ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ২০০৯ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারীর তথাকথিত বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা এবং তার পর সংঘটিত গনহত্যা বাংলাদেশের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ হিসাবে অত্যন্ত দু:খজনক একটি ঘটনা।
এই অনাকাংখিত ঘটনায় আমার প্রানপ্রিয় কয়েকজন কোর্সমেট ছাড়াও আমরা আমাদের সমসাময়িক বেশকিছু মেধাবী সেনা কর্মকর্তাকে হারিয়েছি চিরদিনের মতো। তাই যতোদিন বেঁচে থাকবো এই ঘটনা যেমন আমাদের তিলে তিলে কষ্ট দেবে,তেমনি এঘটনার মুলনায়কদের উপযুক্ত শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত কিছুতেই স্বস্তি পাবো না আমরা।
এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যা মোকাবেলা করতে না পারলে এর পার্শপ্রতিক্রিয়া বহুদিন পর্যন্ত টানতে হয়। ফেব্রুয়ারী ২০০৯ সালের পিলখানার ঘটনা এমনই। এর কারণ প্রধানতঃ ৪টি,
১. প্রথমটি, একটি বিদ্রোহ ঘটতে দেওয়া হয়েছে।
২ .দ্বিতীয় কারণ, এই বিদ্রোহকে স্বিকৃতি দেওয়া হয়েছে।
৩ .তৃতীয় কারণ, বিদ্রোহের ফলে ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তা এবং প্রায় দু’ডজন বেসামরিক কর্মকর্তা শহীদ হয়েছেন এবং তাদের পরিবার পরিজন হয়েছেন নিগৃহিত,যা সেনাবাহিনীর অফিসার মহলে স্থায়ী বিরুপ মনস্তাত্বিক ছাপ ফেলেছে।
৪. চতুর্থ কারণ হচ্ছে, এই ঘটনাটি বহুল আলোচিত এবং প্রবল ভাবে সমালোচিত । সমালোচিত হওয়ার কারণ হচ্ছে ঘটনাটি ব্যবস্থাপনা করার সময়, উচ্চতর সামরিক কমান্ডে প্রচন্ড দুর্বলতা দেখা গিয়েছে। ২০০৯ সালে তথ্যপ্রযুক্তির যুগের উৎকর্সতার সময় খবর যথাযথ জায়গায় পৌছাতে দেরি হওয়ার কথা না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বহু জায়গায় সংবাদ পৌছেছে। কিন্তু জেনারেল মঈন ইউ আহমেদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর উচ্চতর কমাণ্ড, তারও উপরে অবস্থিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমান্ড দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ ছিলেন ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়।
বিদ্রোহের শুরুতে মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল তার মোবাইল ফোন মারফৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ কে ফোন করে দ্রুত সাহায্য পাঠানোর জন্য অনুনয় বিনয় করেন। তিনি বলেন, বিদ্রোহীরা এখন পর্যন্ত সংঘবদ্ধ নয় এবং অতিদ্রুত সাহায্য পাঠালে তাদের পরাভূত করা কঠিন হবে না । এমন কি তিনি পিলখানার কোন কোন দিক থেকে সাহায্য আসলে ঢুকতে সহজ হবে সেই ধারনাও দেন।
অপর দিকে কর্নেল গুলজার ফোন করেন র্যাব এর মহাপরিচালক হাসান মাহমুদ খন্দকারকে (পরবর্তিতে আইজি,পুলিশ।বর্তমানে রাষ্ট্রদুত )এবং তাকে অতি দ্রুত সাহায্য পাঠাতে অনুরোধ করেন। কিন্তু বিধি বাম। বাংলাদেশের ইতিহাসের নৃশংসতম গনহত্যা ঠেকানোর কোন ব্যবস্থা না করে মূল্যবান প্রতিটি মূহূর্ত নষ্ট করা হলো। যতো সময় ক্ষেপন হচ্ছিলো পরিস্থিতি আস্তে আস্তে আমাদের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল। এধরনের পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী এবং সরকারের উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে যা যা করনীয় তা কি করা হয়েছিলো?
