DMCA.com Protection Status
title=""

কুয়েতে দন্ডিত মিডনাইট এমপি পাপুল সংসদ সদস্য পদ হারাচ্ছেন!

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুুঃ   অবশেষে মানব ও অর্থ পাচারের দায়ে কুয়েতের আদালতের রায়ে দণ্ডিত লক্ষ্মীপুর-২ আসনের আওয়ামী লীগ সমর্থিত মিডনাইট সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের মামলার রায়ের কপিসহ যাবতীয় নথি হাতে পেয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

আরবি ও ইংরেজিতে লেখা ৬১ পৃষ্ঠার রায়ের কপি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের স্পিকারের দপ্তরে ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। সংবিধান, কার্যপ্রণালি বিধি ও আইন অনুযায়ী এখন তার সংসদ সদস্য পদ থাকা না থাকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে রায় পর্যালোচনা করছে সংসদ। পর্যালোচনা শেষে সিদ্ধান্ত জানাবেন স্পিকার।

সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা  জানান, পাপুলের সংসদ সদস্য পদ যাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। অর্থ ও মানব পাচারের মামলায় গত ২৮ জানুয়ারি পাপুলকে চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে কুয়েতের আদালত। পাশাপাশি তাকে ১৯ লাখ কুয়েতি রিয়াল বা ৫৩ কোটি টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। গত বছরের ৬ জুন রাতে কুয়েতের বাসা থেকে আটক করা হয় পাপুলকে। আটকের সাড়ে সাত মাস আর বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর সাড়ে তিন মাসের মাথায় দণ্ডিত হন তিনি। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো সংসদ সদস্যের বিদেশে আটক ও ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত হওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম।

কুয়েতের আদালতে পাপুলের সাজা হওয়ার বিষয়টি গত ৪ ফেব্রুয়ারি চিঠি দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাস। চিঠির সঙ্গে আরবি ও ইংরেজিতে লেখা রায়ের অনুলিপি এবং এ সংক্রান্ত পেপার কাটিংসহ যাবতীয় নথিও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে দূতাবাস।

রায়ের কপি সরকারের কাছে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। গতকাল শুক্রবার পূর্বাচলে ফেসবুকভিত্তিক নারী উদ্যোক্তাদের সংগঠন ‘উই’ এর পূর্বাচল ক্লাবে দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্বের অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ তথ্য জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পাপুলের রায়ের কপি স্পিকার ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এখন তারা বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেবেন।

আবদুল মোমেন বলেন, ‘আমাদের দেশের মতো কুয়েতেও রায়ের কপি আসতে অনেক দেরি হয়। এজন্য আমরাও পেরেশানিতে ছিলাম। মিডিয়া প্রায়ই জিজ্ঞাস করে, স্পিকারও প্রায়ই ফোন করেন এটা নিয়ে। এজন্য রায়টা যেন তাড়াতাড়ি পেতে পারি, সেজন্য আমাদের রাষ্ট্রদূতকে বলে রেখেছিলাম।’ এই রায়ের ভিত্তিতে পাপুলের সংসদ সদস্য পদের ভাগ্য কী হতে পারে—এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বিধি মোতাবেক এখন জাতীয় সংসদ কাজ করবে। উনি (পাপুল) আমাদের কাছে কোনো আইনি সহায়তা চাননি। উনি ওখানে ব্যবসায়ী হিসেবে থাকেন। আমাদের কোনো লাল পাসপোর্ট নিয়ে তিনি যাননি। উনার নিজেরই প্রয়োজনীয় স্টাবলিশমেন্ট রয়েছে। উনি ওখানকার রেসিডেন্ট, ব্যবসায়ী ছিলেন।’

 

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া তথ্যের বিষয়ে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী গতকাল  বলেন, ‘সম্পূর্ণ রায়টি আমরা পর্যালোচনা করব। যেটা আরবিতে রয়েছে সেটির বঙ্গানুবাদ করে পর্যালোচনা করা হবে। আর মূল রায়টি শেষদিকে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে, সেটিও পর্যালোচনা করা হবে। সবকিছু দেখার পর দেশের সংবিধান, কার্যপ্রণালি বিধি ও আইন অনুযায়ী আমরা একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারব।’

