ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের চরম অব্যবস্থাপনা আর অনিয়মের তুমুল সমালোচনার মধ্যে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) আবুল কালাম আজাদ।
আজ মঙ্গলবার (২১ জুলাই) সন্ধ্যার পর জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুনের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন আবুল কালাম আজাদ। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন স্বাস্থ্য সচিব মো. আবদুল মান্নান। ডা. আজাদ ২০১৬ সাল থেকে ওই পদে বহাল ছিলেন। এরমধ্যে চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ায় তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়।
করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই নানা কারণেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে ব্যর্থতার পাশাপাশি কেনাকাটা ও নিয়োগে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি সামাল দিতে না পারাসহ নানা অব্যবস্থাপনার দায়ে ডা. আজাদকে নিয়ে সরকারি মহলসহ দেশব্যাপী সমালোচনা চলছিলো। স্বাস্থ্যখাতে বিভিন্ন অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন মহল থেকেই তার পদত্যাগের দাবি ওঠে। একের পর এক স্বাস্থ্য বিভাগের অব্যবস্থাপনার খবর সংবাদ শিরোনাম হয়। তবে, অব্যবস্থপনার সংবাদ ছাপিয়ে যায় করোনা মহামারিতেও স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতির নানা চিত্র। বিভিন্ন হাসপাতালে নিম্নমানের স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহের বিষয়টি খোদ প্রধানমন্ত্রীকেও অবহিত করেন চিকিৎসকরা। এর মধ্যেই আগামী বছরের ১৫ এপ্রিল মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পদত্যাগ করলেন ডা. আজাদ।
করোনার অতি মহামারির শুরু থেকেই করোনাভাইরাস প্রতিরোধে মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতির বিষয়ে আবুল কালাম আজাদ প্রতিনিয়ত আশ্বাস দিয়ে আসলেও দিন যত গড়িয়েছে স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার চিত্র ততই প্রকট হতে থাকে।
গেল জুন মাসের ১৮ তারিখে আবুল কালাম আজাদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিনে বলেছিলেন, 'দেশে করোনা পরিস্থিতি দুই থেকে তিন বছর বা তার চেয়েও বেশিদিন স্থায়ী হবে।' তার এ বক্তব্যের পর জনমনে উদ্বেগ দেখা দেয়। দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা অবশ্য মহাপরিচালকের এই বক্তব্যকে ‘তার নিজের বক্তব্য’ এবং এই বক্তব্যের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই বলে জানিয়েছিলেন। আর করোনা নিয়ে ডিজির এ বক্তব্যকে কাণ্ডজ্ঞানহীন উল্লেখ করে সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, 'দায়িত্বশীল পদে থেকে কারও দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য রাখা মোটেও সমীচীন নয়।'
এছাড়া, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের পাশাপাশি রাজধানীর আরও কয়েকটি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে দায়িত্ব পালনকারী চিকিৎসক-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাপনা নিয়েও স্বাস্থ্য বিভাগ ছিলো সিদ্ধান্তহীন। বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর দেশজুড়ে সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই মাস্ক, গ্লাভস, পিপিইসহ বিভিন্ন সুরক্ষা সামগ্রী কেনাকাটা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। প্রথমে এন-৯৫ মাস্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে দুর্নীতির বিষয়টি আলোচনায় আসে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নিম্নমানের মাস্ক ও পিপিই নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সংশ্নিষ্টরা বলেছিলেন, দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত পুরো সিন্ডিকেটটিই মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদের অনুসারী এবং তার নির্দেশনাতেই পুরো প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন হয়।
এরপর টক অব দ্যা কান্ট্রি হয়ে ওঠে লাইসেন্সবিহীন হাসপাতাল রিজেন্টের সঙ্গে চুক্তি ও ভুইফোড় সংস্থা জেকেজিকে দিয়ে করোনা পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ করা। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রতারণা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। একপর্যায়ে স্বাস্থ্যের ডিজি সংবাদ মাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানান, মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তিনি রিজেন্টের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন।
এই দুই প্রতিষ্ঠানকে করোনাভাইরাস পরীক্ষা ও আক্রান্তদের চিকিৎসা করাতে কেন অনুমতি দেয়া হয়েছিলো ও তার করা মন্তব্যের বিষয়ে ডা, আবুল কালাম আজাদকে কারণ দর্শানোর চিঠি দেয় মন্ত্রণালয়। যথারীতি ব্যাখা দেন তিনি। দায় চাপান মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিবের ওপর। পরে, চিঠির ব্যাখ্যায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সন্তুষ্ট নয় বলে জানিয়ে আবারও তাকে চিঠি দেয়া হয়।
স্বাস্থ্যখাতের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা নিয়ে বিভিন্ন সময় সংবাদকর্মীদের মুখোমুখি হলেও প্রায় সময়ই তাদের এড়িয়ে নিজের অধিদপ্তরে নিজের অবস্থান ধরে রাখতেই বেশি মরিয়া ছিলেন আবুল কালাম আজাদ। দুর্নীতি অনিয়মের তদন্ত রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে সবশেষ গত রবিবার (১৯ জুলাই) নথি চেয়ে তার কার্যালয়ে যান দুদকের প্রতিনিধি দল। ২৪ ঘন্টা সময় চেয়ে গতকাল সোমবার (২০ জুলাই) দুদকে নথি পাঠিয়ে পরদিনই পদত্যাগপত্র জমা দিলেন আবুল কালাম আজাদ।