DMCA.com Protection Status
title="৭

রাওয়ার স্বাধীনতা কি হাওয়া হয়ে গেলঃ মেজর জেনারেল(অবঃ)ইবরাহিম,বীর প্রতীক।

সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম,বীর প্রতীকঃ  বাংলাদেশের জনগণের বাকস্বাধীনতা বন্ধ করার নিমিত্তে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক সরকারের সমালোচনা বন্ধ করার নিমিত্তে, নিত্যনতুন উপায় আবিষ্কৃত হচ্ছে। সর্বশেষ খড়গহস্ত নেমে এসেছে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদের ওপর। মেজর সিনহা নিহত হওয়ার পর, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক সদস্যরা কিঞ্চিত উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন; বিচার কামনা করে সোচ্চার হয়েছিলেন। ভবিষ্যতে যদি কেউ নিহত হয়, তখন যেন আর এরকম কেউ সোচ্চার হতে না পারে, কেউ যেন ত্বরিত বিচার কামনা করতে না পারে, তার জন্য বুদ্ধিমান সরকার ২০২০ সাল শেষ হওয়ার আগেই কিছু বন্দোবস্ত নিলেন!

ইংরেজি ও বাংলা পত্রিকায় কলামঃ
‘দি ডেইলি স্টার’-এ ২২ ডিসেম্বর একটি কলাম প্রকাশিত হয়েছে ‘রাওয়া’ প্রসঙ্গে। লেখক হচ্ছেন, ‘দি ডেইলি স্টার’ পত্রিকার সদ্য-সাবেক এসোসিয়েট এডিটর, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহেদুল আনাম খান।  তিনি অর্ধশতাব্দী বা তারও বেশি সময় আগের, ঢাকা মহানগরীর বিখ্যাত পত্রিকা ‘দৈনিক আজাদ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ-এর নাতি। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে আমার থেকে দুই বছরের জ্যেষ্ঠ, জনাব আনাম একজন কৃতী ছাত্র ছিলেন, সেনাবাহিনীর কৃতী অফিসার ছিলেন। আশির দশকের শেষে, ৯০-৯১ সালে, ইরান-ইরাক যুদ্ধের মধ্যে শান্তি রক্ষাকারী বাহিনীর (ইউনিমগ)-এর অধিনায়ক ছিলেন এবং এরূপ দায়িত্ব পালনে তিনি প্রথম বাংলাদেশী।

 

সামরিক চাকরি থেকে অবসর নেয়ার আগে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ তথা ‘বিআইএসএস’-এর মহাপরিচালক ছিলেন। ১৯৯৭ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ধারাবাহিক ও নিয়মিতভাবে একাধিক পত্রিকায় ও সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে কলাম লিখে এলেও, করোনা মহামারীকালে নিয়মিত লিখতে পারিনি। জনপ্রিয় দৈনিক ইংরেজি পত্রিকা ‘ডেইলি স্টার’-এর পাঠক এবং জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকা ‘নয়া দিগন্ত’-এর পাঠক ভিন্ন ক্যাটাগরির বিধায়, রাওয়া প্রসঙ্গে বাংলাতেও একটি কলাম লেখা প্রয়োজন।

 

রাওয়ার পরিচিতিঃ
‘রাওয়া’ একটি নামবাচক শব্দ। সাম্প্রতিককালে, বিশেষত কক্সবাজার জেলার টেকনাফে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যার পর থেকে, সচেতন নাগরিক মহলে এই নামটি সুপরিচিত হয়ে উঠেছে। ইংরেজিতে ‘রিটায়ার্ড আর্মডফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’-এর সংক্ষিপ্ত নাম হলো ‘রাওয়া’। এর বর্তমান সদস্য সাড়ে চার হাজারের উপরে। এর মধ্যে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, মেজর জেনারেল, লেফটেন্যান্ট জেনারেল এবং জেনারেল অর্থাৎ জেনারেল হিসেবে অভিষিক্ত করা যায় এমন র‌্যাংকের অফিসার কমবেশি পাঁচশত।

