DMCA.com Protection Status
title="৭

নিক্সন চৌধুরীর বিরুদ্ধে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে নালিশ এবং তার বিরুদ্ধে ইসির মামলা।

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ  ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জেলা প্রশাসক (ডিসি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ (ইউএনও) স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করেছেন ফরিদপুর-৪ আসনের মিডনাইট সংসদ সদস্য এবং শেখ হাসিনার পরম আত্মীয় মজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন)।

ডিসি-ইউএনওসহ নির্বাচনে দায়িত্বরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের অত্যন্ত মানহানিকর ও অশ্রাব্য ভাষায় হুমকি ও গালিগালাজ করেছেন তিনি ও তার অনুসারীরা।

বিষয়টিকে নির্বাচনী আচরণবিধির পরিপন্থী উল্লেখ করে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দিয়েছেন ফরিদপুরের ডিসি অতুল সরকার। এর পরিপ্রেক্ষিতে আইনগত ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) চিঠি দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় চলছে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়সহ অফিসপাড়ায়।

সোমবার ইসিতে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়, ১০ অক্টোবর চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার স্বার্থে নির্বাচন কমিশন এবং স্থানীয় সহকারী রিটার্নিং অফিসারের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়া হয়।

এ বিষয় নিয়ে হুমকি, মিথ্যা, মানহানিকর ও অশালীন বক্তব্য দেন স্থানীয় সংসদ সদস্য (স্বতন্ত্র) মজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন), চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদের বিজয়ী চেয়ারম্যান মো. কাউছার এবং তার অনুসারীরা। তাদের এহেন আচরণ উপজেলা পরিষদ (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা-২০১৬ এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন মর্মে প্রতীয়মান হয়। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে।

এর আগে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে পাঠানো চিঠিতে ডিসি অতুল সরকার বলেন, নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়ায় ডিসি অতুল সরকারের কাছে টেলিফোনে কৈফিয়ত তলব করেন মজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন)। ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়ার কারণে তার সমর্থিত প্রার্থীর পরাজয় হলে মহাসড়ক অবরোধসহ নানা ধরনের ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন তিনি।

চিঠিতে আরও বলা হয়, শনিবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নিক্সন চৌধুরীর সমর্থিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ১১ হাজারের বেশি ভোটে বিজয় লাভ করে। কিন্তু রাত সাড়ে ৮টার দিকে নির্বাচন-পরবর্তী জনসভায় নির্বাচন আচরণবিধি লঙ্ঘন করে বিজয়ী প্রার্থী মো. কাওছার ও সংসদ সদস্য ও তার অনুসারীরা ১২ জন ম্যাজিস্ট্রেট মোতায়েনের কথা উল্লেখ করে স্থানীয় জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে চরম বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা বলেন।

দায়িত্বপালনরত ম্যাজিস্ট্রেটসহ জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে অত্যন্ত মানহানিকর এবং অশ্রাব্য ভাষায় হুমকি ও গালিগালাজ করেন। তার অনুসারীরা বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ স্লোগান দেন যা একজন সংসদ সদস্য বা সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের পক্ষে অকল্পনীয়।

নির্বাচন আচরণবিধি ভঙ্গ করায় ভাঙ্গা উপজেলার এসি ল্যান্ড কর্তৃক একজনকে স্বল্পকালীন সময়ে আটকে রাখলে চরভদ্রাসনের ইউএনওকেও উচ্চারণ অনুপযোগী অত্যন্ত অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করেন তিনি।

জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে অত্যন্ত মানহানিকর ও অশোভন উক্তি জেলা পর্যায়ের সব ধরনের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সমন্বয়কারী জেলা প্রশাসনের মতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের জন্য অবমাননাকর।

এ ধরনের হীন বক্তব্য স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে সরকারের সাফল্য সম্পর্কে ভুল বার্তা দেবে। তেমনি মাঠ প্রশাসনের সততা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে কাজ করার পথেও চরম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানান ডিসি।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সোমবার রাতে  বলেন, নির্বাচন আচরণবিধি অনুযায়ী একজন সংসদ সদস্য কোনোভাবেই স্থানীয় নির্বাচনে সম্পৃক্ত হতে পারেন না।

