ব্যারিস্টার আবু সায়েমঃ বিচারক ডেভিড ওয়াইল্ড যখন বলেছিলেন, ‘মেয়েদের সব ‘না’-ই না নয়। (Women who say 'no' do not always mean no.)’, বিলেতে তখন হইচই পড়ে গিয়েছিল। সেটা ১৯৮২ সালের কথা। ধর্ষণের একটি মামলার রায়ে এমন উচ্চাভিলাষী মন্তব্য করে নারীবাদীদের চরম তোপের মুখে পড়েন মি. ওয়াইল্ড।
সে ধারাবাহিকতায় ইংলিশ জুরিসপ্রুডেন্স সত্যিকারের একটি মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলতে সময় নেয় আরো এক দশক। তবে কমন ল অনুসরণ করা সব দেশ কিন্তু একই পথে হাঁটেনি। ফলত, ধর্ষণের সংজ্ঞা দেশভেদে ভিন্নতর ও বিচিত্র। ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সমাজ, রাষ্ট্র ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক পার্থক্যই সম্ভবত এর মূল কারণ। বিচারক ওয়াইল্ড সুখকর কোনো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার স্মৃতিকে সামনে রেখেই হয়তো ললনাদের ‘না’ বলাকে সত্যিকারের না বলে মেনে নিতে নারাজ ছিলেন। কিন্তু সবাই তো আর ডেভিড ওয়াইল্ডের ভাগ্য নিয়ে জন্ম নেয় না। Tamaitirua Kaitamaki v R [১৯৮৪] UKPC ১৫-এর লর্ডদের অভিজ্ঞতা হয়তো ভিন্ন ছিল। বাস্তব জীবনে কোথাও না কোথাও তারা যথার্থই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, ‘না’ বলতে না-ই বোঝায় এবং সেই ‘না’র স্থান-কাল-পাত্রও নির্দিষ্ট করা থাকে না। রমণীর প্রাথমিক আমন্ত্রণ তাই অপরিবর্তনীয় কোনো সম্মতি নয়। যৌনমিলনের যে কোনো পর্যায়ে একজন নারী চাইলেই তার সম্মতি তুলে নিতে পারে। সে অবস্থায় পুরুষটি যদি তার জৈবিক চাহিদা পরিপূর্ণ করতে মেয়েটির ওপর জোর খাটায়, তাহলে সে ধর্ষণ করেছে বলে ধরে নেওয়া হবে। বিলেতে যখন আইন নিয়ে লেখাপড়া করছিলাম, মনে আছে, বন্ধুরা কেউই Kaitamaki মামলার বিচারকদের সঙ্গে একমত হতে পারেনি। এমনকি শিক্ষকদেরও দেখেছি, না-সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়াতে।
Kaitamaki-র ঘটনাটি ছিল চমকপ্রদ, যা কৌতূহল প্রশমনে জানা দরকার। নিউজিল্যান্ডের জুরিসডিকশন থেকে প্রিভি কাউন্সিলে (Privy Council) আসা দুইটি অ্যাপিল শুনেছিলেন পাঁচ জন লর্ড। রায় ডেলিভারি দিয়েছিলেন লর্ড স্কারম্যান (Lord Scarman)। দুই-দুই বার ভিকটিমের ফ্ল্যাটে ঢুকে তাকে ধর্ষণ করার দায়ে এ মামলার আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। দুই বার যে যৌনমিলন হয়েছে, তা নিয়ে কোনো পক্ষের বিরোধ ছিল না। কিন্তু আসামির দাবি, তাতে ভিকটিমের সম্মতি ছিল কিংবা তার বিশ্বাস করার কারণ ছিল যে, অপরপক্ষ সম্মতি দিচ্ছে। তবে দ্বিতীয়বার সহবাসের কোনো এক পর্যায়ে ভিকটিম সম্মতি তুলে নিয়েছে জেনেও আসামি নিজেকে সংগম থেকে নিবৃত্ত করেনি বা করতে পারেনি। ফলে তার আপিল খারিজ হয়ে যায় এবং ধর্ষণের দায়ে তার বিরুদ্ধে প্রদত্ত দণ্ডাদেশ বহাল থাকে।
