ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ধর্ষণ যেন মহামারি আকারে রূপ নিয়েছে দেশে। শুধু এককভাবে নয়, গণধর্ষণের ঘটনাও ঘটছে অহরহ। প্রতিদিনই ধর্ষণ অথবা গণধর্ষণের খবর আসছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। এমনকি রাজশাহীতে গির্জার ফাদার পর্যন্ত ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন গত বুধবার। গতকালও শিশু এবং প্রতিবন্ধীসহ ৭ জনকে ধর্ষণের খবর এসেছে বিভিন্ন জেলা থেকে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মী কর্তৃক সিলেটের আলোচিত ধর্ষণের ঘটনার পরপরই গত বুধবার ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের আরেক নেতা গ্রেফতার হয়েছে একই অভিযোগে। আলোচিত এসব ধর্ষণের ঘটনা গুলোর মাঝেই বোমা ফাটিয়েছে আওয়ামী পন্থি একটি মানবাধিকার সংগঠন। গত ৯ মাসের একটি হিসাব দিয়েছে সংগঠনটি। ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতার ভয়াবহ চিত্র প্রকাশ পেয়েছে সংগঠনটির প্রতিবেদনে। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গত মঙ্গলবার সাফাই দিয়ে বলেছেন, সভ্য দেশেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। অপর দিকে বিরোধী দল গুলোর নেতারা বলছেন, স্ত্রী, কন্যা ও বোনকে নিয়ে বাসা থেকে বের হওয়ার আগে খোঁজ নিতে হবে গন্তব্যস্থলে ছাত্রলীগ আছে কি না।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের গতকাল বৃহস্পতিবার (১ সেপ্টেম্বর ২০২০) প্রকাশিত প্রতিবেদনে ৯ মাসের হিসাবে দেখা যায়, ৯৭৫ জন প্রাপ্ত বয়স্কা নারী এবং ৬২৭ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। অথাৎ তাদের হিসাবে মোট ১৬ শ’ ২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে গেল ৯ মাসে। প্রতিমাসে গড়ে ১৭৮টি ধর্ষণের ঘটনা মানবাধিকার সংগঠনটির রেকর্ডে উঠে এসেছে। এই হিসাবে দৈনিক প্রায় ৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে দেশে।
৯ মাসে মোট হিসাবে উঠে আসা চিত্রে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০৮ নারী। এই ৯ মাসে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৩ জন নারীকে। ধর্ষণের যন্ত্রণা সইতে না পেরে ১২ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন।
মানবাধিকার সংগঠনটির বৃহস্পতিবার প্রকাশিত রিপোর্টে আরো বলা হয়, তাদের তালিকায় লিপিবদ্ধ হিসাব অনুযায়ী রাস্তাঘাটে ১৬১ জন নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। যৌন হয়রানির শিকার হওয়া নারীদের মধ্যে ১২ জন আত্মহত্যা করেন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৩ নারী এবং ৯ পুরুষ নিহত হয়েছেন।
মানবাধিকার সংগঠন গুলো বিভিন্ন পত্র পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতিবেদন তৈরি করে থাকে। যেসব ঘটনা পত্র পত্রিকায় উঠে আসে সে গুলোই শুধু স্থান পায় তাদের প্রতিবেদনে।
এখানে উল্লেখ্য, সেপ্টেম্বর মাসের শেষ ১০ দিনেই ঘটেছে আলোচিত বেশ কয়েকটি ধর্ষণ ও কিশোরী খুনের ঘটনা। যেমন, গত ২০শে সেপ্টেম্বর সাভারে প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় স্কুলছাত্রী নীলা রায়কে প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। রাস্তায় আপন ভাইয়ের সামনেই তাঁকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছিল। ২৩শে সেপ্টেম্বর রাতে খাগড়াছড়ির বলপিয়ে আদাম এলাকায় চাকমা সম্প্রদায়ের এক নারীকে গণধর্ষণের পাশাপাশি তার ওপর বর্বর নির্যাতন চালানোর ঘটনাও বেশ আলোচিত হয়েছিল। অন্যদিকে ২৫শে সেপ্টেম্বর সিলেট নগরীর টিলাগড় এলাকায় এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে স্থানীয় ছাত্রলীগের কতিপয় কর্মী কর্তৃক স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় দেশজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠে ।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদনে নারীর প্রতি সহিংসতার আরো কিছু ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, গত ৯ মাসে ৪৩২ নারী পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে হত্যার শিকার হন ২৭৯ নারী এবং পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৭৪ নারী। যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ১৬৮ নারী। এর মধ্যে যৌতুকের কারণে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৭৩ জন। যৌতুকের জন্য শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে ৬৬ জনকে এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ১৭ জন নারী। এছাড়া স্বামীর গৃহ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন ১২ নারী। এ সময়ের মধ্যে ১১ জন গৃহকর্মী হত্যার শিকার হন এবং ৩২ জন গৃহকর্মী বিভিন্ন ধরণের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এছাড়া ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ২ জন। এছাড়া এ সময়কালে এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ২১ নারী। শিশু নির্যাতন ও হত্যার গত ৯ মাসের পরিসংখ্যানও অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এ সময়কালে ১০৭৮ শিশু শারীরিক নির্যাতনসহ নানা সহিংসতার শিকারসহ হত্যার শিকার হয়েছে। শিশু হত্যার সংখ্যা ৪৪৫ জন ।
আওয়ামীপন্থী মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবেই এমন ভয়াবহ চিত্রে দেশের আইন শৃঙ্খলা এবং নারী ও কন্যা শিশুদের নিরাপত্তাহীনতা যে কতটা ভয়াবহ তা অনুমান করা সহজ। সমাজে এই নির্মমতা ছড়িয়ে পড়ায় উদ্বিগ্ন প্রতিটি বাংলাদেশী।