তিনি নির্বাচন আচরণবিধি ভঙ্গ করেছেন। বিধিতে বলা আছে, নির্বাচনের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কোনো সভা-সমাবেশ করা যাবে না। কিন্তু নির্বাচনের দিন সন্ধ্যায় তিনি জনসমাবেশ করেছেন। এটা নির্বাচন আইনের লঙ্ঘন। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে নির্বাচন কমিশন।

নিক্সন চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনেরঃ

ফরিদপুর-৪ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরীর (নিক্সন) বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন উপজেলা নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘন করার অপরাধে এ মামলা দায়ের করা হবে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে রিটার্নিং কর্মকর্তা এ মামলা দায়ের করবেন। মঙ্গলবার কমিশন এসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আজ বুধবার মামলা নির্দেশনা সংক্রান্ত চিঠি রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ফরিদপুরের সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হবে। ইসি সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। মামলা দায়েরের সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে মঙ্গলবার রাতে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর  বলেন, মামলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে চিঠি এখনও যায়নি।

এর আগে দুপুরে নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা বলেন, নির্বাচনী আইনবিধি অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজনে মামলাও করা হবে। নির্বাচন পরিচালনার সময় একজন সংসদ সদস্য যে আচরণ করেছেন তা কাম্য নয়। তিনি আচরণবিধি ভঙ্গ করেছেন এবং আইনে যে বিধিবিধান আছে তার ব্যাপারে পরিপূর্ণভাবে সেই বিধান প্রযোজ্য হবে। সংসদ সদস্য হিসেবে এ ব্যাপারে আলাদাভাবে কোনো কিছু হবে না। সিইসির পাশে থাকা নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, আইনে যা আছে, সেই অনুযায়ী আমরা সবকিছু করার জন্য প্রস্তুত আছি। আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। দু-একদিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানতে পারবেন।

এদিকে মঙ্গলবার বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন ডেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) হুমকি দেয়ার ফোন রেকর্ডটি সুপার এডিট করা বলে দাবি করেন মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন। তিনি বলেন, ভয়েসটা আমারই না। আমার বিরুদ্ধে মামলা হলে ডিসি-ইউএনও’র বিরুদ্ধেও মামলা হতে হবে। তিনি আরও বলেন, এই ভয়েসটা আমারই না। প্রথমে আমি এসি ল্যান্ডকে ফোন করেছিলাম। ‘আমি দেখছি’ বলে এসি ল্যান্ড ফোনটা বন্ধ করে দেয়। পরে আমি আপাকে (ইউএনও) ফোন করলাম যে, আপা আমার এ রকম একটা লোক ধরা পড়েছে আপনি একটু দেখেন, তার কোনো অন্যায় হয় নাই। সে মাঠে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল। তাকে বিজিবি ধরে নিয়েছে, আপনি একটু ব্যবস্থা নেন। এই কথাটুকুই আমি তাকে বলেছি। বাকি কোনো কথা আমার না। এটা ইউএনও সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলেই পাবেন।

সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রকাশিত গালিগালাজের বিষয়ে তদন্ত হওয়া উচিত জানিয়ে নিক্সন চৌধুরী বলেন, আমার আর ইউএনওর কথাই শুধু ভাইরাল হয়নি, পুলিশ প্রশাসন ও ইউএনওর কথাও ভাইরাল হয়েছে। এটা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার জন্য কোনো মহল কাজটা করেছে। এটা সরকারের দায়িত্ব খুঁজে বের করা। আমার বিরুদ্ধে মামলা হলে তবে ডিসির বিরুদ্ধে মামলা হবে। আমি যদি নির্বাচনী আইন ভঙ্গ করি তাহলে পরদিন সকালে ডিসি সাহেব নির্দেশ দিয়ে ইউএনওকে কেন আমার বাড়িতে পাঠালেন? ইউএনও কি নির্বাচনকালীন ৪৮ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে আমার বাড়িতে আসতে পারেন? তাহলে তো তিনিও আইন ভঙ্গ করেছেন। আমার কথা হল, আমি যদি আইন ভঙ্গ করে থাকি তাহলে ডিসি সাহেব আইন ভঙ্গ করেছেন, নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন করেছেন। তার বিরুদ্ধেও ক্যাবিনেটে ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আমি যদি কোনো আইন ভঙ্গ করে থাকি তবে অবশ্যই আমার বিরুদ্ধে মামলা হবে। আমার একার বিরুদ্ধে কেন মামলা হবে? আইন ভঙ্গ তো ডিসিও করেছেন।