এসব তো গেল বিবাহবহির্ভূত যৌনমিলনের কথা। বৈবাহিক কিংবা লিভ-টুগেদার সম্পর্কের ভেতরেও যে ধর্ষণ সংঘটিত হতে পারে ১৯৯১ সালের আগে ইংলিশ ক্রিমিনাল ল-তে তার স্বীকৃতি ছিল না। R v R [১৯৯১] ৩ WLR ৭৬৭ মামলাটিতে House of Lords যখন আইন পরিবর্তন করে বলল, সম্মতিবিহীন সহবাসের জন্যে স্বামীকেও ধর্ষণের অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত করা যাবে, তখন কেবল বিলেতেই নয়, গোটা দুনিয়ার আইনি পাড়াতে ঝড় বয়ে গিয়েছিল। এর আগে ধরেই নেওয়া হতো, বিয়ের চুক্তির মাধ্যমে একজন স্বামী অধিকার পেয়ে যায় তার স্ত্রীকে যৌনমিলনে বাধ্য করতে। মনে করা হতো, চুক্তির দিনই এ মর্মে স্ত্রী তার নিঃশর্ত সম্মতিটি দিয়ে রেখেছে, যা আর নবায়নের দরকার পড়ে না। ২৩ অক্টোবর ১৯৯১ সালে ঘোষিত ঐতিহাসিক রায়ে House of Lords বলেন, ‘…আধুনিক সময়ে ধর্ষণের অনুমিত বৈবাহিক দায়মুক্তি ইংল্যান্ডের আইনের কোনো অংশ নয়।’
তবে পৃথিবীর আর সব দেশের ক্রিমিনাল জাস্টিস ইংলিশ জুরিসপ্রুডেন্সের এমন পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছে তা নয়। বরং অধিকাংশ দেশেই বৈবাহিক ধর্ষণের কনসেপ্ট এখনো এক কথায় উড়িয়ে দেওয়ার মতো একটি বিষয়। বাংলাদেশের আদালতও আজতক এজাতীয় কোনো মামলার মুখোমুখি হয়েছে বলে আমার জানা নেই। বস্তুত, Penal Code আমাদের দেশে বৈবাহিক ধর্ষণ বলতে কোনো কিছুর প্রায়োগিক অস্তিত্বই রাখেনি। কেবল ১৩ বছরের কম বয়সি স্ত্রীরাই এ অভিযোগ আনতে পারবে! আবার যৌনমিলনের যে কোনো পর্যায়ে একজন নারীর সম্মতি তুলে নেওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া কিংবা বৈবাহিক ধর্ষণের নতুন সংজ্ঞা রচিত হওয়ার মানে এই নয় যে, ধর্ষণের সব মামলায় স্ত্রীজাতি বিচারকদের সহানুভূতি লাভ করেছে। অনেক ক্ষেত্রে বরং উলটোটা ঘটেছে। কিছু উদাহরণ দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। ২০১৭ সালে দিল্লি হাইকোর্টের বিচারক আশুতোষ কুমার নিম্ন আদালতের একটি রায় আপিলে অভিযুক্ত ধর্ষকের পক্ষে উলটে দিয়েছিলেন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘নারী আচরণের এমন সব উদাহরণ অজানা নয়, যাতে অতি দুর্বল ‘না’ বলতে হ্যাঁ বোঝাতে পারে।’ তার যুক্তি ছিল, ‘কামশক্তি দ্বারা সক্রিয় গভীর আসক্তির কোনো কাজে সম্মতি একটি জটিল বিষয় হতে পারে এবং সব সময় ‘হ্যাঁ’ মানে অপরিহার্যভাবে ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ মানে ‘না’ও হতে পারে।’ ২০১৪ সালে ক্যানাডিয়ান বিচারক রবিন ক্যাম্প ধর্ষণের শিকার ১৯ বছর বয়সি একটি মেয়েকে প্রশ্ন করে বসেছিলেন, ‘Why couldn't you just keep your knees together?’ ২০১৯ সালের আগস্টে লন্ডনের কেন্দ্রীয় ফ্যামিলি কোর্টের টপ বিচারক রবিন টলসন সাবেক পার্টনারের বিরুদ্ধে একজন আবেদনকারী মায়ের ধর্ষণের অভিযোগ খারিজ করে দেন। আংশিক কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘…the mother did nothing physically to stop the father.’ টেক্সাসের বিচারক জেনি হাওয়ার্ড একজন নারী হয়েও ধর্ষককে মাত্র ৪৫ দিন জেল খাটার শাস্তি দিয়ে যুক্তি দেখিয়েছিলেন, ‘ভুক্তভোগী যেমনটি দাবি করেছে, তেমনটি সে নয়।’
