দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ প্রতিবেদনঃ স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় তথা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ২৭ কর্মকর্তা-কর্মচারী নজরদারিতে আছেন। সরকারি একাধিক সংস্থার তালিকা ধরে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করতে যাচ্ছে। দুদকের এক পরিচালক দেশ রূপান্তরকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ওই তালিকায় রয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১২ কর্মকর্তা-কর্মচারী, ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল ও দপ্তরের ৬ ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন হাসপাতাল ও দপ্তরের ১০ জন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এরা সবাই আবজাল ও মালেকের মতোই ধনাঢ্য। তারা দীর্ঘদিন ধরে একই পদে থেকে নিয়োগ, বদলি, ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
এদিকে গ্রেপ্তার হওয়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক আবদুল মালেককে ১৪ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। রিমান্ডে তিনি চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য দিয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। জানিয়েছেন সরকারি গাড়ি পারিবারিক কাজে ব্যবহারের তথ্যও। মালেককে গতকাল সোমবার সাময়িক বরখাস্ত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
র্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন গতকাল রাতে বলেন, ‘যারা অপরাধ করবে তাদের কিছুতেই ছাড় দেওয়া হবে না। গাড়িচালক আবদুল মালেকের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আরও তথ্য বেরিয়ে আসবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ‘বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গাড়িচালক মালেককে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। শুধু তিনিই নন, অন্য যারাই অপরাধ করবেন তাদের সঙ্গে আপস করার সুযোগ নেই। দুর্নীতিবাজদের কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না। সে যত প্রভাবশালীই হোক না কেন।’
সরকারি একাধিক দপ্তর থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর নজরদারিতে থাকার তালিকা পাওয়া গেছে তারা হলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রধান সহকারী সৈয়দ জালাল, জাহাঙ্গীর হোসেন হাওলাদার ও মো. জাকির হোসেন, হিসাবরক্ষক আতিকুল ইসলাম, প্রশাসনিক কর্মকর্তা কবির আহমেদ চৌধুরী, অফিস সহকারী ইকবাল হোসেন, এইডস শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. জালাল উদ্দিন, স্টেনোগ্রাফার শাহজাহান ফকির, প্রোগ্রামার (এমআইএস) রুহুল আমিন, স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর প্রশিক্ষণ ও মাঠ কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম, চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালের হেলথ এডুকেটর (প্রেষণে অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোতে) কর্মরত মো. জাকির হোসেন।
অধিদপ্তরের বাইরে ঢাকায় স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে রয়েছেন সম্প্রসারিত টিকা কর্মসূচি (ইপিআই) ভবনের অফিস সহকারী তোফায়েল আহমেদ, কমিউনিটি ক্লিনিকের উচ্চমান সহকারী মো. আনোয়ার হোসেন, ফাইভ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রকল্পের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আবদুল্লাহেল কাফী, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সচিব মো. আনোয়ার হোসেন, শেরেবাংলা নগরের জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মাহামুদুজ্জামান ও একই হাসপাতালের গুদাম কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন।
তালিকায় ঢাকার বাইরে যে ১০ কর্মকর্তার নাম রয়েছে তারা হলেন খুলনার শেখ আবু নাসের হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. ওয়াহিদুজ্জামান, সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রধান সহকারী আসিক নেওয়াজ, ফরিদপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. জালাল মোল্লা, রাজশাহী মেডিকেল কলেজের হিসাবরক্ষক মো. মারুফ হোসেন, গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গুদাম কর্মকর্তা মো. নাজিম উদ্দিন, রাজশাহীর পরিচালক (স্বাস্থ্য) দপ্তরের প্রধান সহকারী মো. হেলাল উদ্দিন, কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের গুদাম কর্মকর্তা মো. সাফায়েত হোসেন ফয়েজ, খুলানা বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) দপ্তরের স্টেনোগ্রাফার মো. ফরিদ উদ্দিন, একই দপ্তরের প্রধান সহকারী মো. মাহাতাব হোসেন ও পরিচালক (স্বাস্থ্য) ঢাকা বিভাগীয় দপ্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা দীপক কান্তি।