 

 

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদের সমন্বয়ে এই সংস্থা গঠিত। অবসরপ্রাপ্ত শতকরা প্রায় একশত ভাগ অফিসারই এখানকার সদস্য হয়েছেন; হয়তো দুই-চারজন বাদ থেকে গিছেন বা দেরি করেছেন। মৃত অফিসারদের স্ত্রীরা বিশেষ সদস্যের ক্যাটাগরিতে সম্পৃক্ত থাকেন। আশির দশকের শুরুতে, তৎকালীন কয়েকজন জ্যেষ্ঠ অবসরপ্রাপ্ত অফিসার উদ্যোগ নিয়ে সংস্থাটি গঠন করেছিলেন, তৎকালীন সামরিক বাহিনীতে চাকরিরত জ্যেষ্ঠদের সহায়তায়।

 

একদিন না একদিন সবাইকে অবসর জীবনে আসতেই হবে, এই কথা মনে রেখেই, চাকরিরতরা সর্বদাই, অবসরপ্রাপ্তদের সম্মিলিত কল্যাণের প্রতি সদয় থাকতে চেষ্টা করেছিলেন; ব্যতিক্রম মনে হয় ২০২০ সাল; তা-ও আবার বিজয়ের মাসে। ‘রাওয়া’ গঠনের পর, উপযুক্ত সময়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সমাজসেবা অধিদফতর থেকে এটি নিবন্ধনপ্রাপ্ত হয়েছিল। রাওয়া নামক সংস্থাটির একটি অনুমোদিত গঠনতন্ত্র আছে। এই সংস্থাটির একমাত্র উদ্দেশ্য, অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদের ও তাদের পরিবারের কল্যাণ। ‘দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ- এই তত্ত্বটিকেই কাজে লাগিয়ে অবসরপ্রাপ্তরা প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। বহু আগে সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা মহানগরীর মহাখালী অঞ্চলে, রাওয়ার দালান নির্মাণের জন্য জমি বরাদ্দ করেছিলেন।

ওই জমির ওপরেই দালান নির্মিত হয়েছে। এয়ারপোর্ট রোডের ওপরেই একটি বিরাট দালান গত দশ বছর যাবত দৃশ্যমান। সাম্প্রতিককালে বিয়ে-শাদি ইত্যাদি আয়োজিত হচ্ছে ওই দালানের অভ্যন্তরের বড়-ছোট হল রুমগুলোতে। দালানের মধ্যে ছোটখাটো জিমনেশিয়াম, সুইমিং পুল, অনুমোদিত একটি বার, লাইব্রেরি, প্রবীণরা বসে গল্প-গুজবের জায়গা, রেস্টুরেন্ট, বেকারি এবং জুমার নামাজসহ পাঞ্জেগানা নামাজের বন্দোবস্ত আছে। সব জাতীয় দিবসে এবং সামরিক দিবসগুলোতে, রাওয়া বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে।

 

রাওয়ার পরিচালনা ও কর্মকাণ্ডঃ
সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল থেকে শুরু করে বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট (যার সমমর্যাদা : সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন) র‌্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত অফিসাররা নির্বাচিত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। কারো মেয়াদকাল বা কর্মপরিধি বেশি সাফল্যমণ্ডিত ছিল, কারো কম ছিল। অতীতের কমিটিগুলোর মধ্যে কোনো না কোনো কমিটির কিছু ব্যর্থতাও যে ছিল না, এ কথা বলা যাবে না। হঠাৎ বিষয়গুলো আদালত পর্যন্তও গিয়েছে। বলাই বাহুল্য যে, ধারাবাহিকভাবে অনেক চেয়ারম্যান বা নির্বাচিত কমিটির পরিশ্রমের ফলেই আজকের রাওয়া।

