ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বিশ্বজুড়ে ফ্যান্সের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছে। দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ছে বিক্ষোভ ও সে দেশের পণ্য বর্জন। বাংলাদেশেও চলছে বিক্ষোভ। বইছে সমালোচনা ও প্রতিবাদের ঝড়। এ ঘটনা ধর্মীয় অনুভূতির চরম আঘাত হিসেবে দেখা হলেও ফ্রান্স এটাকে তাদের বাক-স্বাধীনতা বলে দাবি করছে।
ফ্রান্সের ওই খোড়া যুক্তি এবং মহানবীর (সা.) ব্যঙ্গচিত্র নিয়ে যৌক্তিক সমালোচনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজে একটি পোস্ট করেছেন। ইনকিলাব পাঠকদের জন্য তা হুবহু তুলে ধরা হলো,
মহানবী (সাঃ)এর ব্যঙ্গচিত্র ও বাক-স্বাধীনতাঃ
বছর পঁচিশ আগে ইংল্যান্ডের ফুটবল দলের ম্যানেজার ছিলেন গ্লেন হডল। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা অবস্থায় প্রতিবন্ধী ব্যাক্তির সাথে পূর্বজন্মের কাজের সম্পর্ক নিয়ে তিনি একটি হৃদয়বিদারক মন্তব্য করে বসেন। সেখানে তার সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। তাকে চাকরি হারাতে হয় এবং বহু বছর তিনি সামাজিকভাবে বয়কট অবস্থায় থাকেন। তখন কিন্তু তার বাক-স্বাধীনতার কথা কেউ বলেনি।
জার্মানীতে নাৎসীদের পক্ষে কিছু বললে বা হলোকসট্ সম্পর্কে আপত্তিককর কিছু বললে শাস্তির বিধান আছে। কেউ তাদের বাক-স্বাধীনতাকে সমর্থন করেনা।
আমাদের দেশে মুক্তচিন্তার একজন সাংবাদিক হিন্দু ধর্মের দেবীকে নিয়ে একটি অনাকাংঘিত বক্তব্য দেয়ার পর তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন। তখন কিন্তু আমরা তার বাক-স্বাধীনতার কথা বলিনি।
এসব উদাহরণের মানে হচ্ছে বাক-স্বাধীনতা পৃথিবীর কোথাও আনলিমিটেড বা অসীম না। পৃথিবীর বহু দেশের সংবিধান ও আইনে বাক-স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। যৌক্তিক মাত্রায় ও জনস্বার্থে হলে এসব সীমাবদ্ধতা আরোপ স্বাভাবিক এবং গ্রহনযোগ্য।
সমস্যা হচ্ছে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল এর বিষয়েও বাক-স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতার থাকা উচিত – এটা যেন কেউ কেউ মানতে চান না। ফ্রান্সের এখানকার ঘটনার দিকে তাকালে আমরা তা বুঝতে পারি।
ফ্রান্সে তার ব্যঙ্গচিত্র নিয়ে যা হচ্ছে তা অবশ্যই তীব্রভাবে নিন্দনীয়। জেসাসকে নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করলে তার অনুসারীদের কিছু না এসে গেলে তাকে নিয়ে তা হয়ত করা যাবে। কিন্তু আমাদের নবীকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে তার অনুসারীদের মনে আঘাত লাগলে তা থেকে অবশ্যই সবার বিরত থাকা উচিত। কারন বাক-স্বাধীনতার সীমারেখা টানা হয় প্রধানত মানুষের উপর এর প্রভাবকে (যেমন মানহানি, ধর্মীয় অনুভূতি, অপরাধে উস্কানি) বিবেচনায় রেখে। এসব বিবেচনায় বহু বিষয়ে যদি বাক-স্বাধীনতার সীমা মানা হয়, পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ধর্মের সবচেয়ে বড় নবী সম্পর্কে তা কেন করা যাবে না?
কেউ কেউ বলছেন ফ্রান্সে বসতি গড়লে তাদের মতো মন-মানসিকতার হতে হবে মুসলমানদের। তাদের প্রশ্ন ফ্রান্সে না হলে থাকতে গেছে কেন মুসলমানরা? আমার মতে, এসব বলা অযৌক্তিক। কারণ, ফ্রান্সে মুসলমানরা গেছে প্রধানত সেসব আফ্রিকান দেশ থেকে যেখানে ফ্রান্সের চরম নি’পীড়নমূলক ঔপনিবেশিক শাসন ছিল, যেসব দেশে তারা যু’দ্ধ বাধিয়েছে, এবং যেসব দেশে তেল-গ্যাস সম্পদের উপর তাদের দখলদারিত্ব বজিয়ে রেখেছে। যেসব দেশের সম্পদ লু’ট করতে তারা গিয়েছিল সেখানে গিয়ে কি তারা তাদের সাথে মানানোর চেষ্টা করেছিল? তাহলে তাদের ভিকটিমদের একাংশ বাধ্য হয়ে তাদের দেশে বসতি গড়ে নিজের ধর্মীয় মূল্যবোধকে কেন বিসর্জন দিবে?
মহানবীর (দ:) ব্যাঙ্গচিত্র নিয়ে ধর্মীয় আবেগে তাদের প্রতিবাদ সমথন করি। কিন্তু ধর্মীয় উন্মাদনায় হ’ত্যা কোনভাবে সমর্থন করিনা। আমার জানামতে, আমাদের নবী (দ:) নিজেই উনার নি’গ্রহকারী ও অবমাননাকারীদের এমন শাস্তি দেননি। এসব হ’ত্যা বরং নি’ষ্ঠুরভাবে মানুষের জীবনের অধিকার কেড়ে নেয়, আমাদের শান্তির ধর্ম সম্পর্কে ভুলবার্তা দেয়, বিশ্বব্যাপী বহু মুসলমানকে নানান ভোগান্তিতে ফেলে।
ধর্মীয় উন্মাদনা নিন্দনীয়। তবে ধর্মীয় আবেগকে আ’ঘা’ত করে যারা এসব উ’স্কে দেন তাদের কর্মকান্ডও নিন্দনীয়। যেসব মুসলিম শাসক অন্যায়ভাবে ক্ষমতায় থাকতে ফ্রান্সের মতো দেশে এসব কাজের প্রতিবাদ করেন না তারাও নিন্দনীয়।’
উল্লেখ্য, ১৬ অক্টোবর মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে একটি বিতর্কিত কার্টুন দেখিয়ে ক্লাস নেয়ার জেরে খুন হন ফ্রান্সের প্যারিসের এক শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটি। ওই শিক্ষকের প্রতি সম্মান দেখাতে ফ্রান্সের সরকারি ভবনে প্রদর্শন করা হচ্ছে পত্রিকা শার্লি এবদোর প্রকাশিত মহানবীর বিতর্কিত ব্যঙ্গচিত্রগুলো। ফ্রান্সের সরকারি বহুতল ভবনেও প্রজেক্টরের মাধ্যমে এখনো ব্যঙ্গচিত্রগুলো প্রদর্শন করা হচ্ছে। এটিকে বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা ইসলামের প্রতি চরম অবমাননা বলে প্রতিবাদ জানিয়েছে।