সংবাদটি পড়েছেন: 422,635
ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ হঠাৎ বাংলাদেশ ছেড়ে আমেরিকায় কেনো? আমাদের ধারনা এর কারন, আল-জাজিরা টিভি তাদের বহুল আলোচিত,'অল দ্য প্রাইম মিনিষ্টারস ম্যান' অনুষ্ঠান সম্প্রচারের পূর্বেই সাংবাদিকতার নিয়ম মেনে জেনারেল আজিজকে পত্র মারফত তার বিরুদ্ধে প্রাপ্ত সকল অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চায়।
ইউপিএসের মাধ্যমে পাঠানো চিঠিটা সেনাপ্রধান পান, যার ডেলিভারি ট্র্যাকিং রেকর্ডও রয়েছে। এরপরেই জেনারেল আজিজ উপায়ান্তর না দেখে এর জবাব না দিয়েই সপরিবারে দেশ ছাড়েন। এই মুহুর্তে তিনি তার ছোট ছেলেকে (আর্মিতে সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন) নিয়ে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টেটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
জেনারেল আজিজ যদি আল জাজিরা টিভির এই প্রশ্নমালার জবাব সময়মতো দিতেন এবং অভিযোগ গুলো খন্ডানোর চেষ্টা করতেন তাহলে হয়তো এই অনুসন্ধানী অনুষ্ঠানটি এভাবে প্রচারিত হতো না,হলেও জেনারেল আজিজের বক্তব্য তাতে যুক্ত থাকতো।
সেনা প্রধানকে পাঠানো চিঠিতে আল জাজিরা যা যা লিখেছিলঃ (বাংলায় অনুবাদ)
১ ) আমাদের কাছে প্রমান আছে যে, আপনি আপনার ভাই হারিস আহমেদকে মোহাম্মদ হাসান মিথ্যা নামে জাল পাসপোর্ট, জাল ন্যাশনাল আইডি ও জাল জন্মসনদ বানিয়ে দিয়ে হাঙ্গেরি ও ফ্রান্সে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
২ ) ক্ষমতার অপব্যবহার করে হারিস আহমেদকে পালানোর ব্যবস্থা করে আপনি বাংলাদেশে বিচারে প্রক্রিয়ায় বাঁধা দিয়েছেন, যা বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আর নকল বা জাল পাসপোর্ট নিয়ে ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, মালয়েশিয়া, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য ও সিঙ্গাপুরে গমন করে সেই সকল দেশের আইন ভঙ্গ করেছে আপনার ভাই। এছাড়াও আপনার ভাই হারিস আহমেদ মিথ্যা নাম মোহাম্মদ হাসান ব্যবহার করে কমপক্ষে আটটি কোম্পানির শেয়ার ক্রয় করেছে, দুটি বাড়ি/সম্পদ ক্রয় করে হাঙ্গেরি ও ফ্রান্সে আরও অপরাধ করে।
৩ ) ২০১৪-১৫ সালে আপনি বিজিবি প্রধান থাকা অবস্থায় আপনার অধীনে তিন জন অফিসার আপনার ভাই হারিস আহমেদকে হাঙ্গেরিতে থাকা ও কাজের জন্য জাল কাগজপত্র, সনদ ও সত্যায়নে সাহায্য করে। আপনার অধীনস্থ অফিসার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল হাসনাত মোহাম্মদ খায়রুল বাসার ও মেজর মোহাম্মদ সুজাউল হক ২০১৪ সালে আপনার ভাই হারিস আহমেদের নকল ও জাল কাগজ পত্রে স্বাক্ষর করে ও সাক্ষী হয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে হাঙ্গেরিতে বসবাসের ও ব্যবসা করতে সাহায্য করে। তৃতীয় অফিসার আপনার এডিসি মেজর সামিউর রশিদ সকল জাল কাগজপত্র বিজিবি সদর হতে হাঙ্গেরিতে পাঠায়, যা হারিস আহমেদকে বাংলাদেশ বিচার প্রক্রিয়া থেকে পালাতে সাহায্য করে।