শীতকালে অথবা বন্যাকালে দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানো, করোনাকালে গরিবদের পাশে দাঁড়ানো এবং বিপদগ্রস্ত অফিসার বা তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো রাওয়ার নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। রাওয়ার সদস্যদের বিবেক ও আবেগের তাড়নায়, মেজর সিনহা নিহত হওয়ার পর, রাওয়া সদস্যরা ভার্চুয়ালি বা একচুয়ালি একত্র হয়ে নিজেদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে চেষ্টা করেছিলেন। সাধারণত রাওয়ার সদস্যরা কোনো জাতীয় রাজনৈতিক বা সামাজিক বা অর্থনৈতিক সমস্যাতেও এরূপ একত্র হয়ে আবেগ বা মতামত কোনো সময় প্রকাশ করেননি। সে জন্য এখন থেকে চার-পাঁচ মাস আগে ঘটনাটি মিডিয়ার এবং দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

 

রাওয়া একটি রাজনীতিমুক্ত সংস্থা; রাওয়ার চত্বরে বা রাওয়ার কোনো ফাংশনে কোনো প্রকার দলীয় রাজনীতি চর্চার সুযোগ কঠোরভাবে বারিত। রাওয়ার সদস্যদের মধ্যে বিপুলসংখ্যক এখনো তরুণ, এখনো অনেকেরই ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেষ হয়নি। প্রচুর রাওয়া সদস্য, সম্মানজনকভাবে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে প্রাইভেট সেক্টরে চাকরি করেন এবং তারা নিজেদের প্রাইভেট সেক্টরের কর্মক্ষেত্রে প্রশংসনীয় সাফল্যের দৃষ্টান্ত রাখেন। অবসরের পর বহু তরুণ রাওয়া সদস্য, দেশে-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে কঠিন কঠিন বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষার ডিগ্রি অর্জন করেন। কিছু রাওয়া সদস্য তা-ও বেশির ভাগই র‌্যাংকে কনিষ্ঠ ও তরুণ, নিজ মেধা, নিজ সততা, সাংগঠনিক শক্তি ও পরিশ্রমের কারণে, ব্যবসা ও শিল্প জগতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।

অতএব, র‌্যাংকে জুনিয়র হওয়ার কারণে রাওয়া সদস্যরা রাওয়ার পরিচালনায় সার্বিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবেন, এ কথাটা স্বাভাবিক মনে হয় না। অতি অল্পসংখ্যক অবসরপ্রাপ্ত অফিসার তথা রাওয়া সদস্যই প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সাথে জড়িত। অধিকতর সংখ্যক মেধাবী, সাহসী, সাংগঠনিকভাবে ডাইনামিক এমন অবসরপ্রাপ্ত অফিসার প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে এলে, বাংলাদেশের রাজনীতি উপকৃত হতো বলে মনে করি।

বিনামেঘে বজ্রপাতঃ
বিগত ১৯ ডিসেম্বর রাওয়ার বার্ষিক নির্বাচন নির্ধারিত ছিল। এর তিন-চার দিন আগে, শীতকালের মেঘবিহীন নীল আকাশ থেকে হঠাৎ করে ‘বজ্রপাত’ হলো। সমাজসেবা অধিদফতর থেকে একটা চিঠি এলো; চিঠি ইস্যুর তারিখ ১৪ ডিসেম্বর ২০২০। ১৯ তারিখের জন্য নির্ধারিত নির্বাচনের তিন-চার দিন আগে, সেই রাওয়ার বিদ্যমান কমিটিকে ‘বরখাস্ত’ করা হয়, ওই চিঠিটির মাধ্যমে। চিঠিটি পড়ার পর, সাধারণ সদস্যদের পক্ষ থেকে ভার্চুয়াল জগতে প্রকাশিত মতামতের সারমর্ম হলো এরূপ। চিঠিতে রাওয়ার কমিটির বিরুদ্ধে যতগুলো অভিযোগ আছে, সেগুলো শুধু বিদ্যমান বা চলমান কমিটির ওপর প্রযোজ্য নয়, আগেকার অনেক কমিটির ওপরও প্রযোজ্য এবং অভিযোগগুলো হালকা প্রকৃতির, সংশোধনযোগ্য যথা : কার্যনির্বাহী কমিটি অনুমোদন না করা, নিয়মিত বার্ষিক প্রতিবেদন প্রেরণ না করা এবং সুদীর্ঘকাল যাবত নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা না করা।