নজরদারির তালিকায় এক নম্বরে থাকা নামটি হচ্ছে সৈয়দ জালাল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারীদের নিয়োগসংক্রান্ত নথিপত্র সংরক্ষণ করেন। এই কর্মকর্তা একই চেয়ারে দীর্ঘদিন কর্মরত থেকে অধিদপ্তরে একটি শক্তিশালী চক্র গড়ে তুলেছেন। তিনি কৌশলে নিজের পদোন্নতি বাতিল করে লোভনীয় এ পদে রয়েছেন। রাজধানী ঢাকা ও গ্রামের বাড়িতে তার নামে-বেনামে রয়েছে বিশাল সম্পদ।
অধিদপ্তরের প্রধান সহকারী জাহাঙ্গীর হোসেন হাওলাদার সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির টেকনিশিয়ানসহ বিভিন্ন পদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ বদলি ও পদোন্নতির ব্যবস্থা করেন। অধিদপ্তরে তাকে অর্থ না দিয়ে কোনো স্বাস্থ্য সহকারীর বদলি বা পদোন্নতি হয় না। ইপিআই টেকনিশিয়ান পদোন্নতি হয় তার ইচ্ছেমাফিক। সারা দেশ থেকে আসা আবেদনপত্র থেকে তিনি ঘুষ আদায়ের জন্য নিজস্ব সোর্স নিয়োগ করে রেখেছেন। এছাড়া তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মচারী সংগঠনের সভাপতি হিসেবেও বদলি পদোন্নতিতে কমিশন বাণিজ্য করেন। আরেক প্রধান সহকারী জাকির হোসেন স্বাস্থ্য সহকারীদের ফাইল দেখেন। তিনি গ্রেপ্তার হওয়া মালেকের সহযোগিতায় সারা দেশে প্রতিনিধি নিয়োগ করে বিভিন্ন কাজের কমিশন বাণিজ্য করেন। সাভারে তিনি প্রাসাদপ্রম বাড়ি তৈরিসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নামে-বেনামে বিপুল সম্পদ করেছেন।
অধিদপ্তরের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আতিকুল ইসলাম বাজেট শাখায় কর্মরত থেকে সারা দেশে অর্থ বরাদ্দ দেন। বরাদ্দের বিনিময়ে তিনি মোটা অঙ্কের কমিশন নেন। ঢাকায় ও গ্রামের বাড়িতে নামে-বেনামে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন।
বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে গেছে, প্রশাসনিক কর্মকর্তা কবির আহমেদ চৌধুরী প্রায় ৩৫ বছর ধরে একই পদে কর্মরত থেকে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন। ঢাকায় রয়েছে তার দামি ফ্ল্যাট।
অফিস সহকারী মো. ইকবাল হোসেন সাবেক মহাপরিচালকের আস্থাভাজন থেকে বিলবোর্ড ও ছাপার কাজ এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন। বিলবোর্ড না করে অর্থ তুলে নেওয়া, পুরাতন বিলবোর্ড নতুন হিসেবে দেখানোসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে কোটি টাকার মালিক হন ইকবাল। এইডস শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা জালাল উদ্দিন একই পদে ও একই প্রোগ্রামে চাকরি করে বাড়ি-গাড়ি-ফ্ল্যাটসহ প্রচুর জমিজমার মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। স্টেনোগ্রাফার শাহজাহান ফকির নিজস্ব সিন্ডিকেট গড়ে তুলে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।
অধিদপ্তরের এমআইএস শাখার প্রোগ্রামার মো. রুহুল আমিন সাবেক মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। অভিযোগ রয়েছে, তিনি অধিদপ্তরে আরেক আবজাল হিসেবে চিহ্নিত। বিভিন্ন দরপত্রের একক নিয়ন্ত্রক তিনি। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে প্রচুর জমি কিনেছেন। ঢাকায় নামে-বেনামে করেছেন বিপুল সম্পদ। উপজেলা চেয়ারম্যান ও এমপি পদে মনোনয়ন নেওয়ার চেষ্টা করেছেন বলে জানা গেছে। সাবেক ডিজিকে হাত করে তিনি বিগত দুই বছরে (করোনার আগে) কমপক্ষে পাঁচবার বিদেশ সফর করেন।
ট্রেনিং শাখার কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম নারায়ণগঞ্জ সিভিল সার্জন অফিসে সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দুদক ইতিপূর্বে তার বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করলেও রহস্যজনক কারণে সেটা থেমে যায়। প্রশিক্ষণের নামে বিপুল অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে এ আমিনুলের বিরুদ্ধে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর হেলথ এডুকেটর জাকির হোসেনের চাকরি চাঁদপুরে। তিনি প্রেষণে ব্যুরো অফিসে আসেন। অধিদপ্তরের অন্য কর্মকর্তা নাছির উদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি অধিদপ্তরে সিন্ডিকেট গঠন করেন। সাবেক ডিজির ছত্রছায়ায় থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হন।
