ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বার লাইসেন্স নেই, নেই মদ বিক্রির অনুমোদনও। তবুও রাজধানীর গুলশানে ‘হর্স অ্যান্ড হর্স’ নামের অভিজাত রেস্টুরেন্টে রাতভর চলছে আমদানি নিষিদ্ধ বিদেশি মদের দেদার কেনাবেচা। স্বাস্থ্যবিধি মানা তো দূরের কথা, করোনার মধ্যে এখানে সবই চলছে আগের নিয়মে।
একেবারে পাশ্চাত্যের আদলে বসছে তরুণ-তরুণীদের জমজমাট আড্ডা। মদ বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যে, খোলামেলা। কিন্তু দেখার যেন কেউ নেই। অভিযোগ আছে, এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে যাদের ব্যবস্থা নেয়ার কথা তারা নিশ্চুপ।
সব কিছু জেনেও রহস্যজনক কারণে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। সম্প্রতি সরেজমিন অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে রেস্টুরেন্টটির নানা অনিয়মের আদ্যোপান্ত।
বুধবার রাতে নিবাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর হর্স অ্যান্ড হর্স রেস্টুরেন্টে অভিযান চালায়। জব্দ করা হয় বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ, বিয়ার, হুক্কা ও শিশা।
সূত্র বলছে, রেস্টুরেন্টে মদ বিক্রির কোনো অনুমোদনই নেই। চোরাই বাজার থেকে বিদেশি মদের বোতল এনে বিক্রি হচ্ছে উচ্চমূল্যে। আমদানি নিষিদ্ধ বিদেশি বিয়ারও বিক্রি হচ্ছে দেদার।
বিক্রি হওয়া মদ-বিয়ারের বেশিরভাগ আসে ডিউটি ফ্রি ডিপ্লোম্যাটিক বন্ডেড ওয়্যার হাউস থেকে। ওয়্যার হাউসের নির্ধারিত চোরাকারবারিরা রেস্টুরেন্টটিতে মদ-বিয়ার সরবরাহ করে। এছাড়া বিদেশ থেকে লাগেজ পার্টির মাধ্যমে চোরাইপথে আসা মদও বিক্রি হচ্ছে এখানে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, হর্স অ্যান্ড হর্স রেস্টুরেন্টে বার লাইসেন্স নেই। বেআইনিভাবে মদ বিক্রি ছাড়াও তারা অন্তত ১০ ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। প্রথমত, তারা শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চোরাই মদ বিক্রি করছে।
দ্বিতীয়ত, বার পরিচালনার অনুমতি না নিয়ে মদ-বিয়ার কেনাবেচা করছে। তাছাড়া বার বন্ধের সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মদ বিক্রির কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
উপরন্তু, তারা কোনো ধরনের নিয়মের তোয়াক্কা না করে মধ্য রাত পর্যন্ত মদ-বিয়ার বিক্রি করছে। যা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের বিভিন্ন ধারায় দণ্ডনীয় অপরাধ।
এতসব অনিয়মের পরও কেন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না জানতে চাইলে একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রতিবেদককে বলেন, ‘একটু অপেক্ষা করেন। যে কোনো মুহূর্তে আমরা অভিযান চালাব।’
এদিকে বুধবার রাত সাড়ে ৯টায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর হর্স অ্যান্ড হর্স রেস্টুরেন্টে অভিযান চালায়। এ সময় রেস্টুরেন্টেই অবস্থান করছিলেন মালিক মেহেরীন মনসুর।
তবে আগেই অভিযানের খবর পেয়ে তড়িঘড়ি বিএমডব্লিউ গাড়িতে চড়ে ঘটনাস্থল থেকে তিনি সটকে পড়েন। অভিযানে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ, বিয়ার, হুক্কা ও শিশা জব্দ করা হয়।