 

সাধারণ সদস্যদের মূল্যায়নে, দেশব্যাপী পরিচালিত যেকোনো সমাজসেবামূলক বা কল্যাণমূলক সমিতি বা সংগঠনের ক্ষেত্রে এ ধরনের দোষ বা অভিযোগের ক্ষেত্র সৃষ্টি হলে, তখন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কৈফিয়ত তলব করা হয় এবং সংশোধন করার জন্য সাবধানবাণী উচ্চারণ করা হয়। এবার রাওয়ার ক্ষেত্রে, সংশোধনের জন্য সাবধানবাণী উচ্চারিত হয়নি, কৈফিয়ত দেয়ার জন্যও সুযোগ দেয়া হয়নি। সাধারণ সদস্যরা মনে করেন যে, অভিযোগগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে কমিটি ভেঙে দেয়ার জন্য বাহানা হিসেবে।

তত্ত্বাবধায়কমণ্ডলী (কেয়ারটেকার):
১৪ ডিসেম্বর ২০২০ সালের একই চিঠি দ্বারা রাওয়া পরিচালনার জন্য একটি কেয়ারটেকার কমিটি বা তত্ত্বাবধায়কমণ্ডলী মনোনীত করে দেয়া হয়েছে। সেই কেয়ারটেকার কমিটির প্রধান হিসেবে মনোনয়ন করা হয়েছে সেনাবাহিনীর সদর দফতরে চাকরিরত একজন সম্মানিত ব্রিগেডিয়ার জেনারেলকে। তার সাথে কমিটিতে আছেন (সর্বসম্মানিত) একজন চাকরিরত মেজর, একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর, সরকারের একজন উপসচিব এবং সমাজসেবা অধিদফতরের একজন অতিরিক্ত পরিচালক। এই চিঠির পরপরই নতুনভাবে মনোনীত কেয়ারটেকার কমিটির প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রাওয়ার সদস্যদের উদ্দেশ করে একটি নোটিশ জারি করেন। নোটিশটি ইংরেজিতে এবং ৪ পৃষ্ঠা দীর্ঘ।

সমাজসেবা অধিদফতর থেকে জারি করা ১৪ ডিসেম্বরের পত্রের দুই নম্বর অনুচ্ছেদে এবং তত্ত্বাবধায়কমণ্ডলীর প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কর্তৃক জারি করা নোটিশের আট নম্বর অনুচ্ছেদে, সেনাসদরের ১২ নভেম্বর ২০২০ একটি পত্রের রেফারেন্স দেয়া আছে। ওই পত্রে কিছু প্রস্তাব দেয়া আছে। বিবিধ পত্র পাঠের পর আবিষ্কৃত হচ্ছে যে, সেনাসদর থেকে চিঠি পাওয়ার পর, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও ১০ ডিসেম্বর ২০২০ সমাজসেবা অধিদফতরের প্রতি একটি চিঠি লেখে; যেই চিঠিতে রাওয়া প্রসঙ্গে নির্দেশনাগুলো জারি করার কথা লেখা আছে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কর্তৃক ইস্যু করা নোটিশের পৃষ্ঠাগুলো টেলিভিশনেও দেখানো হয়েছে। ওই নোটিশে রাওয়াকে ‘ক্লাব’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে যেটা আসলে ভুল। আগামী দিনের কমিটি গঠন প্রসঙ্গে একটি কঠোর নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে।

 