অভিযোগ আছে, অফিস সহাকারী তোফায়েল আহমেদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন ইপিআই ভবনের নিয়ন্ত্রক। তার নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় রয়েছে। অধিদপ্তরের অধীনে কমিউনিটি ক্লিনিক শাখার উচ্চমান সহকারী মো. আনোয়ার হোসেন নিয়োগ টেন্ডারবাণিজ্য করে রংপুরে বিপুল সম্পদ গড়েছেন। সেখানে তার রয়েছে বহু বিঘা ফসলি জমি। ফাইভ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রকল্পের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল্লাহেল কাফী মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫০০ কোটি টাকার কাজ করেছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সচিব মো. আনোয়ার হোসেন সেখানে সব ধরনের কেনাকাটা ও টেন্ডারের নিয়ন্ত্রক। রাজধানীর বনশ্রীতে ছয়তলা বাড়ি ছাড়াও রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লট। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাহামুদুজ্জামান সরকারি বাসা বরাদ্দ থেকে শুরু করে হাসপাতালের বিভিন্ন কাজের নিয়ন্ত্রক। একই হাসপাতালের স্টোর অফিসার দেলোয়ার হোসেন ওষুধ ও পণ্য সরবরাহ করে কীভাবে ঠিকাদারকে বিল দিতে হয় এ বিষয়ে বিশেষ দক্ষ। তার কুখ্যাতি আছে ওষুধ পাচার করার কাজেও। হাসপাতালের যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও কেনাকাটায় বিভিন্ন ঠিকাদারের যোগসাজশে বিপুল সম্পদের মালিক এ দেলোয়ার।
ঢাকার বাইরে খুলনার শেখ আবু নাসের হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ওয়াহিদুজ্জামানের রয়েছে খুলনা শহরে আছে ছয়তলা বাড়ি এবং একাধিক মাছের ঘেরসহ বিপুল পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ। সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রধান সহকারী আসিক নেওয়াজ অধিদপ্তরের কালো তালিকাভুক্ত ঠিকাদার জাহের উদ্দিন সরকারের সহযোগী।
বহুল আলোচিত পর্দা কেলেঙ্কারিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে ফরিদপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জালাল মোল্লার বিরুদ্ধে। অভিযোগমতে, দেশি ভাই হিসেবে সেই আবজালের হাত ধরে উত্থান হয় জালাল মোল্লার। সিলেট আইএসটিতে ৩০ কোটি টাকার কাজ, যশোর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে প্রভাবশালী এক আওয়ামী লীগ নেতাকে সঙ্গে নিয়ে ৪২ কোটি টাকার কাজ করেন তিনি।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের হিসাবরক্ষক মারুফ হোসেন দুর্নীতির টাকায় রাজশাহী শহরে সাততলা বাড়ি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, বেনামি বেশ কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গড়ে রাজশাহী অঞ্চলে বিভিন্ন হাসপাতাল নির্মাণ ও মালামাল সামগ্রী সরবরাহ করেন তিনি।
প্রাপ্ত অভিযোগ থেকে জানা গেছে, গাজীপুরের সৈয়দ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজের স্টোর অফিসার নাজিম উদ্দিনের নিজের ও পরিবারের লোকজনের নামে রয়েছে বেশ কয়েকটি গাড়ি ও গাজীপুরে একাধিক বাড়ি।
রাজশাহী বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের প্রধান সহকারী হেলাল উদ্দিন রাজশাহী অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত বিভিন্ন ঠিকাদারি ও সরবরাহের কাজের অন্যতম নিয়ন্ত্রক বলে অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, শহরে তার পাঁচতলা বাড়ি ও বিভিন্ন ব্যাংকে প্রচুর এফডিআর রয়েছে। কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের স্টোরকিপার সাফায়েত হোসেন ফয়েজের বিরুদ্ধে হাসপাতালের পণ্য বুঝে না নিয়ে ঠিকাদারকে বিল পরিশোধসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। খুলনা বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের স্টোনোগ্রাফার ফরিদ উদ্দিন খুলনা বিভাগের স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত কাজের নিয়ন্ত্রক বলে অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, খুলনায় তার বিলাসবহুল বাড়ি ও বেশ কয়েকটি মাছের ঘের রয়েছে। একই অফিসের প্রধান সহকারী মাহাতাব হোসেনের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক বনে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। একইভাবে ঢাকার বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা দীপক কান্তিও বিপুল সম্পদ গড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