বৈবাহিক ধর্ষণের অভিযোগ প্রদান কিংবা যৌনমিলন থেকে ইচ্ছেনুযায়ী প্রত্যাহারের আইনি অধিকার পশ্চিমা ললনাদের হাতে থাকলেও, মজার বিষয়, ধর্ষণের জুরিসপ্রুডেন্স সমৃদ্ধিকরণে পাশ্চাত্যকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছে আমাদের দেশের নারীরা। সম্প্রতি কথিত কিছু ভিকটিম দাবি করছে, তাদের বালক বন্ধুরা বিয়ের আশ্বাস দিয়ে তাদের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক পেতেছে, কিন্তু শেষমেশ আর তাদের বিয়ে করেনি। ‘ভিকটিম’রা কেউ থানায় গিয়ে মামলা করেছে, কেউ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে, কেউ-বা আবার মিডিয়ার দ্বারস্থ হয়েছে। তাদের সবার কণ্ঠে একই অনুযোগ, ‘অপরাধী’রা তাদের ধর্ষণ করেছে, যদিও যৌনমিলনটা ঘটেছিল তাদের সম্মতি ও ইচ্ছেতেই। জাতীয় দলের এক ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে একজন চিত্রনায়িকার এমন একটি মামলার খবর গণমাধ্যমে অনেক দিন চাউর ছিল। একেবারে হালে, সরকারবিরোধী একটি প্ল্যাটফরমের একজন ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনে সেসহ কয়েক জনের নামে মামলা ঠুকে দিয়েছে সরকারি ছাত্রসংগঠনের এক নারী কর্মী। যৌনমিলনে উভয় পক্ষের ইচ্ছে ও সম্মতি থাকলেও ধর্ষণ সংঘটিত হতে পারে, প্রচলিত সংজ্ঞার সঙ্গে সাংঘর্ষিক একটি চমকপ্রদ ন্যারেটিভ সামনে চলে এসেছে। বিবাহের প্রতিশ্রুতি, সম্মতিসূচক যৌনমিলন, অতঃপর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ—মোটামুটি এ তিনটি হবে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত ধর্ষণের উপাদান। কনসেপ্টটি অভিনব সন্দেহ নেই, কিন্তু বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে।
প্রথমেই প্রশ্ন জাগবে মনে, ঘটনার কোন পয়েন্টে এসে ধর্ষণ নামক অপরাধটির Actus Reus সম্পন্ন হবে? কে না জানে, ক্রিমিনাল অফেন্স Actus Reus I Mens Rea ছাড়া সংঘটিত হতে পারে না। Strict Liabilty অপরাধসমূহের ক্ষেত্রে যদিও Mens Rea-এর দরকার পড়ে না, কিন্তু ধর্ষণ মোটামুটি সে আওতার বাইরে (ব্যতিক্রম শুধু মেয়েটির বয়স ১৪ বছরের নিচে হলে)। আমাদের Penal Code অনুযায়ী ধর্ষণের যে সংজ্ঞা, তাতে যৌনমিলনের পেনিট্রেশন পয়েন্টে অপরাধ সংঘটিত হয়। কিন্তু শর্ত হচ্ছে, যৌনমিলনটি হতে হবে অপর পক্ষের সম্মতি বা ইচ্ছে ছাড়া। বাস্তবতা হলো—বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে কোনো মেয়ে যখন একটি ছেলের সঙ্গে সহবাসে লিপ্ত হয়, এ কাজে তার ইচ্ছে ও সম্মতি দুটোই থাকে। ফলে Penal Code’র বাতলে দেওয়া পথে Actus Reus সংঘটিত হয় না। আরো বড় সমস্যা হলো—বিয়ের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ না হলে কথিত