কর্ণেল মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি (অবঃ): আজ ১৯ জানুয়ারি । বাংলাদেশের উন্নয়ণের রূপকার, জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ও বহুদলীয় উদার গণতন্ত্রের প্রবর্তক ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা বীর উত্তম শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৮৫তম জন্মবার্ষিকী। বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বাধিক জনপ্রিয় এ রাষ্ট্রপতির প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান এবং দোয়া কামনা করে আমার ছোট্ট এ আলেখ্য ।
☆☆ পৃথিবীতে মাঝে মধ্যে দু’একজন নেতার আগমন ঘটে যারা ইতিহাসের পাতাকে রাঙিয়ে চির স্মরণীয়, বরণীয় ও মানুষের নিকট অনুকরণীয় হয়ে থাকেন। ঠিক এরকমই একজন মানুষের আগমন ঘটে বাংলাদেশে। তিনি ছিলেন গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অষ্টম প্রেসিডেন্ট ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৃতীয় সেনাপ্রধান বীর উত্তম লেফটেনান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান।
☆ সততা ও আত্মত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন এবং দেশপ্রেমের অনুপম উদাহরণ সৃষ্টি করে যিনি তাঁর সারাটা জীবন প্রাণ প্রিয় জন্মভূমি মাতৃভূমি ও এর মানুষের জন্য নিঃস্বার্থ ভাবে উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি এসেছিলেন এবং জয় করেছিলেন সকল স্তরের মানুষের মন ।
☆ যে সকল কারণে বাংলাদেশের অষ্টম রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের সর্বকালের সর্বাধিক জনপ্রিয় নেতা ও মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের প্রতিক এবং যিনি মানুষের মনের গভীরে ও ইতিহাসের পাতায় চির অমর হয়ে থাকবেন :
১। বর্ণাঢ্য সামরিক জীবন: পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে জিয়াউর রহমান একজন চৌকস অফিসার হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। পেশাগত দক্ষতা, সাহসীকতা, শৌর্য-বীর্যবান, সৌম্য, শক্তি, ক্ষিপ্রতা, নেতৃত্বের গুণাবলী ও সুহৃদয় আন্তরিক ব্যবহারের কারণে বিশেষ করে বাঙ্গালী অফিসার ও জওয়ানদের নিকট তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে জেন্টলম্যান ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ১২তম পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমী লং কোর্সের সাথে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন প্রাপ্ত হন। তিনি ছিলেন সুদক্ষ প্যারাট্রুপার ও কমান্ডো, স্পেশাল ইন্টেলিজেন্স কোর্সে উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত দুর্ধর্ষ এক অফিসার। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে কোম্পানি অধিনায়ক হিসেবে খেমকারান সেক্টরে তিনি অসাধারণ সাহসিকতা ও বীরত্বের পরিচয় দেন। শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অসম সাহসিকতা প্রদর্শন এবং আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ যেসকল কোম্পানি সর্বাধিক বীরত্বসূচক পুরস্কার লাভ করে, জিয়াউর রহমানের কোম্পানি ছিলেন এদের অন্যতম। জিয়াউর রহমানের ইউনিট এই যুদ্ধে বীরত্বের জন্য দুটি ‘সিতারা-ই-জুরাত’ ও নয়টি ‘তঘমা-ই-জুরাত’ পদক লাভ করে। ১৯৬৬ সালে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে জেন্টলম্যান ক্যাডেটদের প্রশিক্ষক পদে নিয়োগ লাভ করেন, যা একজন সামরিক অফিসারের জন্য অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। সে বছরই তিনি মেধার ভিত্তিতে পাকিস্তানের কোয়েটার স্টাফ কলেজে কমান্ড ও ষ্টাফ কোর্সে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি মেজর পদে উন্নীত হয়ে জয়দেবপুরে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদের দায়িত্ব লাভ করেন। কিন্তু এডভান্সড মিলিটারি এন্ড কমান্ড ট্রেনিং কোর্সে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তিনি পশ্চিম জার্মানিতে গমন করেন এবং কয়েক মাস বৃটিশ সেনাবাহিনীর সাথেও কাজ করেন। ১৯৭০ সালে একজন মেজর হিসেবে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং চট্টগ্রামে নবগঠিত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদের দায়িত্ব লাভ করেন।
২। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী বাঙালি জনগনের উপর নৃশংস হামলা ও হত্যাযজ্ঞ শুরু করার পর দুঃসাহসী মেজর জিয়া নিজের জীবন ও পরিবারের মায়া ত্যাগ করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করেন এবং তিনি তার অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পাকিস্তানি অধিনায়ককে বন্দি করে ইউনিটের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ও চট্টগ্রামে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। যা একজন সামরিক অফিসারের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ ও মহিমার পরিচয় বহন করে।
৩। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক: ১৯৭১ সালের এ ক্রান্তিলগ্নে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে জাতীয় জীবনের চরম সঙ্কটময় মুহুর্তে জাতীয় নেতৃবৃন্দ যখন পলায়নপর এবং পুরো জাতি দিশেহারা, ঠিক সে সময়ে অর্থাৎ ২৬ ও ২৭শে মার্চ দুঃসাহসী মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের পক্ষে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করে জাতিকে উজ্জীবিত করেন ও বিশ্বকে আমাদের স্বাধীনতা সম্পর্কে জানিয়ে দেন এবং মহান স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে কিংবদন্তি বীরপুরুষ রূপে ইতিহাসের পাতায় তাঁর নামকে স্বর্ণাক্ষরে অঙ্কিত করেন ।
৪। স্বাধীনতা যুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদান: একজন তীক্ষ্ম মেধাবী ও দূরদর্শী গোয়েন্দা অফিসার হিসেবে পাকিস্তানিদের দুর্ভিসন্ধী আঁচ করতে পেরে ২৫ মার্চের কয়েক দিন আগেই তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ অফিসার ক্যাপ্টেন অলী আহমেদ ও ক্যাপ্টেন শমসের মোবিন চৌধূরীকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রনেতা, শিক্ষক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে বৈঠক করে তাঁর বিদ্রোহ ঘোষণা ও স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিকল্পনার ব্যাপারে অবহিত করেন । এরপর মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিনেই জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ ঘোষণা করেন ও অষ্টম ইষ্ট বেঙ্গলের পাকিস্তানি অধিনায়ক লেঃ কর্নেল জানজুয়াকে হত্যা করেন এবং সেনানিবাস হতে বের হয়ে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথমে "I, Major Ziaur Rahman, Provincial Head of the Government, do hereby declare the Independence of Bangladesh." ঘোষণা করেন । পুনরায় একই দিনে সংশোধন করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন- "I, Major Rahman, do hereby declare the Independence of Bangladesh in the name of our great leader Sheikh Mujibur Rahman." অতঃপর ইউনিটের অফিসার, জওয়ানদের নিয়ে ছাত্র-যুবক, কৃষক -শ্রমিকদের সংগঠিত করতে শুরু করেন। ১২ এপ্রিল সিলেটের তেলিয়াপাড়ায় জেনারেল ওসমানীর সভাপতিত্বে সর্বপ্রথম সামরিক মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করেন এবং তিনি চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী,রাঙ্গামাটি, মিরসরাই, রামগড়, ফেণী প্রভৃতি এলাকা নিয়ে গঠিত ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হন ও মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেন। পরবর্তীতে তিনি সেনা-ছাত্র-যুব সদস্যদের সংগঠিত করে ১ম, ৩য় ও ৮ম ইষ্ট বেঙ্গল এই তিনটি ব্যাটালিয়নের সমন্বয়ে মুক্তিবাহিনীর প্রথম নিয়মিত সশস্ত্র ব্রিগেড ‘জেড ফোর্সে’র অধিনায়ক ও ১১ নং সেক্টর কমান্ডার হিসেবে জিয়াউর রহমান যুদ্ধ পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন।
৫। ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত: জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অনন্য সাধারণ ভূমিকা, অবিস্মরণীয় অবদান ও বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্ব ও ভূমিকা পালনের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘বীর উত্তম’ রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত করে।