সেনাসদরের ১২ নভেম্বরের পত্রটি আমরা দেখিনি কিন্তু সেখানে কী আছে সেটা কমনসেন্স ব্যবহার করে মানসপটে ফ্রেম করতে পারি। ওই পত্রের সারমর্ম ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কর্তৃক জারি করা নোটিশে প্রতিফলিত। ওই নোটিশে, রাওয়া পরিচালনাকারী নির্বাহী কমিটির কিছু ব্যর্থতা বা কথিত ব্যর্থতা তুলে ধরা হয়েছে, রাওয়ার সদস্যরা তথা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারদের ব্যক্তিগত আচরণে ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরা হয়েছে এবং অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র ও জুনিয়র অফিসারদের মধ্যে সম্পর্কের ব্যাপারে হঠাৎ হঠাৎ সংঘটিত ব্যত্যয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। আমি নিজে এ প্রসঙ্গে ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনো তথ্য সংরক্ষণ যদিও করি না তথাপি সাধারণ সদস্যরা কল্পনা করছেন বা অনুমান করছেন যে, অবসরপ্রাপ্ত এক বা একাধিক সিনিয়র অফিসার হয়তোবা, বর্তমান সেনাবাহিনীর উচ্চতম কর্তৃপক্ষের বরাবর বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন এবং বিহিতের জন্য প্রস্তাব দিয়েছেন। ওই প্রস্তাবগুলো সেনাসদরের পক্ষ থেকে সমাজসেবা অধিদফতর পর্যন্ত পৌঁছেছে বাস্তবায়নের নিমিত্তে।

ভবিষ্যতের জন্য দিকনির্দেশনাঃ
সেনাসদর কর্তৃক উপস্থাপিত প্রস্তাবের প্রেক্ষাপটে সমাজসেবা অধিদফতর কর্তৃক, ভবিষ্যতের রাওয়া কমিটি গঠনের জন্য সংশোধিত নীতিমালা জারি করা হয়েছে। সে মোতাবেক : আগামী দিনের কমিটিতে চেয়ারম্যান, মহাসচিব বা সেক্রেটারি জেনারেল এবং মেম্বার বেভারেজ- এই তিনটি পদে, আগ্রহী বা ইচ্ছুক কোনো না কোনো অবসরপ্রাপ্ত অফিসারকে, সেনাবাহিনী সদর দফতর কর্তৃক মনোনীত করা হবে (অর্থাৎ এই তিনটি পদে নির্বাচন হবে না)। অন্য পদগুলোতে নির্বাচন হবে। ওই নির্দেশিকা মোতাবেক, চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নের জন্য অগ্রাধিকার পাবেন, মেজর জেনারেল বা সমর‌্যাংকের অফিসার; কিন্তু কোনোক্রমেই ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের নিচের র‌্যাংকের অফিসার নয়। অর্থাৎ চেয়ারম্যান পদে সব র‌্যাংকের সব অফিসার যোগ্য বিবেচিত হবেন না এবং অন্য দুটি পদেও
প্রতিযোগিতা করা যাবে না। চিঠিটির ও নোটিশটির ফটোকপি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি কর্তৃক শেয়ার হয়েছে এবং অবসরপ্রাপ্তদের মহলে ভাইরাল হয়েছে।

প্রেক্ষাপট নিয়ে প্রশ্নঃ
নবমনোনীত আহ্বায়ক কমিটির প্রধান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের জারি করা নোটিশ বা পত্র পাঠ করলে, আন-অফিসিয়ালি বোঝা যায় যে, সেনাকর্তৃপক্ষ এবং সমাজসেবা অধিদফতরের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের ফলে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, সেনাবাহিনী সদর দফতর কেন হঠাৎ করে রাওয়া নিয়ে এত উদ্বিগ্ন হলেন? এর সম্ভাব্য উত্তর হলো, বাংলাদেশ শাসনকারী বর্তমান রাজনৈতিক সরকার, তাদের নিজস্ব নিয়মে সেনাসদরকে প্রভাবান্বিত করেছে রাওয়ার ব্যাপারে নাক গলাতে। অর্থাৎ এরকম বলা যায় যে, রাজনৈতিক সরকার প্রভাব বিস্তার করেছে সেনাসদরের ওপরে, সেনাসদর প্রভাব বিস্তার করেছে সমাজকল্যাণ অধিদফতরের ওপরে এবং সমাজকল্যাণ অধিদফতর প্রভাব বিস্তার করেছে রাওয়ার ওপরে। অথবা ইংরেজি শব্দযুগল ‘ভাইস-ভার্সা’ প্রযোজ্য। চূড়ান্ত পর্যায়ে লোকসান হলো : রাওয়ার সাধারণ সদস্যদের।