৪ ) আমাদের কাছে প্রমান আছে যে, জাল কাগজের মাধ্যমে আপনার ভাই ‘বে অফ বেঙ্গল’ নামে যে কোম্পানি বানিয়েছে, তাতে আপনি একজন পরিচালক হিসাবে অংশগ্রহণ করবেন ও আপনার অপর এক বন্ধুও অংশগ্রহণ করবে।
৫ ) ২০১৫ সালের ১০ নভেম্বর আপনার ভাইয়ের স্বাক্ষর করা একটা ব্যবসায়িক প্রস্তাব আমাদের কাছে আছে, যেই প্রস্তাবের মাধ্যমে আপনার ভাই বিজিবিতে বিছানা বিক্রয়ের প্রস্থাব করেছে। আপনি তখন বিজিবি প্রধান ছিলেন, একজন পলাতক আসামীকে কাজ দেয়া বিজিবি ও বাংলাদেশের স্বার্থ বিরোধী।
৬ ) আমাদের কাছে আপনার ভাইয়ের কথার রেকর্ডিং আছে, যেখানে আপনার ভাই বলেছে, সে আপনার পদ ও ক্ষমতা ব্যবহার করে ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে সামরিক বাহিনীর ভেতরে বিভিন্ন কাজের চুক্তি পায়।
৭ ) আমাদের কাছে প্রমান আছে যে, সেপ্টেম্বর ২০১৫ আপনি আপনার ভাই হারিস আহমেদের কাছে বুদাপেস্ট, হাঙ্গেরিতে ভ্রমন করেছেন, যেখানে আপনার ভাই বানোয়াট নামে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছ থেকে লুকিয়ে ছিল। আমাদের ধারণা, ঐ সময় আপনার ভাই ১৯৯৬ সালে মুস্তফা রহমানকে হত্যার দায়ে ইন্টারপোলে পলাতক হিসাবে মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকাভুক্ত ছিল।
৮ ) আমাদের কাছে প্রমান আছে যে, আপনি ৮ এপ্রিল ২০১৯ খুনের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত আরেক ভাই আনিস আহমেদের সাথে দেখা করতে কুয়ালামপুর, মালেশিয়া ভ্রমন করেন। আপনি সেখানে বাংলাদেশ দুতাবাসের গাড়ি ব্যবহার করে খুনের সাজাপ্রাপ্ত আসামী আনিস আহমেদকে নিয়ে যাতায়াত করেন। আপনার বাকি দুই ভাই হারিস আহমেদ ও জোসেফ আহমেদও আপনার সাথে মালেশিয়ায় দেখা করে।
৯ ) আমাদের কাছে আপনার ফোন আলাপের রেকর্ডিং আছে, যেখানে আপনি উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে আপনার কথা হয়েছে, আর প্রধানমন্ত্রী আপনাকে আশ্বাস দিয়েছে যেম আপনাকে সেনাপ্রধান বানাবে, এবং আপনার ভাইরা প্রধানমন্ত্রীর যেই সকল উপকার ও কাজ করেছে, তাঁর জন্য তাদেরকে খুনের অপরাধের সাজা থেকে খালাস দেয়া হবে। আপনি কি একথা অস্বীকার করতে পারবেন? একই ফোন আলাপে আপনি দাবী করেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেছে আপনার ভাইরা ১৯৮০/৯০ সালে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা প্রহরী হিসাবে কাজ করেছে। এসব কথা কি আপনি অস্বীকার করতে পারবেন?