৬। নয় মাসের যুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীকে শোচনীয় ভাবে পরাজিত করে বিজয় লাভের পর জিয়াউর রহমানকে তাঁর অধীনস্থ ১ম, ৩য় ও ৮ম ইষ্ট বেঙ্গলকে নিয়ে গঠিত কুমিল্লা সেনানিবাসে ৪৪ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি কর্নেল পদে উন্নিত এবং সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালের জুন মাসে তিনি ব্রিগেডিয়ার ও অক্টোবরে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নিত হন।
৭। সেনাপ্রধান হিসেবে নিযুক্তি: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হবার ১০ দিন পর রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ কর্তৃক ২৫ আগষ্ট জিয়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৃতীয় সেনাপ্রধান হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেন। নভেম্বর মাসের ৩ তারিখে কর্নেল শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বাধীন ঢাকা ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের সহায়তায় বীর উত্তম মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান ও জিয়াউর রহমানকে চীফ-অফ-আর্মি স্টাফ হিসেবে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে গৃহবন্দী করে রাখা হয় যা সেনাবাহিনীর মধ্যে তার জনপ্রিয়তার কারণে অত্যন্ত বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভঙ্গের প্রতিক্রিয়ায় এবং জিয়ার প্রতি অবিচার করায় ক্ষুদ্ধ সেনাসদস্যরা ৭ই নভেম্বর সিপাহী- জনতা পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটায় এবং জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দীত্ব থেকে মুক্ত করে পুনরায় সেনাপ্রধান পদে আসীন করানো হয়।
সিপাহী জনতা বিপ্লবের পর তিনি রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। দেশের এক অস্থির পরিবেশে জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
৮। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন: জিয়াউর রহমান একদলীয় বাকশালের পরিবর্তে বহুদলীয় গণতন্ত্র কায়েম করেন। তিনি বঙ্গবন্ধু কণ্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে নির্বাসন থেকে দেশে ফিরিয়ে আনেন এবং আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দলকে পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ করে দেন। নির্বাচনী ব্যবস্থা পুনর্বহাল করেন ও অবাধ রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে ১৯৭৮ সালের ৩রা জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন এবং দেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশের সার্বিক উন্নয়ণের কাজ শুরু করেন। ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এবং ঘোষণা করেন ১৯ দফা কর্মসূচি। যে গণতন্ত্রের আকাঙ্খায় দেশ স্বাধীন হয়েছিল তিনি সে চেতনায় জনগণকে উদ্ধুদ্ধ করতে থাকেন।
৯। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা: তিনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব প্রদান করেন, অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠে। দেশে বহু বিভিন্ন ধরনের মতের-পথের ও ধর্মের নানা জাতিগোষ্ঠী বাস করে। তাদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার মাত্রা ও ধরন একে অপরের থেকে ভিন্ন। তাই ভাষা বা সংস্কৃতির ভিত্তিতে নয়, ভূখণ্ডের ভিত্তিতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-সংস্কৃতি নির্বিশেষে সকল নাগরিকের ঐক্য ও সংহতির ওপর গুরুত্ত্ব আরোপ করেন এবং এই ধারণা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার শক্তি হিসেবে শক্তিশালী ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস চালান। বহুধা বিভক্ত দেশের জনগণকে ধর্ম-বর্ণ,দল-মত নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করা শুরু করেন।
