আবু সায়েমঃ হালকাভাবে যখন-তখন কাফের ফতোয়া দেওয়ার পরিহারযোগ্য প্রবণতাটি ছাড়া মোটামুটি আর সব বিষয়েই ড. এনায়েতুল্লাহ আব্বাসীর আমি একজন গুণমুগ্ধ শ্রোতা।
অনেকদিন থেকে তার ওয়াজ শুনছি। ভদ্রলোকের চেহারা, পোশাক ও বাচনভঙ্গী দৃষ্টি কাড়ে। তিনি বিদ্বান, স্পষ্টবাদী ও আধুনিক মানসিকতাসম্পন্ন। তবে নিকট অতীতে তাকে কিছুটা অসহিষ্ণু বলে মনে হয়েছিলো। যেসব বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ আছে, সেখানেও দেখেছি, তিনি অন্যদের ওপর চড়াও হচ্ছেন। এটি করতে গিয়ে মাঝে মাঝে বাড়াবাড়িও করেছেন। তবু এ ওয়ায়েজকে ভালো লাগার বাড়তি কারণ—তার লেখাপড়া আছে, উপস্থাপনা ভালো এবং তিনি সুনির্দিষ্ট রেফারেন্স দিয়ে কথা বলেন।
শাহরিয়ার কবিরের সাথে এনায়েতুল্লাহ আব্বাসীর সাম্প্রতিক টকশোটি এখন দেশজুড়ে আলোচনার বিষয়। আমি পুরোটাই দেখেছি এবং ড. আব্বাসীর পারফরম্যান্সে কেবল মুগ্ধই নই, রীতিমত বিস্মিত। সত্যি বলতে কি, আমি মোটেই আশা করিনি, অকাট্য যুক্তি, স্থিরতা, ধীশক্তি, প্রজ্ঞা ও ব্যক্তিত্বের শরে তিনি মি. কবিরকে এভাবে ছিন্নভিন্ন করে দিবেন।
কয়েক দশক ধরে শাহরিয়ার কবিররা বাংলাদেশে ইসলাম ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সতীনের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। দাসত্ববাদে নতিস্বীকার করে, মাতৃভূমির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিয়ে সোনার দেশটাকে যারা বিদেশী প্রভুদের হাতে তুলে দিয়েছে, শাহরিয়ার কবির তাদেরই অন্যতম বিশ্বস্ত প্রতিনিধি। উঠতে-বসতে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তিতে খাটো করে কথা বলা, আধিপত্যবাদের নির্লজ্জ তোষণ করা, অনির্বাচিত-লুটেরাগোষ্ঠীকে গদিতে থাকতে সহায়তা করার মতো অগণিত ক্ষমাঅযোগ্য দোষে দুষ্ট কবির গং। বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা ও আইনের শাসন ধ্বংসের প্রক্রিয়ায় শাহরিয়ার কবিরদের দায় শেখ হাসিনার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। সেই শাহরিয়ার কবিরের আব্বাসী হুজুরের কাছে এমনভাবে নাজেহাল হওয়া দেশপ্রেমিকদের মনে একটুখানি হলেও প্রশান্তি এনেছে।
দুর্ভাগা জাতি যখন ইসলাম ও দেশবিরোধীদের দৌরাত্মে আত্মপরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছিলো, ড. আব্বাসী তখন মরুর বুকে এক টুকরো শীতল সরোবর হয়ে দেখা দিয়েছেন। তার সামনে কবির সাহেবকে খেঁকশিয়ালের মতো মনে হচ্ছিলো। অথচ ড. আব্বাসী এ লোকটিকে সম্মান দিয়েই কথা বলছিলেন! দেশবরেণ্য অনেক ওলামাকে দেখেছি কোনরকম হোমওয়ার্ক না করেই টেলিভিশিনের পর্দায় চলে আসতে ও যথারীতি শাহরিয়ার কবিরদের হতে ধোলাই খেতে। এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী তা করেননি। তিনি প্রাসঙ্গিক বিষয়ে প্রচুর লেখাপড়া করে এসেছেন এবং সেকারণে দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলতে পেরেছেন, “আপনি ভুল জানেন।” কিংবা “আপনি জানেন না।”
মি. কবির ড. আব্বাসীর একটি বক্তব্যও যৌক্তিকভাবে খণ্ডন করতে পারেননি কিংবা বলার ধৃষ্টতা দেখাননি, ড. আব্বাসী ভুল। ড. আব্বাসীর তথ্যসমৃদ্ধ বক্তব্যের মুখে শাহরিয়ার কবির যে খেই হারিয়ে আবোলতাবোল বকেছেন—এটা আমার মতো অন্যরাও নিশ্চয়ই উপভোগ করেছেন। অহেতুক বিএনপি, আবুল আলা মওদুদী কিংবা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে টেনে এনে মূল প্রসঙ্গ আড়াল করার হাস্যকর প্রচষ্টা সবার চোখেই ধরা পড়েছে। তাতেও আব্বাসী হুজুর টলেননি। দেলোয়ার হেসেন সাঈদীর পক্ষে কথা বলা বর্তমান সময়ে যে কারো জন্যে খুব কঠিন।