১০ ) আমাদের কাছে প্রমান রয়েছে যে, আপনি সেনাপ্রধানের ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্যারা মিলিটারি ফোর্স র্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ানে অবৈধ হস্তক্ষেপ করতেন বেআইনি কাজ করাতে। র্যাবকে ব্যবহার করে আপনার ভাইদের বিরোধীদের উপর চাপ প্রয়োগ করাতেন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের গুম করান। র্যাবে লেফটেনেন্ট কর্নেল ও কর্নেল পদবীর আপনার লোক ছিল, যারা আপনার আদেশ পেলেই যে কোন অপকর্ম করতে পারে।
১২ ) আমাদের কাছে প্রমাণাদি আছে যে, আপনি সেনাপ্রধান হওয়ার পরেই ডিজিএফআইকে দিয়ে ইসরাইলে বানানো ফোনে আড়িপাতা যন্ত্র ক্রয় করেন। ডিজিডিপির স্বাক্ষর করা ক্রয়াদেশের কপি আমরা দেখেছি। ক্রয় চুক্তিতে মিথ্যা তথ্য প্রদান করা হয়েছে যে, যন্ত্রগুলো হাঙ্গেরিতে বানানো, অথচ যন্ত্রটি ইসরাইলের পিকসিক্স কোম্পানির বানানো। আপনি কি এই চুক্তি সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন না? আপনি কি জানেন যে, বাংলাদেশের সাথে ইসরাইলের ডিপ্লোম্যাটিক কোন সম্পর্ক নাই, তাই এই চুক্তি ও ক্রয় অবৈধ, এবং বাংলাদেশ আইনে শাস্তি যোগ্য অন্যায়?
১৩) আমাদের কাছে প্রমান আছে যে, খুনের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামী আপনার ভাই হারিস ও আনিস মার্চ ২০১৯এ আপনার ছেলের বিয়েতে ঢাকায় অংশগ্রহন করে। সেখানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এডভোকেট আবদুল হামিদও অংশে নেন। আপনার অপরাধী ভাইরা রাষ্ট্রপতির সাথে ছবি তোলে। আপনি কি ব্যাখ্যা করতে পারেন যে, কিভাবে খুনের সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামী আপনার ভাইয়েরা বাংলাদেশ সেনানিবাসের ভেতরে বিবাহ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করতে পারে?
১৪ ) আমাদের কাছে ফোন রেকর্ডিং আছে, যেখানে আপনি আপনার ব্যাচমেট অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল শহীদের তিন জন কর্মীকে ১৩ জানুয়ারি ২০১৯ এ গুম করা নিয়ে কথা বলেন। আপনি বলেছেন যে, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অবঃ) তারেক সিদ্দিক আপনাকে বলেছে যে, ঐ তিন জন কর্মী জঙ্গিবিরোধী গোয়েন্দা বিভাগের কাছে বন্দি আছে। অথচ ডিজিএফআই আল জাজিরাকে ১৮ মার্চ ২০১৯ জানিয়েছে যে, ঐ তিন কর্মীকে কর্নেল শহীদ নিজেই লুকিয়ে থাকার জন্য বলেছে। আপনি আরেক ফোন আলাপে বলেন যে, তদানীন্তন ডিজিএফআই প্রধান মেজর জেনারেল সাইফুল আবেদিন আপনাকে জানিয়েছিল ঐ তিন কর্মী ডিজিএফআই-এর কাস্টডিতে আছে, আর ডিজিএফআই কর্নেল শহিদের বাসায় ১৬ ও ১৭ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখে হানা দেয়। আপনি ফোনে বলেন যে, মেঃ জেঃ সাইফুল আবেদিন জানান যে মেঃ জেঃ অবঃ তারেক সিদ্দিকি এই গুমের ব্যাপারে সব জানেন, এবং ডিজিএফআই-এর লোক সেখানে উপস্থিত ছিল।
১৫) আপনি আরেক ফোন কলে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অবঃ) তারেক সিদ্দিক সকল গুম, খুন ও অবৈধ কাজগুলো করায় ডিজি এনটিএমসি ব্রিঃ জেঃ জিয়াউল আহসান ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা বিভাগের ডিজি মেজর জেনারেল জুবায়েরকে দিয়ে। আপনি বলেছেন, ডিজি ডিজিএফআই মেজর জেনারেল আবেদিন আপনাকে বহুবার জানিয়েছে যে, দেশের সকল গুম, খুন ও অন্যান্য অপরাধের কাজগুলো ঘটায় ব্রিঃ জেঃ জিয়াউল আহসান। ২৭ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬ টার মধ্যে আপনাকে উপরে উল্লেখিত সকল বিষয়ে ও প্রয়োজনে অন্য বিষয়ে আপনার মতামত বা উত্তর জানাতে আনুরোধ জানাচ্ছি।
[আল জাজিরা ইনভেস্টিগেশন টিম]