১০। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল প্রতিষ্ঠা: ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন। এই দলে বাম, ডান ও মধ্যপন্থীসহ সকল স্তরের লোক ছিলেন। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে বিএনপি ২৯৮টি আসনের মধ্যে ২০৭টিতে জয়লাভ করে। নির্বাচনে অংশ নিয়ে আব্দুল মালেক উকিল এর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ৩৯টি ও মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ২টি আসনে, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ৮টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ১টি ও মুসলিম ডেমোক্রেটিক লীগ ২০টি আসনে জয়লাভ করে।
১১। কৃষি বিপ্লব: কৃষিপ্রধান দেশের চরম খাদ্যাভাব দূর করার জন্য তিনি ‘সবুজ বিপ্লবের’ মাধ্যমে অল্প সময়েই ব্যাপক সফলতা অর্জন করে সারা দেশের কৃষকদের অতি প্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। ফারাক্কা বাঁধের কারণে পানির সংকট কাটিয়ে উঠার জন্য তিনি ব্যক্তিগত ভাবে দেশের প্রতিটি এলাকায় খাল কাঁটা কর্মসূচী শুরু করেন, যা কৃষি উন্নয়ণে আজও মাইল ফলক হিসেবে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। ১৯৭৬ সালেই তিনি যশোহরের উলশি যদুনাথপুর থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে খাল খনন উদ্বোধন করেন।
১২। অর্থনৈতিক উন্নয়ণ: দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে তিনি শক্তিশালী রূপ প্রদান করেন এবং এতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনেন। অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বৃদ্ধি হতে শুরু করে এবং বেকার মানুষের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়।
১৩। আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়ণ: ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তিনি দেশে শান্তি শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেন। এতদুদ্দেশ্যে তিনি অত্যন্ত দুর্বল পুলিশ বাহিনীকে জনবল বৃদ্ধি করে ও অস্ত্র দিয়ে শক্তিশালী করেন। পুলিশ বাহিনীর সংখ্যা আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ করে তিনি তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যাবস্থা গ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালের ৮ই মার্চ তিনি মহিলা পুলিশ গঠন করেন।
১৪। সশস্ত্র বাহিনীর উন্নয়ণ: সশস্ত্র বাহিনীতেও তিনি দ্রুত শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। এতদুদ্দেশ্যে তিনি কঠোর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে পেশাগত শৃঙ্খলা উন্নয়নের কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং তাদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ করেন। সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে যথেষ্ট সফল হলেও তাঁকে বেশ কয়েকটি সেনা-বিদ্রোহ ও সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার মোকাবেলা করতে হয়। এসকল বিদ্রোহ দমনে বাধ্য হয়ে তাকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়।
১৫। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ণ: তিনি সকল দেশের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার জোড়ালো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালে কলম্বোতে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন সম্মেলনে যোগদান করেন এবং বাংলাদেশ সাত জাতি গ্রুপের চেয়ারম্যান পদে পদোন্নতি লাভ করে। দেশের ব্যাপক উন্নতি ও অগ্রগতি দেখে তাঁর সময়ে পৃথিবীর বহুদেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে।
১৬। প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক: সার্কের রূপকার ছিলেন বাংলাদেশের দূরদর্শী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৭৯-৮০ সালে তিনি একটি সংস্থা গঠন করার চূড়ান্ত রূপরেখা প্রণয়ন করেন। যার নামকরণ করা হয়-South Asian Association for Regional Co-operation সংক্ষেপে SAARC। এর সদস্য দেশ হিসেবে প্রথমে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ভূটান, নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কাকে নেয়া হয়। পরবর্তীতে আফগানিস্তান সংযুক্ত হয়।