আইনের অপপ্রয়োগের ভয় আছে, আছে কবির গং ও আওয়ামী দুর্বৃত্তদের হাতে ‘রাজাকার’ তকমা পাওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু শান্ত বদনে ড. আব্বাসীর উগরে দেওয়া নাতিদীর্ঘ মন্তব্যে খেল খতম স্বঘোষিত মুক্তিযাদ্ধা শাহরিয়ার কবিরের। এনায়েতুল্লাহ আব্বাসীর মতো সিংহের মুখে না পড়লে আমি জানতামই না, মি. কবিরের জ্ঞানগরিমা প্রায় ধুলাতুল্য এবং ইসলামের ওপর মোটামুটি শূন্যের কোঠায়। অন্যদিকে ইতিহাস ও আইনে তার ‘পাণ্ডিত্য’ দেখে শাহরিয়ার কবির সম্পর্কে লালন করা ন্যুনতম ইতিবাচক ধারণাও এখন আমাকে লজ্জিত করছে।
‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র সাংবিধানিক সংজ্ঞা নিরূপণ করতে তিনি শেখ মুজিবের ভাষণের দ্বারস্থ হয়েছেন! শাহরিয়ার কবির আইএসএস, জঙ্গীবাদ ও মাদ্রাসাশিক্ষাকে অন্তর্যুক্ত করে যেভাবে বয়ান তুলে ধরতে চেয়েছেন, তাতে তার শিক্ষাগত যোগ্যতার দৈন্য প্রকাশ পেয়েছে কিংবা জ্ঞানপাপের। ধর্মনিরপেক্ষতা ও খেলাফত বিষয়েও আব্বাসীর কাছে তিনি বাল্যশিক্ষা লাভ করেছেন। বিশেষ করে ড. আব্বাসী যেভাবে খেলাফত প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিক ও গণতন্ত্রসিদ্ধ পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন, কবির সাহেব সেখানে লাজওয়াব। বারংবার নিজের তৈরি বানোয়াট ডক্যুমেন্টারির রেফারেন্স দিয়ে মি. কবির নিজেকে ‘মুরগী’র চেয়েও ক্ষুদ্রতর করে ফেলেছেন। একটি মজার পরিসংখ্যান না দিয়ে পারছি না। তার আগে জনাব সাইফুর সাগরকে ধন্যবাদ দিতে হয় নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্ব ঠিক রেখে টকশোটি সঞ্চালনা করার জন্যে।
এ লেখা শেষ করার মূহুর্তটিতে ‘ফেস দ্যা পিপল’ পেইজে মূল অনুষ্ঠানটি দেখেছেন ৫ লক্ষ ৬ হাজার ফেসবুক ইউজার। অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন ২৮ হাজার ২০০ জন আর কমেন্ট করেছেন ৫১ হাজার ৬০০ জন। যারা মন্তব্য করেছেন, তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ দশজন শাহরিয়ার কবিরের প্রশংসা করেছেন, বাকি সবাই সোচ্চার ছিলেন এনায়েতুল্লাহ আব্বাসীর পক্ষে।
শাহরিয়ার কবিরকে অর্ধলক্ষ মানুষ যেভাবে একযোগে তুলোধুনো করেছে, তার বিরুদ্ধে ‘কক-কক’ আওয়াজ তুলেছে, তাতে কবির সাহেবের যুক্তি ‘জামাতিরা সংঘবদ্ধ হয়ে এগুলো করে’ ধোপে টিকে না। বরং বোঝা যায়, বাংলাদেশের মানুষ ইসলাম ও জাতীয়তাবাদী শক্তিকে কতটা ভালোবাসে, আর একই সাথে শাহরিয়ার কবির ও তার প্রভুদের কতটা ঘৃণা করে। আমি বিশ্বাস করি, এ দেশের মানুষ আধিপত্যবাদের কাছে মাথা নত করবে না। ক্রীতদাসদের মসনদ ভেঙ্গে পড়ার সময় এলো বলে। যে প্রদীপ ড. এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী জ্বালিয়ে দিয়েছেন তার শিখা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগবে না, যদি আমরা জাগ্রত হই, বিশেষ করে আমাদের দেশপ্রেমিক আলেম সমাজ ও রাজনীতিবিদগণ। পড়াশোনা করে, জেনে, বুঝে, যৌক্তিকভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হবে। চিৎকার-চেঁচামেচি করে, মাঠ কাঁপিয়ে কতদূর যাওয়া যায়, আমরা অতীতে বহুবার দেখেছি।
সাম্প্রতিক ভাস্কর্য ইস্যুতেও প্রমাণ পাওয়া গেছে। রণাঙ্গনে যুদ্ধ হবে, তবে অপরিকল্পিত নয়। মূল লক্ষ্য হতে হবে, আধিপত্যবাদের শিকড় উপড়ে ফেলা। আর তা করতে হলে নিজেদের ভেতরকার কলহ-বৈরিতা ঘুচিয়ে আনতে হবে, নগণ্য বিষয়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে বিষোদগার বন্ধ করতে হবে। কে ইসলামের আসল রক্ষক, কে কাফের—এজাতীয় অন্তহীন বিতর্ক বাদ দিয়ে দেশের মূল সমস্যায় চোখ দিতে হবে। ড. এনায়েতুল্লাহ আব্বাসীর কাছেও প্রত্যাশা তা—ই। ঐক্য ও সম্প্রীতিই হতে হবে আমাদের মুক্তির মন্ত্র। সবাইকে নতুন করে ভাবতে হবে। যাদের হাতে নিরাপদ ইসলাম ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ—তাদের পতাকাতলে সমবেত হওয়ার বিকল্প নেই।
লেখকঃ আইনজীবী, রাজনীতিবিদ এবং মানবাধিকার কর্মী।
আইনজীবি