ইসি সূত্র জানায়, ১০ অক্টোবর ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচন কেন্দ্র করে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের হুমকি ও নির্বাচন কর্মকর্তাদের গালিগালাজ করেন নিক্সন চৌধুরী। এ ঘটনায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে অশোভন আচরণের বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে নির্বাচন কমিশনেও চিঠি দেয়। সূত্র আরও জানায়, ওই চিঠি পর্যালোচনা করে কমিশন সচিবালয় উপজেলা পরিষদ (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা অনুযায়ী মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিধিমালা লঙ্ঘনের দায়ে সর্বোচ্চ ৬ মাস কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।

নিক্সন চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে সিইসি আরও বলেন, আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে। আমরাও সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি জেনেছি। নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বৈঠক করেছি। তিনি বলেন, নির্বাচন পরিচালনার সময় একজন মাননীয় সংসদ সদস্য যে আচরণ করেছেন তা কাম্য নয়। তিনি আচরণবিধি ভঙ্গ করেছেন এবং আইনে যে বিধিবিধান আছে তার ব্যাপারে সেই বিধান প্রযোজ্য হবে পরিপূর্ণভাবে। সংসদ সদস্য হিসেবে এ ব্যাপারে আলাদাভাবে কোনো কিছু হবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচন হয়ে যাওয়ায় এখন সামারি ট্রায়ালের সুযোগ নেই। তবে আইনে যেটা আছে তা হবে। যদি মামলা করার প্রয়োজন হয়, মামলাই করব। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগে নির্বাচনগুলোতে দু-একটি জায়গায় সংসদ সদস্যরা যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, আমরা ব্যবস্থা নেয়ায় তারা আর যাননি। কিন্তু ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলা নির্বাচনে তিনি গেছেন। আইনে যা আছে আমরা সেই অনুযায়ী তার ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেব।

নির্বাচনে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে কিছু করার নেই : ঢাকা-৫ ও নওগাঁ-৬ আসনে উপনির্বাচনে প্রচার এবং ঢাকা-১৮ ও সিরাজগঞ্জ-১ আসনে মনোনয়নপত্র দাখিলের সময়ে প্রার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি না মানার বিষয়ে জানতে চাইলে কেএম নূরুল হুদা বলেন, এ বিষয়ে আমরা অনুরোধ করতে পারি এবং সর্বক্ষেত্রে আমরা সেই অনুরোধ করে আসছি। তবে তারা না মানলে আমাদের কিছু করার নেই। তিনি বলেন, প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সবগুলোতে তাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে নির্বাচন পরিচালনার অনুরোধ করে থাকি। স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে আমাদের নির্বাচনী আচরণবিধিতে কিছুই নেই। তারা যদি মাস্ক না পরেন তাহলে তাদের কি করব না করব সে বিষয়ে কিছু বলা নেই আচরণবিধিতে। এগুলো সম্পূর্ণ তাদের নিজেদের ব্যক্তি সচেতনতার বিষয়।

সিইসি বলেন, শুধু প্রার্থী কেন, বাংলাদেশের যেখানে আমরা যাই সেখানেই দেখি স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের বিষয়টি উপেক্ষিত থাকে। হাটে-বাজারে জনসমাবেশের প্রত্যেকটি জায়গায় এটা দেখছি। আমরা বারবার অনুরোধ করতে পারি। তারা না মানলে আমাদের কিছু করার নেই। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, করোনার কারণে আর কোনো নির্বাচন পেছাবে না। স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে যেভাবে তালিকা দেয়া হবে সে অনুযায়ী নির্বাচন হবে।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!