ভিকটিমও যৌনমিলনটিকে কখনো ধর্ষণ বলে দাবি করবে না। সেক্ষেত্রে এ প্রকারের দৈহিক সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে অপরাধের Actus Reus সংঘটিত হবে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের পয়েন্টে, পেনিট্রেশনের পয়েন্টে নয়। কিন্তু হতাশার বিষয়, এটা অবান্তর এবং কোনোভাবেই Penal Code’র শর্ত পূরণ করে না। এতে অপরাধের একটি নিয়ামক পুরোপুরিই বাদ থেকে যায়। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ছেলেটি যদি ‘প্রতারণা’ও করে, তা ধর্ষণের সংজ্ঞায় পড়বে না। Actus Reus কখন সম্পন্ন হবে? তাছাড়া প্রতারণা আর ধর্ষণের উপাদানও ভিন্ন। তখন ৩৭৫-৩৭৬ ধারা বাদ দিয়ে Penal Code-এর ৪১৫-৪২০ ধারার আশ্রয় নিতে হবে। ধর্ষণ অধরাই থেকে যাবে।
আমাদের ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যবস্থাতেও বিয়ের প্রতিশ্রুতি কোনোক্রমেই নারী-পুরুষের দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনকে যথার্থতা প্রদান করে না। তাই কোনো মেয়ে যদি তার সম্ভাব্য বরের সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত যৌনমিলনে রাজি হয়, সেটি তার নিজ দায়িত্বেই করতে হবে, কোনো প্রতিশ্রুতির ওপর ভর করে নয়। সন্দেহ নেই, প্রতিশ্রুতি কখনো বিয়ের গ্যারান্টি হতে পারে না।
কেউ কেউ হয়তো প্রতিশ্রুতি বা আশ্বাসকে চুক্তি আর চুক্তিভঙ্গকে ধর্ষণের উপাদান হিসেবে বিবেচনা করতে চাইবে। তাতেও ঝামেলা আছে। উপযুক্ত প্রতিদান (consideration) ছাড়া চুক্তি বলবৎযাগ্য হয় না। বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে প্রতিদান কোথায়? মেয়েটি হয়তো বলতে পারে, তার যৌনমিলনে সম্মতি দেওয়াটাই পর্যাপ্ত প্রতিদান। কিন্তু সেটা কি একতরফা হবে না? সংগমে উভয় পক্ষেরই প্রতিদান থাকে, যেহেতু সম্পর্কটা উপভোগ করে নারী-পুরুষ উভয়েই। তাছাড়া আবেগ-ভালোবাসা-প্রণয় উপযুক্ত প্রতিদান হতে পারে বলে আইনে এখনো স্বীকৃত নয়। আবার এসব মানবীয় অনুভূতির অর্থনৈতিক মূল্যও নেই। তা সত্ত্বেও যদি ধরে নেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হয়েছে, সেটি হবে দেওয়ানি মামলার আওতাধীন, ফৌজদারি নয়। বিয়ের চুক্তি ভঙ্গকারীকে সেক্ষেত্রে বড়জোর জরিমানা গুনতে হতে পারে, কিন্তু ধর্ষণের দায়ে তার দণ্ডিত হওয়ার সুযোগ নেই। জানিনা, Lord Denning বেঁচে থাকলে ভুক্তভোগী কোনো উচ্চাভিলাষী রমণী তার প্রমিসরি এস্টোপেলের (Promisory Estoppel) সুযোগ নিতে চাইত কি না। তবে সেক্ষেত্রেও Denning সাহেব উপযুক্ত প্রতিদান খুঁজতেন বলেই আমার বিশ্বাস।
বিয়ের প্রতিশ্রুতি থেকে যৌনমিলন, অতঃপর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ থেকে ধর্ষণের অভিযোগ—ধর্ষণের এমন উচ্চতর জুরিসপ্রুডেন্স সৃষ্টির সম্ভাবনা নিয়ে জুরিস্টদের হয়তো নতুন করে ভাবতে হবে।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী আইনজীবী।