বিদ্রোহের খবর পাওয়ার সাথে সাথে বিডিআর এর নিজস্ব বেতার যোগাযোগ(দেশের সিমান্তবর্তী চৌকি গুলোর সাথে) জ্যাম করে দিয়ে সকল যোগাযোগ নিজস্ব কমান্ড পোষ্টে আনয়ন করা যেতো। তাতে করে পিলখানার বিদ্রোহীরা নিজেদের অবস্থান সুসংহত করার পর দুপুর ১২টা পর ঢাকার বাইরের সমস্ত বিডিআর দফতর গুলোর জওয়ানদের বিদ্রোহে সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হতো না কার্যকর ভাবে। ঐ একই সময় পিলখানার সকল টিএন্ডটির ল্যান্ড লাইন ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা ছিলো একান্ত জরুরী। বাকি থাকলো বিদ্রোহীদের মোবাইলফোন সংযোগ,আমার ঠিক জানা নেই একটি নির্দিষ্ট এলাকার সকল মোবাইল নেটওয়ারক সাময়িক ভাবে বন্ধ করে দেয়া সম্ভব কিনা তবে বিষয়টি সম্পূর্ন ভাবে বা আংশিক ভাবে করতে পারলেও এ বিদ্রোহ ঠেকানোতে বড় ধরনের সাফল্য আসতো বলে আমি মনে করি।
বাইরের সাথে প্রায় সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে ,নেতৃত্বহীন ও স্বল্পশিক্ষিত এই বিদ্রোহীদের উপর প্রবল মনস্তাত্বিকচাপ সৃষ্টি হতো, উদয় হতো অনিশ্চয়তার দোলাচল,যা কিনা তাদের মাঝে মানবিক দূর্বলতা এবং অনৈক্য সৃষ্টি করতে বাধ্য। এই অবস্থায় অবিলম্বে আত্বসমর্পন না করলে চতুর্দিক থেকে আক্রমন করে তাদের পরাভূত করা হবে,এই মর্মে রেডিও,টিভি,এলাকায় আকাশ থেকে লিফলেট এবং প্রকট ভাবে বহুসংখ্যক মাইক বাজিয়ে ক্রমাগত ঘোষনা দেয়ার পরও কোন ফলাফল না আসলে সামরিক অভিযান পরিচালনা করা না করার সিদ্ধান্তে আসা যেতো । ।কিন্ত এর কোন কিছুই না করে ,বিদ্রোহীদের সব কথা বিশ্বাস করে তাদের সাথে দিনভর সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীর টেলিকথোপকথন এবং পরবর্তিতে বঙ্গভবনে প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্যে বিদ্রোহীদের নেতা ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের দলের সাথে চলে আলাপ আলোচনা এবং শেরাটনের সুস্বাদু খানাদানা।
সাধারন জ্ঞানের হিসাবে বলে এধরনের জিম্মি মুক্তির আলোচনায় আটককৃতদের অবস্থা সক্রিয় বিবেচনায় নেয়া হয় এবং জিম্মিদের সাথে কথা বলে তাদের নিরাপদ সুস্থতা যাচাইয়ের উপর বিদ্রোহীদের দাবীদাওয়া মেনে নেয়া নির্ভর করে। বিডিআর দরবার হলে উপস্থিত কিন্তু ভাগ্য ক্রমে বেচে যাওয়া গুটি কয়েক সেনা অফিসারের ভাষ্য অনুযায়ী বিদ্রোহের প্রথম কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ডিজি,বিডিআর সহ প্রায় সকল অফিসারকে হত্যা করা হয়। তাহলে কাদের বাঁচানোর জন্য সরকার দিনভর বিদ্রোহীদের সাথে আলোচনা করেছিলো?? তাদের দাবীদাওয়া নিয়ে আলোচনা শুরুর পূর্বশর্ত হওয়া উচিৎ ছিলো ডিজি সহ কয়েক জন সিনিয়ার অফিসারের সাথে ফোনে কথা বলে তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া । তা কি আদৌ করা হয়েছিলো??
আমি মনে করি বাংলাদেশ সরকারে এবং সেনাবাহিনীতে এই অতি সাধারন জ্ঞানটি রাখেন, এধরনের ব্যক্তির কোনো অভাব নেই তবে সেরকম কোনো চেষ্টা হলো না কেনো??
কেনো ২৫শে ফেব্রুয়ারী ২০০৯ রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের কাছে কিছু অস্ত্র সমর্পন এবং কয়েকটি সেনাপরিবার পরিজন কে উদ্ধারের নাটক গনমাধ্যমে দেখানো হলো??
কেনো পরদিন রাতে পিলখানা এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে এই বিপুল সংখ্যক বিদ্রোহীকে পালিয়ে যেতে দেয়া হলো?