এসময় বারের ম্যানেজারসহ একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযানের সময় বারে মদ পান করতে আসা একাধিক তরুণী মুখ ঢেকে পালানোর চেষ্টা করেন। মদ্যপানরত বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি মোবাইল ফোনের আড়ালে মুখ ঢাকেন।
তাদের অনেকে কান ধরে ওঠবস করে ক্ষমা চান। তারা বলেন, জীবনে আর কোনোদিন মদ্যপান করব না, এবারের মতো ছেড়ে দেন। পরে মানবিক কারণে তাদের অনেককে সতর্ক করে ছেড়ে দেয়া হয়।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ঢাকা অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক ফজলুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমরা যখনই এ ধরনের অবৈধ মদ-বিয়ার বাণিজ্যের অভিযোগ পাই, সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নেয়া হয়।
মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গুলশান সার্কেলের পরিদর্শক সামসুল কবির বলেন, গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মাদক আইনে মামলা করা হবে।
এছাড়া রেঁস্তোরার মালিককে গ্রেফতারের চেষ্টা করবেন তারা। তদন্তে আরও যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদেরও আসামি করা হবে।
সরেজমিন : রেস্টুরেন্টটির বাস্তব অবস্থা দেখতে ২১ সেপ্টেম্বর মিডিয়া অনুসন্ধান টিমের সদস্যরা হর্স অ্যান্ড হর্স রেস্টুরেন্টে হাজির হন। রাত তখন ১০টা। ভেতরে ঢুকতেই বাঁধন নামের এক ওয়েটার এগয়ে এলেন।
হরেক রকম ব্র্যান্ডের মদের নাম লেখা মেনু দেখিয়ে বললেন, কোনটা নেবেন স্যার। কিন্তু মদের মূল্য দেখে হতবাক না হয়ে উপায় নেই। কারণ এক পেগ ব্লু-লেবেলের দাম লেখা আছে সাড়ে ৪ হাজার টাকা।
পুরো বোতল মদের দাম ১ লাখ টাকা। এমন আরও নানা ধরনের বাহারি মদের ককটেল বিক্রি হচ্ছে এখানে।
দেখা যায়, রাত যত গভীর হচ্ছে ততই জমে ওঠে রেস্টুরেন্ট। রাত ১০টার পর একে একে বিলাসবহুল সব গাড়ি এসে থামছে। পাশ্চাত্য পোশাকের ঢংয়ে তরুণ-তরুণী গাড়ি থেকে নেমে সোজা ঢুকে যাচ্ছেন রেস্টুরেন্টে।
আসছেন উঠতি মডেল থেকে শুরু করে শোবিজ জগতের তারকারাও। জানা গেল, মূলত ধনাঢ্য পিতা-মাতার বখে যাওয়া সন্তানরা এখানকার নিয়মিত খদ্দের। জমজমাট কেনাবেচা চলে ভোর ৫টা পর্যন্ত।
সূত্র জানায়, হর্স অ্যান্ড হর্স রেস্টুরেন্টের মালিক মেহেরীন মনসুর নামের জনৈক নারী। বিদেশে পলাতক বিতর্কিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের ভাইপোর স্ত্রী হিসেবে তার পরিচয় পাওয়া যায়।
আমেরিকা প্রবাসী মেহেরীন মনসুর নিজেও রাজসিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত। বর্তমানে তিনি ঢাকাতেই অবস্থান করছেন। নিয়মিত দেখভাল করেন হর্স অ্যান্ড হর্স রেস্টুরেন্টের মদ ব্যবসা।
শাফিউল্লাহ আল মুনির নামের জনৈক ব্যবসায়ী কাম রাজনীতিকের নাম ভাঙিয়ে রেস্টুরেন্টে মদের ব্যবসা করা হচ্ছে। অবৈধ মদ-বিয়ার ব্যবসা সম্পর্কে জানতে চাইলে রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার রাকিব দাবি করেন, তাদের বৈধ বার লাইসেন্স আছে,কিন্তু তিনি তা দেখাতে পারেননি ।
সূত্রঃ দৈনিক যুগান্তর।