাজিত করে আমরা চ্যাম্পিয়ন হব।”
তাচ্ছিল্যের সুরে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উদ্দেশ্যে কথাগুলো যখন নাসিম বলছিলেন তখন তার নিজের বয়েস ছিলো প্রায় ৬৭ বছর এবং বেগম খালেদা জিয়ার ৬৯’র উপরে। নাসিম মারা গেলেন ৭২ বছর বয়েসে- বিনা নোটিশে, বিনা আয়োজনে। করেনাভাইরাস নামের অদৃশ্য এক হন্তারক দেহে প্রবেশ করে তার মগজে আঘাত হানলে চিরকালের মতো ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। তারও দিন সাতেক পরে আমরা অফিসিয়ালি জানতে পারলাম, বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ার পেছনে ফেলে ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর সন্তান, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্র ও স্বাস্থ্য মন্ত্রী মো. নাসিম মারা গেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন (আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চয়ই আমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী।)।
বাংলাদেশের একজন মানুষ ৬৭ বছর বয়েসে মোহাম্মদ আলী ক্লে’র মতো পালোয়ান থাকে না। এটা-সেটা কিছু রোগবালাই তাদের সাথে বন্ধুত্ব পাতবেই। অতএব, সে বয়েসে মো. নাসিম একশত ভাগ নিরোগ ছিলেন, এমনটা কোন দুর্বৃত্তের পক্ষেও চিন্তা করা অসম্ভব। নাসিমেরও তখন স্বাস্থ্যজনিত একটুআধটু সমস্যা ছিলো, এমন অনুমান আইনসিদ্ধ। তাহলে ৬৯-বছর-বয়েসী বেগম খালেদা জিয়াকে কেন মো. নাসিম ‘আপনি অসুস্থতার নাটক করছেন’ বলে অভিযুক্ত করলেন? দীর্ঘদিন আর্থারাইটিসসহ নানা জটিলতায় ভুগতে থাকা একজন সম্মানিতা নারীকে নিয়ে এরকম অশোভন মন্তব্য করাটা কি তাহলে আওয়ামী লীগের আজন্ম রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই বহিপ্রকাশ? একই সাথে হয়তো ক্ষমতার দম্ভ।
গদি অনেক মানুষকে অন্ধ করে দেয়; তাদের বিবেক লোপ পায়। দুর্নীতি, লুটপাট, স্বেচ্ছাচারিতায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতকে কীভাবে নিজের হাতে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন, মৃত্যুর আগে দেখে যাওয়ার পরম সৌভাগ্য হয়েছে মো. নাসিমের। জনগণ আসল সত্য জেনে যাবে বিধায়, যে হাসপাতালে তার চিকিৎসা গ্রহণের কথা বলা হচ্ছে এখন, তার নামও প্রকাশ করা হয়নি এতদিন। খটকা আরও বাঁধে মনে। সব ভিআইপিরা যায় সিএমএইচে, নাসিম কেন গেলেন শ্যামলীতে? নাসিমের করোনা পরীক্ষার রেজাল্ট নেগেটিভ আসে তিনি ডিপ কোমায় চলে যাওয়ার তৃতীয় দিনের মাথায়। সবাই জানে, মৃত ব্যক্তির শরীরে করোনাভাইরাস সর্বোচ্চ ৬ ঘন্টা বেঁচে থাকতে পারে। এরপর যতবারই নমুনা পরীক্ষা করা হোক না কেন, ফলাফল নেগেটিভ আসতে বাধ্য। মো. নাসিমের জন্যে দশ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছিলো। তারাও সেটা জানেন নিশ্চয়ই।
সে যা-ই হোক, মানুষটি মারা গেছেন। একজন মুসলিমের মৃত্যুর পরে তাকে নিয়ে মন্দ কথা বলার মানুষ আমি নই। কিন্তু সামষ্টিক দায়বোধের জায়গা থেকে একজন রাজনীতিবিদের জীবন ও পরিণতি নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা-সমালোচনা না করলে আমাদের ভবিষ্যত কাণ্ডারীরা যে নির্বোধই থেকে যাবেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এধরণের বিশ্লেষণের তাই ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। তবে আমি কয়েক কথায় ইতি টানবো।
১। মো. নাসিম মেডিক্যাল বোর্ড পাঠিয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে সুস্থ করে তোলার ঔদ্ধত্য দেখিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না, সেটা আল্লাহর হাতে। মেডিক্যাল বোর্ড কাউকে অমরত্ব দিতে পারে না। মরে তিনি সেটা প্রমাণ করলেন।
২। বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থতার নাটক করেছিলেন, নাকি মো. নাসিমের অসুস্থতা ও মৃত্যুকে ঘিরে তার প্রিয় নেত্রী-দল-সরকার নাটক করেছে, সেটা অবশ্যই ভবিষ্যতে গবেষণার বিষয় হবে। তবে ফলাফল জানার সুযোগ মো. নাসিমের আর কোনদিনই হবে না।
৩। যে দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন নাসিম, মৃত্যুকালে তার পরিবার সে দেশের স্বাস্থ্যসেবার ওপর ভরসা রাখতে পারছিলেন না। একবিন্দুও যদি সুযোগ থাকতো, মো. নাসিমকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হতো। তিনি যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন, সেটা তার পরিবারও জানে। কী লজ্জা!
৪। নাসিমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন ঠিকই, তবে পৃথিবীর মানুষ জানে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে কোন নির্বাচন হয়নি। মো. নাসিমকে ইতিহাস মনে রাখবে একজন অবৈধ সাংসদ হিসেবে।
৫। মো. নাসিম শেখ হাসিনার নেতৃত্বে করোনামুক্ত বাংলাদেশের ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরিতাপের বিষয়, তিনি নিজেই মারা গেলেন করোনাক্রান্ত হয়ে। আমি নিশ্চিত, জীবনের শেষ দিনগুলোতে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, শেখ হাসিনার ক্ষমতা অবিনশ্বর নয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একবার চক্কর মারলেই উপরের কথাগুলোর মর্মার্থ যে কোন পাঠক সহজেই উপলব্ধি করতে পারবেন। একজন রাজনীতিবিদের মৃত্যুতে যখন ট্রলের বন্যা বয়ে যায়, তখন সে থেকে অনেক কিছু শেখার থাকে, সবার। তবে উপলব্ধিটা বেশি দরকার মো. নাসিমের সহকর্মীদের, ঘরে কিংবা বাইরে।
লেখকঃ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানের উপদেষ্টা ও একজন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার আবু সায়েম।