ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ মিশরের বিখ্যাত ইসলামিক স্কলার ড. ইউসুফ আল কারযাভী বলেছেন, ‘ইসলামে মূর্তি ও ভাস্কর্য অবৈধ।’ তিনি এই বিধানগত দিক ছাড়াও ইসলামের মৌলিক আদর্শ ও চেতনার সঙ্গে মূর্তি ও ভাস্কর্যের বিরোধ সম্পর্কে প্রমাণসিদ্ধ আলোচনা করেন।
তার আলোচনার সারসংক্ষেপ তুলে হল: ক. ইসলামে প্রাণীর প্রতিকৃতি নিষিদ্ধ হওয়ার অন্যতম তাৎপর্য হল, মুসলমানের চিন্তা-চেতনা এবং মন-মানসকে শিরকের কলুষ থেকে পবিত্র রাখা। তাওহীদের বিষয়ে ইসলাম অত্যন্ত সংবেদনশীল। এবং এটা অত্যন্ত যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত। কেননা, অতীত জাতিসমূহে মূর্তির পথেই শিরকের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল।
খ. কোনো কোনো ভাস্কর তার নির্মিত বস্ত্তর ব্যাপারে এতই মুগ্ধতার শিকার হয়ে যায় যে, যেন ওই প্রস্তরমূর্তি এখনই জীবন্ত হয়ে উঠবে! এখনই তার মুখে বাক্যের স্ফূরণ ঘটবে! বলাবাহুল্য, এই মুগ্ধতা ও আচ্ছন্নতা তাকে এক অলীক বোধের শিকার করে দেয়। যেন সে মাটি দিয়ে একটি জীবন্ত প্রাণী সৃষ্টি করে ফেলেছে! এজন্যই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-‘যারা এইসব প্রতিকৃতি প্রস্ত্তত করে তাদেরকে কিয়ামতের দিন আযাব দেওয়া হবে। তাদেরকে বলা হবে, ‘যা তোমরা সৃষ্টি করেছিলে তাতে প্রাণসঞ্চার কর।’
গ. আরো দেখা যায় যে, এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা কোনো সীমারেখার পরোয়া করে না। নগ্ন ও অর্ধনগ্ন নারীমূর্তি, মূর্তিপূজার বিভিন্ন চিত্র ও নিদর্শন ইত্যাদি সবকিছুই নির্মিত হতে থাকে।
ঘ. তদুপরি এগুলো হচ্ছে অপচয় ও বিলাসিতার পরিচয়-চিহ্ন। বিলাসী লোকেরা বিভিন্ন উপাদানে নির্মিত প্রতিকৃতিসমূহের মাধ্যমে তাদের কক্ষ, অট্টালিকা ইত্যাদির ‘সৌন্দর্য বর্ধন’ করে থাকে। ইসলামের সঙ্গে এই অপচয় ও বিলাসিতার কোনো সম্পর্ক নেই।
কীর্তিমানদের স্মৃতিরক্ষার প্রশ্নে ইসলামী আদর্শ এবং অনৈসলামিক পদ্ধতি সম্পর্কে তুলনামূলক আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘মানুষ যত বড়ই হোক না কেন তার প্রকৃত অবস্থা থেকে তাকে উন্নীত করা ইসলামের দৃষ্টিতে নিন্দিত। স্বয়ং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নিজের সম্পর্কেও সাবধান করে বলেছেন, ‘তোমরা আমার এমন অবাস্তব প্রশংসা করো না যেমন খৃষ্টানরা ঈসা ইবনে মারইয়াম সম্পর্কে করেছে। তোমরা আমার সম্পর্কে বলবে, আমি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।’ (সহীহ বুখারী)
শ্রদ্ধা নিবেদনের ব্যাপারে যে দ্বীনের আদর্শ এই সে কখনও কোনো মানুষের সম্মানে মূর্তির মতো স্মারকস্তম্ভ নির্মাণে সম্মত হতে পারে না, যার পিছনে অজস্র অর্থ ব্যয় করা হবে, যার প্রতি ভক্তি ও সম্মানের সঙ্গে লোকেরা অঙুলি নির্দেশ করবে।
ইসলামের দৃষ্টিতে অমরত্ব লাভ হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে। এই অমরত্বই মুমিনের লক্ষ্য। আর যেসব ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যেও স্মৃতিরক্ষার প্রয়োজন হয় সেখানে তার উপাদান ইট-পাথরের ভাস্কর্য নয়; বরং হৃদয়ের ভালোবাসা, কর্ম ও কীর্তির সশ্রদ্ধ আলোচনা এবং চিন্তা ও চেতনায় আদর্শ অনুসরণের প্রেরণাই হল অমরত্বের উপাদান।
আল্লাহর নবী ও তার খলীফাগণের এবং ইসলামের মহান পূর্বসূরীদের অমর স্মৃতি পাথরের ভাস্কর্যের দ্বারা সংরক্ষিত হয়নি। তা হয়েছে প্রজন্ম পরম্পরায় মানুষের হৃদয়ে এবং তাদের কর্ম ও অবদানের সুরভিত আলোচনায়। এটা হল ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি। অন্যদিকে ভাস্কর্যভিত্তিক স্মৃতিরক্ষার পদ্ধতি হচ্ছে অত্যন্ত স্থূল ও পশ্চাৎপদ চিন্তার ফসল।