১৭। মুসলিম বিশ্ব ও শক্তিশালী দেশসমূহের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন: দূরদর্শী জিয়া দেশের উন্নতি ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে দ্রুত মুসলিম ও অন্যান্য বিবিশ্বশক্তি দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করে তাদের স্বীকৃতি আদায় করেন ।
১৮। যুব উন্নয়ন কর্মসূচী: দেশের যুব শ্রেনিকে বোঝা নয়, সম্পদ হিসেবে তৈরি করার জন্য তিনি যুব মন্ত্রণালয় গঠন করেন এবং সারা দেশে যুবকদের কারিগরি, কৃষি ও গঠনমূলক শিক্ষার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় ও ধর্মমন্ত্রনালয় গঠন: মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে আষ্টে-পৃষ্টে ধরে রাখার জন্য এবং দেশের বীর সন্তান মুক্তিযোদ্ধাগণের কল্যাণের লক্ষ্যে তিনি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় গঠন করেন। নব্বই শতাংশ মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতির কথা বিবেচনা করে ধর্ম মন্ত্রনালয় গঠন।
২০। গণশিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ণ: আদর্শ নাগরিক গড়ার লক্ষ্যে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে তিনি ঢেলে সাঁজিয়ে প্রতিটি নাগরিকের জন্য সহজ লভ্য করে দেন। ছাত্রদেরকে তিনি ব্যক্তিগত ভাবে উৎসাহ প্রদান করেন। তাদের জন্য নানা রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন, যেখানে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট উপস্থিত থাকতেন। ‘হিজবুল বাহার’ নামক একটি জাহাজে করে কৃতি ছাত্র-ছাত্রীদের তিনি শিক্ষা ভ্রমণের ব্যবস্থা করেন।
২১। শিশুদের আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তিনি বিভিন্ন উৎসাহ ব্যঞ্জক কার্যক্রম গ্রহণ করেন। সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের পাশে আধুনিক একটি শিশুপার্ক গড়ে তোলেন। যেখানে সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের বিনা মূল্যে বিনোদনের ব্যবস্থা করেন।
২২। মেধাবী শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা: জিয়াউর রহমান দেশের মেধা উন্নয়নের লক্ষ্যে মেধাবী শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করার জন্য নানান পদ্ধতি অবলম্বন করেন । 'হিযবুল বাহার' জাহাজে করে বিশাল সংখ্যক মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে তিনি নৌ-ভ্রমণ করে তাদেরকে উজ্জীবিত করেন ।
২৩। তিনি বঙ্গবন্ধু কণ্যা বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে সম্মানের সাথে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন ।
২৪। অতি সাধারণ ও কঠোর সততার সাথে জীবন যাপন: জিয়াউর রহমান দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েও অতি সাধারণ, বিলাসহীন ও কঠোর সততার সাথে জীবনযাপন করতেন, যা ছিল সর্বজন স্বীকৃত এবং এ দেশের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। শুধু তাই নয়, তাঁর মধ্যে কোন স্বজনপ্রীতির ছিটে-ফোঁটাও ছিল না। কোন আত্মীয়-স্বজন তাঁর ক্ষমতার বলয়ের ধারে কাছেও আসতে পারতো না। তিনি কোন সামান্য অবৈধ সুযোগ-সুবিধাও গ্রহণ করতেন না। এ সকল গুণাবলীর কারণে মানুষের নিকট তিনি ছিলেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে।
২৫। জিয়াউর রহমানের চিন্তা-চেতনায়, ধ্যানে-জ্ঞানে কেবলই ছিল দেশ ও দেশের জনগণ। উপরে বর্ণিত বিষয় ছাড়াও তিনি দেশ ও জনগণের জন্য আরো অনেক অনেক কার্যক্রম গ্রহণ করেছিলেন, যা এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনা করা সম্ভব নহে।
২৬। বাংলাদেশের উন্নয়নে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রবর্তিত রাজনীতির কতিপয় সাফল্য সংক্ষেপে নিম্নে তুলে ধরা হলো :
• সকল দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান।
• জাতীয় সংসদের ক্ষমতা বৃদ্ধি।
• বিচার বিভাগ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়া।
• দেশে কৃষি বিপ্লব, গণশিক্ষা বিপ্লব ও শিল্প উৎপাদনে বিপ্লবের মাধ্যমে ব্যাপক উন্নয়ণ।
• সেচ ব্যবস্থা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে স্বেচ্ছাশ্রম ও সরকারি সহায়তার সমন্বয় ঘটিয়ে ১৪০০ খাল খনন ও পুনর্খনন।
• গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন করে অতি অল্প সময়ে ৪০ লক্ষ মানুষকে অক্ষরজ্ঞান দান।
• গ্রামাঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা প্রদান ও গ্রামোন্নয়ণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর (ভিডিপি) গঠন।
• গ্রামাঞ্চলে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, হত্যা বন্ধ করা।
• হাজার হাজার মাইল রাস্তা-ঘাট নির্মাণ।
• ২৭,৫০০ পল্লী চিকিৎসক নিয়োগ করে গ্রামীণ জনগণের চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধিকরণ।
• নতুন নতুন শিল্প কলকারখানা স্থাপনের ভেতর দিয়ে অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণ।
• কলকারখানায় তিন শিফট চালু করে শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি।
• কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও দেশকে খাদ্য রপ্তানীর পর্যায়ে উন্নীতকরণ।
• যুব উন্নয়ন মন্ত্রাণালয় ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যুব ও নারী সমাজকে সম্পৃক্তকরণ।
• ধর্ম মন্ত্রণালয় প্রতিষ্টা করে সকল মানুষের স্ব স্ব ধর্ম পালনের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধিকরণ।
• বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন।
• তৃণমূল পর্যায়ে গ্রামের জনগণকে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করণ এবং সর্বনিম্ন পর্যায় থেকে দেশ গড়ার কাজে নেতৃত্ব সৃষ্টি করার লক্ষ্যে গ্রাম সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন।
• জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের আসনলাভ।
• তিন সদস্যবিশিষ্ট আল-কুদস কমিটিতে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি।
• দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে 'সার্ক' প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ গ্রহণ।
• বেসরকারিখাত ও উদ্যোগকে উৎসাহিতকরণ।
• জনশক্তি রপ্তানি, তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, হস্তশিল্পসহ সকল অপ্রচলিত পণ্যোর রপ্তানীর দ্বার উন্মোচন।
• শিল্পখাতে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ ক্ষেত্রের সম্প্রসারণ।
২৪। একটা বিষয় লক্ষ্য করার মতো এই যে, মুসলিম দেশগুলোতে যে নেতা বা সরকার প্রধান জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে দেশকে একটি শক্তিশালী দেশে পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন তাঁকেই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়্। যেমন- বাদশাহ ফয়সল বিন আবদুল আজিজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক প্রমূখ। দেশী-বিদেশী চক্রান্তকারিরা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মতো মহান জাতীয়তাবাদী নেতার বিপুল জনপ্রিয়তা ও দেশের উন্নয়ণ কখনোই মেনে নিতে পারেনি। তাই চক্রান্তকারীরা ১৯৮১ সালের ৩০ মে তাঁকে হত্যা করে। জিয়াউর রহমানকে ঢাকার শেরে বাংলা নগরে দাফন করা হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়ার জানাজায় বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ জনসমাগম ঘটে যেখানে প্রায় ২০ লক্ষাধিক মানুষ অংশ গ্রহন করেন।
২৫। এই মর্মান্তিক ঘটনার মধ্য দিয়ে একজন মহান দেশপ্রেমিক নেতাকে হারায় বাংরাদেশ। ইতিহাস সৃষ্টিকারী দুরদর্শী চিন্তা চেতনার অধিকারী অসাধারণ প্রতিভাবান কালজয়ী পুরুষ জিয়াউর রহমানের বার বার জন্ম হয় না। দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে ধুমকেতুর মতো এঁদের আবির্ভাব হয়। বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে যতদিন টিকে থাকবে, বীর উত্তম শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকবেন স্মরণীয়, বরনীয় ও অনুকরনীয় হয়ে এদেশের মাটি ও মানুষের মনের মণিকোঠায় মুক্তির সুউজ্জল আলোকবর্তিকা হিসেবে।
লেখকঃ কর্ণেল মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি (অবঃ)
সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও সামরিক ইতিহাস বিশ্লেষক।