মালেকের চাঞ্চল্যকর তথ্য : পেশায় একজন গাড়িচালক হয়েও মালেক দীর্ঘদিন ধরে সরকারি গাড়ি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কাজে ব্যবহার করেছেন বলে জানা গেছে। তিনটি ফ্ল্যাট ও দুটি বাড়ির মালিক মালেকের রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে আছে একাধিক বাড়ি-গাড়িসহ শতকোটি টাকার সম্পদ। দীর্ঘদিন ধরেই অধিদপ্তরের বিভিন্ন বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য ছিলই তার অন্যতম কাজ। কোনো কর্মকর্তা যদি তার সুপারিশ না শোনতেন তাহলে তাকে ঢাকার বাইরে বদলি করাসহ শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার ঘটনা ঘটিয়েছেন একাধিকবার। একটি সংস্থার প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সরকারের একটি সংস্থার দুই কর্মকর্তা বলেন, পাজেরো গাড়িতে মালেক নিজের ডেইরি ফার্মের দুধ নিয়ে আসতেন। অফিসে ঢোকানোর আগে গাড়ি থেকে মালামাল নামিয়ে পরে অফিসে আসতেন। এ ঘটনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রায় সবাই জানেন। কিন্তু কেউ মুখ খোলেননি। কারণ বড় কর্মকর্তাদের খুব কাছের লোক ছিলেন তিনি। তারা আরও জানান, এ ক্ষমতা নিয়েই তিনি অধিদপ্তরের চিকিৎসকদের বদলি, পদোন্নতি ও তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগবাণিজ্যে জড়িত ছিলেন। একজন পরিচালক তার বিরুদ্ধে অডিটের চেষ্টা করলে সেটিও তিনি করতে পারেননি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কারণে। যে কারণে মালেক কোন গাড়ি ব্যবহার করতেন, কীভাবে তেল খরচ করতেন তা নিয়ে খুব একটা বেশি ভাবার অবকাশ ছিল না। চিকিৎসকদের একটা বিশাল অংশ যারা এ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কাজ করেন, তারা মূলত মালেকদের সমীহ করেই চলেন। কারোর সঙ্গে কোনো সমস্যা হলে দেখা যায় কিছুদিনের মধ্যে তার বদলির আদেশ চলে আসে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধু মহাপরিচালকের গাড়িই নয়, মালেক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি পিকআপ (ঢাকা মেট্রো- ঠ-১৩-৭০০১) নিজের গরুর খামারের দুধ বিক্রির কাজে ব্যবহার করে থাকেন। এ গাড়িটি চালায় মাহবুব নামে একজন চালক। এছাড়াও অধিদপ্তরের আরেকটি মাইক্রোবাস (ঢাকা মেট্রো-চ-৫৩-৬৭৪১) পরিবারের সদস্যদের জন্য ব্যবহার করতেন মালেক। এ গাড়িটিও কামরুল নামে একজন চালককে দিয়ে ব্যবহার করাতেন তিনি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, শুধু একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালকই নয়, যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী, এমনকি সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও যদি রাজধানীতে একাধিক বাড়িসহ অঢেল সম্পদের মালিক হতে দেখা যায় তবে সেটি নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। এই সম্পদ বৈধ কি না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া যায়, বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই এসব ক্ষেত্রে। এখানে দুটি বিষয় আছে। প্রথমটি হলো বৈধ আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্য সম্পদ আহরণ হলে সেটি খতিয়ে দেখতে হবে। এই কাজটি দুর্নীতি দমন কমিশন খুব সহজভাবেই করতে পারে। ব্যক্তির আয়ের সঙ্গে সম্পদের হিসাব নিলেই পরিষ্কারভাবে বের হয়ে আসবে যে, তিনি কীভাবে এ সম্পদের মালিক হয়েছেন। যদি ওই ক্ষেত্রে অবৈধ কিছু পাওয়া যায় তবে তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, মালেকের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ ছিল তাদের প্রত্যেককেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালককে (প্রশাসন) জিম্মি করে ডাক্তারদের বদলি, পদোন্নতি, তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নিয়োগের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করেছেন তিনি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে তার মেয়ে নওরিন সুলতানাকে কম্পিউটার অপারেটর, ভাই আবদুল খালেককে অফিস সহায়ক, ভাতিজা আবদুল হাকিমকে অফিস সহায়ক, বড় মেয়ের স্বামী রতনকে ক্যান্টিন ম্যানেজার, আত্মীয় কামাল পাশাকে অফিস সহায়ক, ভায়রা মাহবুবকে ড্রাইভার এবং ভাগ্নে সোহেলকে ড্রাইভার পদে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চাকরি দিয়েছেন তিনি। মহাপরিচালকের পাজেরো গাড়িটি হরহামেশাই ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন।
সূত্রঃ দৈনিক দেশ রুপান্তর।