ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ করোনার নমুনা পরীক্ষার কিট নিয়ে খোদ আওয়ামী লীগের নোয়াখালীর এমপি একরামুল করিম চৌধুরীর একটি বক্তব্য ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। তিনি বলেছেন, 'নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও ফেনী- এই তিন জেলায় কিটের অভাবে নমুনা পরীক্ষা তিন দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। নমুনা পরীক্ষা বন্ধ থাকার কারণে মানুষের মধ্যে হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে। দু-তিন দিন আগে স্বাস্থ্য বিভাগকে আমি আজগুবি বিভাগ বলেছিলাম। এটি শুধু আজগুবি বিভাগ নয়, মহাআজগুবি বিভাগ। আমার জানা মতে, দেশের তিন থেকে চারটি ব্যবসায়ী গ্রুপ প্রায় ১০ লাখের মতো কিট এনে রেখেছে; কিন্তু তারা মিঠু সিন্ডিকেটের কারণে তা দিতে পারছে না।
স্বাস্থ্য খাতে মিঠু সিন্ডিকেট যত দিনে ভেঙে ফেলা না যাবে তত দিন এই খাতে ভালো কিছু হবে না।'
ক্যাসিনোর মতো স্বাস্থ্য খাতের এই সিন্ডিকেট গুঁড়িয়ে দিতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আহ্বান জানান। একরামুল চৌধুরীর সোমবারের এই বক্তব্যের সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, করোনার নমুনা পরীক্ষার কিট নিয়ে মারাত্মক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। আক্রান্ত ও মৃতের উচ্চ সংক্রমণের এই সময়ে বিশেষজ্ঞরা যেখানে বেশি বেশি নমুনা পরীক্ষার ওপর জোর দিচ্ছেন; ঠিক তখনই হঠাৎ করে কিটের সংকট দেখা দিয়েছে। এতে নমুনা পরীক্ষা ক্রমেই জটিল হয়ে পড়েছে। তবে কিটের মজুদ নিয়ে কোনো তথ্যই দিচ্ছে না স্বাস্থ্য বিভাগ; বরং তারা লুকোচুরি করছে।
কিট সংকটের কারণে ১৮ জুন থেকে নারায়ণগঞ্জের খানপুর তিনশ' শয্যা হাসপাতালের পিসিআর ল্যাবে করোনার নমুনা পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। একই কারণে ১৭ তারিখ থেকে নমুনা সংগ্রহ বন্ধ আছে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও। চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রংপুরসহ সারাদেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালেও কিট সংকটের কারণে নমুনা সংগ্রহ বন্ধ হয়ে পড়েছে। জাতীয় প্রেসক্লাব ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতেও নমুনা সংগ্রহের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, কিটের তথ্য নিয়ে লুকোচুরি করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। উচ্চ সংক্রমণের এই সময়ে বিশেষজ্ঞরা প্রতিদিন অন্তত ৩০ হাজার নমুনা পরীক্ষার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের পরামর্শ দিয়েছেন। সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা তো দূরের কথা, বর্তমানে যে পরিমাণ
পরীক্ষা হচ্ছে কিট সংকটের কারণে তাও হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। কিট সংকট নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একেক রকম তথ্য দিচ্ছে। কখনও বলছে, কিটের সংকট আবার কখনও বলছে; আরটিপিসিআর ল্যাবরেটরির অভাব। সত্যিকার সমস্যাটি কী, তা মুখ খুলে বলছেন না কেউই।
বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাতে কত কিট মজুদ আছে সে সম্পর্কেও কোনো তথ্য জানাচ্ছেন না কেউ। তবে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, বর্তমানে যে কিট মজুদ আছে তা নিয়ে আগামী ৬ থেকে ৭ দিন হয়তো পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। এই সময়ের মধ্যে কিট সংগ্রহ করা না হলে নমুনা পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হবে। এতে সংকট আরও ঘনীভূত হবে।
গত সোমবার এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও কিট সংকটের কথা স্বীকার করেছেন। এর আগের দিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ কিট সংকটের কথা জানিয়ে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছিলেন। বিষয়টি জানতে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালক আবু হেনা মো. মোর্শেদ জামানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চেয়ে তার মুঠোফোনে খুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক সূত্র জানায়, কিটের বাণিজ্য মূলত চারটি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ওই গ্রুপটি কিট নিয়ে বেপরোয়া বাণিজ্য করছে। নির্ধারিত মূল্যের তুলনায় চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি মূল্যে তারা কিট সরবরাহ করে চলেছে।
কিটের সার্বিক বিষয় দেখভাল করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা) অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা। তিনি বলেন, নির্দিষ্ট কয়েকটি কোম্পানির বাইরে আরও কয়েকটি কোম্পানি থেকে কিট নেওয়া হবে। সিএমএসডি কিছু নতুন প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশও দিয়েছে। আরও অনেক আমদানিকারককে বলা হয়েছে। যাতে করে একচেটিয়া ব্যবসা না হয়।