এক প্রশ্নের জবাবে স্পিকার বলেন, যেহেতু এখন কুয়েতের আদালতের রায়ের কপি পাওয়া গেছে তাই পরবর্তী পদক্ষেপের সম্পূর্ণ এক্তিয়ার স্পিকারের। অনেক দিন ধরেই সংসদ তার (পাপুল) বিষয়ে অফিশিয়ালি কিছু জানতে পারেনি। সেজন্য আমি নিজেও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম। যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কুয়েতের আদালতের রায়ের বিষয়ে অবহিত না হয়ে শুধু শুনে কিংবা পত্রপত্রিকায় দেখে তো সংসদ বা স্পিকার কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। স্পিকার বা সংসদ এখন অফিশিয়ালি অবহিত হয়েছে, এখন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ১৭২ বিধিতে বলা হয়েছে, ‘কোনো সংসদ সদস্য ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার হলে কিংবা কোনো আদালত কর্তৃক কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে বা কোনো নির্বাহী আদেশক্রমে আটক হলে গ্রেফতারকারী বা দণ্ডদানকারী বা আটককারী কর্তৃপক্ষ বা জজ বা ম্যাজিস্ট্রেট বা নির্বাহী কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে স্পিকারকে জানাবে।’ তবে পাপুলের বিষয়ে সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষ স্পিকারকে এতদিন কিছু জানায়নি।

কুয়েতের আদালতে দণ্ডিত হওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের সংবিধানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে কি না, সেক্ষেত্রে তার সংসদ সদস্য পদ থাকবে কি থাকবে না—তা নিয়ে অবশ্য মৃদু বিতর্ক রয়েছে। তবে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা স্পষ্টই বলছেন, দুই বছরের বেশি দণ্ডিত হওয়ায় পাপুলের এমপি পদ থাকবে না।

পাপুলের রায়ের আগে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ গনমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, ‘কুয়েতের আদালতেও যদি পাপুল দুই বছরের দণ্ডে দণ্ডিত হন তাহলে সংবিধান অনুযায়ী তার সংসদ সদস্য পদ থাকবে না। কোনো সংসদ সদস্য যে কোনো দেশের আদালতে দণ্ডিত হলেই তার এমপি পদ থাকার সুযোগ নেই। কারণ দণ্ডিত ব্যক্তি তো আর বাংলাদেশের আদালতে এসে আপিল করতে পারবেন না।’

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিকও  বলেছেন, ‘সংবিধানে বলা আছে দুই বছর বা এর বেশি কারাদণ্ড হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সংসদ সদস্য থাকতে পারবেন না। সেখানে তো কোনো সুনির্দিষ্ট দেশের আদালতের কথা বলা নেই। আমাদের সংবিধানের ৬৬ নম্বর অনুচ্ছেদের মূল উদ্দেশ্যই হলো—কোনো দণ্ডিত বা অপরাধী ব্যক্তি যেন সংসদে থাকতে না পারেন। আর পাপুল সাহেব কুয়েতের আদালতে দণ্ডিত হওয়ার পর উনি তো দেশে ফিরে সংসদকে কিংবা আদালতকে বলতে পারবেন না যে—তিনি দণ্ডিত হননি।’ সংবিধান অনুযায়ী, কোনো সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হবে কি না, সে সম্পর্কে কোনো বিতর্ক দেখা দিলে শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য তা নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাছে পাঠানো হয় এবং এ বিষয়ে কমিশনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।

 

কুয়েতে মানব পাচার ও ভিসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল টাকার মালিক হন পাপুল। টাকার জোরে ২০১৮ সালে লক্ষ্মীপুর-২ আসন থেকে স্বতন্ত্র এমপি হন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতায় ঐ আসনে মনোনয়ন পেয়েছিলেন জাতীয় পার্টির (জাপা) মোহাম্মদ নোমান। তবে নির্বাচনের সময় লক্ষ্মীপুরে প্রকাশ্য আলোচনা ছিল যে, ১২ কোটি টাকার বিনিময়ে নোমানকে নির্বাচনের মাঠ থেকে সরিয়ে দেন পাপুল। ঐ ঘটনার জেরে জাপাও পরবর্তী সময়ে নোমানকে দল থেকে বের করে দেয়। নিজে এমপি হওয়ার পর টাকার প্রভাবে স্ত্রী সেলিনা ইসলামকেও সংসদের সংরক্ষিত আসনের সদস্য বানান পাপুল। কুয়েতে গ্রেফতার হওয়ার পর দেশেও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের পৃথক দুই মামলায় পাপুলসহ ছয় জনের ৬৭০টি ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দিয়েছে ঢাকার আদালত। মানব ও অর্থ পাচারের অভিযোগে পাপুলসহ ছয় জনের বিরুদ্ধে গত বছরের ২২ ডিসেম্বর মামলা করে সিআইডি। আসামিদের মধ্যে তার মেয়ে, ভাই ও শ্যালিকাও রয়েছেন। এর আগে ১১ নভেম্বর মানব পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে শহিদ ও তার স্ত্রী সেলিনার বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের মামলায় পাপুলের স্ত্রী-শ্যালিকা জামিন পেলেও তথ্য জালিয়াতির দায়ে নতুন করে অভিযুক্ত হয়েছেন তারা।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!