র‌্যাংক স্ট্র্যাকচার ও ফলাফলঃ
বহু অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি র‌্যাংকে জুনিয়র হন; কিন্তু বয়স ও চাকরিতে সিনিয়র তাঁরা। সেনাবাহিনীতে চাকরিরত অবস্থাতেও, কমান্ডে অথবা স্টাফ জব-এ, অনেক ক্ষেত্রেই জ্যেষ্ঠ অফিসারের অধীনে, চাকরির দৈর্ঘ্যে জ্যেষ্ঠ কিন্তু র‌্যাংকে কনিষ্ঠ, এরকম অনেক অফিসার দায়িত্ব পালন করেন। এরূপ ক্ষেত্রগুলোতে, র‌্যাংকে জ্যেষ্ঠ অফিসার এবং চাকরিতে জ্যেষ্ঠ অফিসার উভয়ের মধ্যকার সম্পর্কটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এরূপ ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ এবং কনিষ্ঠ উভয়কেই নিজ নিজ মেধা এবং বিবেক ব্যবহার করে কাজ করতে হয়। অবসরের পর, বাংলাদেশ আর্মি অ্যাক্টের আওতামুক্ত পরিবেশে, অবসরপ্রাপ্ত অফিসাররা, নির্বাচন উপলক্ষে গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ পান। এরূপ পরিবেশে সিনিয়রিটি বা জুনিয়রিটির প্রতি খেয়াল রেখে পারস্পরিক সম্পর্ক সোনা মাপার পাল্লার মতো করে নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে যুগের পর যুগ, অফিসারদের মধ্যকার সম্পর্ক টিকে আছে।

 

দুর্ঘটনাগুলো ব্যতিক্রম; সুসম্পর্ক ও প্রীতিময় সম্পর্ক হচ্ছে নিয়মিত বা স্বাভাবিক। ধীরে ধীরে রাওয়ার পরিচালনায় পরিপক্বতা আসছিল, অফিসারদের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও প্রীতি বৃদ্ধি পাচ্ছিল। অতএব সামরিক বাহিনীর চাকরিতে সিনিয়রিটি বা জুনিয়রিটি, রাওয়ার পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি বিরাট বাধা- এই যুক্তিটি একান্তই ঠুনকো। এটা আমার অভিমত। এই কলামের মাধ্যমে কোনো উপদেশ বা পরামর্শ দেয়ার অবকাশ নেই। কিন্তু ভার্চুয়াল জগতের মাধ্যমে এবং ব্যক্তিযোগাযোগের কারণে, আমার কাছে দৃশ্যমান যে, রাওয়ার বিপুলসংখ্যক সাধারণ সদস্য মর্মাহত। অনেকের মতে অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা হলো। অনেকের মতে, মনোনীত চেয়ারম্যান বা সেক্রেটারি জেনারেলরা, তাদের মনোনয়নকারী কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করে কোনো দিনই কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবেন না। অর্থাৎ রাওয়া সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণে এসে গেল। অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদের সামগ্রিক কল্যাণের নিমিত্তে, রাওয়া সদস্যদের আত্মিক একতা ধরে রাখাটাই এখন অগ্রাধিকারমূলক কাজ।

লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
ই-মেইল : [email protected]

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!