বেশি সংকট হলুদ কিটের :সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, আরটিপিসিআরের দুই ধরনের মেশিন রয়েছে। এক ধরনের মেশিনে লাল এবং অন্যটিতে হলুদ কিট ব্যবহার করা হয়। গত ১৫ দিন ধরে হলুদ কিটের আমদানি বন্ধ রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কিট সরবরাহকারীরা হলুদ কিট না এনে সব লাল কিট এনেছেন। ফলে হলুদ কিট ব্যবহারকারী আরটিপিসিআর মেশিনগুলোতে পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণেই অনেক স্থানে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, নমুনা পরীক্ষার জন্য সর্বশেষ কেনা ২১টি আরটিপিসিআর মেশিন সেই ২০০৯ সালের মডেলের। ওই মেশিনের কিট পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। চাহিদা থাকার পরও এসব মেশিনের কিট সরবরাহ করা যাচ্ছে না। ফলে পরীক্ষাও করা যাচ্ছে না।
কয়েকদিন ধরে গড়ে প্রতিদিন ১৫ থেকে ১৭ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। কিট সংকটের সমাধান না হলে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা আরও কমবে। এই কিট নিয়ে একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেছে ওএমসি হেলথ কেয়ারসহ মোট চারটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান।
এ বিষয়ে ডা. নাসিয়া তাহমিনা বলেন, দেশে এবিআই-৭৫০০, এবিআই কিউএস-৩ ও এবিআই কিউএস-৫ নামে তিন ধরনের আরটিপিসিআর মেশিনের মাধ্যমে পরীক্ষা চলছে। চীনের স্যানসিওর, ইউএসএর থার্মোফিশারের পাশাপাশি আইইডিসিআর আরও দুই ধরনের কিট ব্যবহার করে। এর মধ্যে এবিআই-৭৫০০ এবং এবিআইব কিউএস-৫ মেশিনে চলে লাল বাক্সের কিট আর এবিআই কিউএস-৩ মেশিনে চলে হলুদ বাক্সের কিট। সর্বশেষ লাল বাক্সের ২০ হাজার এবং হলুদ বাক্সের ১০ হাজার মিলে মোট ৩০ হাজার কিটের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু হলুদ বাক্সের কিট আসেনি। পুরো ৩০ হাজারই লাল বাক্সের কিট পাঠানো হয়। এতে করে হলুদ বাক্সের কিটে যেসব মেশিনে পরীক্ষা করা হয়, সেগুলোতে দু'দিন পরীক্ষা বন্ধ ছিল। কিট আসার পর এখন পরীক্ষা আবার চালু হয়েছে। বর্তমানে কিটের কোনো সংকট নেই বলে দাবি করেন তিনি।
নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা কমছে : স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, করোনা সংক্রমণের শুরুতে একমাত্র আইইডিসিআর ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষা করা হতো। তিন মাসের মধ্যে এই ল্যাবের সংখ্যা বেড়ে ৬৬টিতে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ৩২টি ল্যাবরেটরি ঢাকায় এবং ৩৪টি ঢাকার বাইরে বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা হয়েছে। মাঝে মধ্যে কিছু ল্যাবে কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। গতকালও ছয়টি ল্যাবে পরীক্ষা হয়নি। এ কারণে পরীক্ষায় জট লেগে আছে। এর মধ্যেই হঠাৎ করে কিটের স্বল্পতায় নমুনা পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হলো।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক ঢাকাসহ সারাদেশে ৫৪টি বুথ স্থাপন করে নমুনা সংগ্রহের কাজ করছে। এই বুথ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ব্র্যাকের কর্মকর্তা মোর্শেদা চৌধুরী জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশে তাদের প্রতিটি বুথের মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে ৩০টি করে নমুনা সংগ্রহ করা হতো। কারণ এর বেশি নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা ল্যাবরেটরির নেই। চলতি সপ্তাহে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে নমুনা একটু কম সংগ্রহের কথা জানানো হয়। কারণ কিটের স্বল্পতা রয়েছে। সেজন্য এই সপ্তাহে প্রতিটি বুথে প্রতিদিন ৩০টির পরিবর্তে ১৫টি করে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে।
কিটের সংকট না থাকলে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার পরিধি কমানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেন, নমুনা পরীক্ষার পরিধি কেন কমেছে, সেটি তিনি জানেন না। ব্র্যাককে কে বা কারা কম নমুনা সংগ্রহ করতে বলেছে সে সম্পর্কেও তিনি অবগত নন।
তবে ল্যাবরেটরির বিষয়ে এই অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, অনেক সময় দু-একটি ল্যাবে ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার কারণে নমুনা পরীক্ষা বন্ধ রাখতে হয়। ওই ভাইরাস মুক্ত করে আবারও পরীক্ষা শুরু হয়। এতে সময় লেগে যায়। চলমান নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে হলে আরও ল্যাব প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হবে। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলতে পারবেন বলে জানান তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, বর্তমানে সারাদেশে ৬২টি ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষার কাজ চলছে। এই ল্যাবে প্রতিদিন ১৬ থেকে ১৭ হাজারের বেশি পরীক্ষা করতে পারছে না। ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রিপোর্ট পেতে সাত দিনও চলে যাচ্ছে। একজন লক্ষণ নিয়ে সাত দিন অপেক্ষা করবেন, কোনো চিকিৎসা নেবেন না- এটি তো হয় না। সুতরাং ল্যাবের সংখ্যা বৃদ্ধি না করা পর্যন্ত এই সমস্যা থাকবে। মেশিন ক্রয়ের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। দ্রুততম সময়ে ল্যাবরেটরি স্থাপনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।