ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ করোনাভাইরাস প্রতিরোধে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের জন্য ভুয়া মাস্ক সরবরাহকারী আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুল ইসলামকে খুঁজছে পুলিশ।
মাস্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় আমিনুলের বিরুদ্ধে ঔষধ প্রশাসনের মামলার পর কাগজপত্র যাচাই-বাছাই ও তার অবস্থান জানার চেষ্টা করছে পুলিশ। এছাড়া মামলাটির তদন্তভার শিগগিরই পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের কাছে স্থানান্তর হতে পারে।
দেশে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর ১৮ এপ্রিল ৫০ হাজার কেএন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের জন্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলামের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে তড়িঘড়ি করে কার্যাদেশ দেয় কেন্দ্রীয় ঔষধাগার।
প্রথম দফায় ভুয়া মাস্ক সরবরাহের পর জাল-জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়লেও প্রথম দিকে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর নীরব ভূমিকা পালন করে। বিষয়টি ফাঁস হলে স্বাস্থ্য বিভাগে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। এরপর আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে অনেকটা গোপনে মামলা করে নিজেদের দায় সারে ঔষধ প্রশাসন। ২৯ মে রাজধানীর বনানী থানায় মামলাটি করেন ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের সহকারী পরিচালক ফখরুল ইসলাম। মামলা হলেও আমিনুল ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন।
মামলাটির তদন্তভার শিগগিরই পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের কাছে স্থানান্তর হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) সুদীপ কুমার চক্রবর্তী। যুগান্তরকে তিনি বলেন, দু-এক দিনের মধ্যে মামলাটি সিআইডিকে দেয়া হবে। বনানী থানার ওসি নূরে আযম মিয়া মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, মামলার পর কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। একই সঙ্গে আসামি আমিনুল ইসলামের অবস্থান জানার চেষ্টা চলছে। তাকে গ্রেফতার করা হবে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে ওসি নূরে আযম যুগান্তরকে বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগে মামলা হওয়ায় তাকে গ্রেফতার না করার কোনো কারণ নেই।
মামলায় আমিনুল ইসলামকে একমাত্র আসামি করা হয়েছে। তার বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার বারদোনার গোলাম মহিউদ্দিন পাড়ায়। গুলশানের বনানী এলাকায় তিনি থাকেন। তার প্রতিষ্ঠানের অফিস ৬০/এ পুরানা পল্টন।
যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাস্ক নিয়ে জাল-জালিয়াতির ঘটনা থেকে প্রথম থেকেই নিজেকে রক্ষার কৌশল অবলম্বন করছেন আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুল। মেসার্স এলান কর্পোরেশনের স্বত্বাধিকারী হলেও কার্যাদেশ পাওয়ার আগে আমিনুল ঢাকার হাজারীবাগে তাজুল ইসলাম নামের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে মাস্ক আমদানির ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হন। চুক্তিপত্রের শর্ত অনুযায়ী আমদানি করা মাস্কের সব ধরনের দায় বহন করবেন তাজুল। চুক্তিপত্রের বিষয়টি জানার পর তাজুল ও তার গাড়িচালকের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়েছে। ঔষধ প্রশাসনের করা মামলায় বলা হয়- ১৮ এপ্রিল ৫০ হাজার কেএন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের জন্য মেসার্স এলান কর্পোরেশনের স্বত্বাধিকারী আমিনুল ইসলামকে কার্যাদেশ প্রদান করে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার। ১৩ মে মাস্কের সিই মার্কিং সনদ, ফ্রি সেল সার্টিফিকেট ও মাস্কের টেস্ট রিপোর্টসহ মাস্ক খালাসের জন্য আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটি। ১৮ মে ঢাকা শুল্ক বিভাগ থেকে মাস্কগুলো খালাসের জন্য অনাপত্তিসূচক সনদও দেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর জানতে পারে অনাপত্তি নেয়ার জন্য এলান কর্পোরেশন যেসব কাগজপত্র দেখিয়েছে তা ভুয়া। কেন্দ্রীয় ঔষধাগার যাচাই-বাছাই করে দেখতে পায় ফ্রি সেল সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন কাগজপত্র প্রতিষ্ঠানটি নিজেরাই জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করেছে। এটা ইস্যু করার কথা ড্রাগ রেগুলেটরি অথরিটির।
বিষয়টি যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার কর্তৃপক্ষ আইএসও সার্টিফিকেট ইস্যুকারী জার্মান প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে গিয়ে এলান কর্পোরেশনের দেয়া সার্টিফিকেটটি চীনের অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের নামে ইস্যু করার বিষয়টি নিশ্চিত হয়।
এমনকি এলান কর্পোরেশন কেএন-৯৫ মাস্ক আমদানির মাস্কটির উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে সনদ জাল করেছে। এ থেকে প্রতিষ্ঠানটি অসৎ উদ্দেশে ভুয়া মাস্ক সরবরাহ করেছে বলে ঔষধ প্রশাসন নিশ্চিত হয়।
এরপর ২৭ মে মাস্ক আমদানির জন্য অনাপত্তিসূচক সনদপত্রটি বাতিল করে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার। মামলায় আরও বলা হয়, করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) চিকিৎসায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
মামলার পর ঔষধ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আমিনুল ইসলাম বলেন, এলান কর্পোরেশনের নামে মাস্ক আমদানির জন্য অন্য একজনকে তিনি লাইসেন্স ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন। তাই দুর্নীতি ও জাল-জালিয়াতির দায় তার নয়।
এরপর ঔষধ প্রশাসনের পক্ষ থেকে হাজারীবাগের ব্যবসায়ী তাজুল ইসলাম ও তার গাড়িচালকের বিরুদ্ধে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে আরেকটি মামলা করা হয়।