এদুদিনের রাজনৈতিক সমাধানে সরকার কি অর্জন করেছিলো?? ৫৭জন পদস্থ সেনাঅফিসার কে তো ২৫শে ফেব্রুয়ারী দূপুরের আগেই হত্যা করা হয় তবে কাদের রক্ষার জন্য সেনা অভিযান চালানো হয়নি??
সেনা পরিবারদের বাচানোর জন্য? আমার মনে হয় না। এই বিদ্রোহের ফলশ্রুতিতে আমরা হারালাম আমাদের প্রানপ্রিয় অমূল্য ৫৭ জন অফিসারকে,বহুকালের গৌরবময় স্মৃতি বিজরিত সিমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআর এর হলো অপমৃত্যু আর জাতীর বিবেক আজীবনের জন্য হলো প্রশ্মবিদ্ধ ।
অফিসারদের উপর ক্ষুব্ধ হয়েই যদি এই বিদ্রোহ করা হয়ে থাকে তবে অফিসারদের অতি দ্রুত হত্যা করা হলো কেনো??
দাবী আদায়ের স্বার্থে মৃত অফিসারদের চেয়ে জীবিত অফিসাররাই বেশী কার্যকর হতো বলে আমি মনে করি। বিদ্রোহীদের সব দাবীদাওয়া মেনে নেয়া পরও (ডিএডি তৌহিদ কে বিডিআর মহাপরিচালক ঘোষনা সহ)তারা রাতের আধারে পালিয়ে গেলো কেনো??
কেনো যেনো আমার মনে হয় কোথাও একটি বিশাল কিন্তু রয়েছে,এ ধরনের অনেক প্রশ্ন রয়েছে যার উত্তর জানার অধিকার জাতির রয়েছে,জানতে চায়।
যে দ্রুততা এবং ক্ষিপ্রতার সাথে ৫/৬ইমে'২০১৩ এ মতিঝিল শাপলাত্বরের অভিযান পরিচালনা করে ঢাকাকে তথাকথিত শত্রু মুক্ত করা হয়েছিলো ,সে ধরনের এ্যাকশন ২৫/২৬শে ফেব্রুয়ারী'২০০৯ এ পিলখানায় অবরুদ্ধ আমার প্রানপ্রিয় সেনাঅফিসার ও তাদের পরিবার পরিজন দের রক্ষায় কেনো নেয়া হয়নি,এর জবাব আওয়ামী লীগ এবং তাদের স্থাবক তৎকালীন সেনাপ্রধান জেঃ মঈন ইউ আহমেদকে একদিন অতি অবশ্যই দিতে হবে।
নাটের গুরুদের আড়ালে রেখে শুধু মাত্র লোক দেখানো বিচার জাতি কখনই মেনে নেবে না। আমি শোকাবহ ২৫ শে ফেব্রুয়ারী কে অবিলম্বে জাতীয় শোক দিবস ঘোষনার জোর দাবী জানাচ্ছি। এই দুঃখজনক ঘটনার পর আমরা এই ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর ব্যর্থতার দায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকারের উপর চাপালেও, তারাই যে এঘটনা ঘটিয়েছে বা এ ঘটনায় ইন্ধন জুগিয়েছে তা কিন্তু প্রথমে বলিনি,বিশ্বাস করতে চাইনি এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দান কারী দলটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অসীম অবদান রাখা বাহিনী ইপিআর, পরবর্তি কালের বিডিআর ধংশের মতো কোনো কাজ করতে পারে।
কিন্তু আওয়ামী সরকারের গত ১১ বছরের বিভিন্ন কর্মকান্ড আমাদের ভাবনার যথেষ্ট খোরাক যুগিয়েছে।বিডিআর বিদ্রোহ ও হত্যকান্ডের বিচারের দির্ঘ সূত্রিতা, সেনাবাহিনীর তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ না করা, প্রধানমন্ত্রীর সভায় (দরবার)এ নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিবাদকারী এবং দোষীদের বিচার দাবী কারী সেনা অফিসারদের কৌশলে চাকুরী থেকে অব্যহতি দান করা, সর্বমহলের দাবী ২৫শে ফেব্রুয়ারীকে জাতীয় সেনা কিংবা জাতীয় শোক দিবস ঘোষনায় অনিচ্ছা ও অনিহা প্রকাশ করা,সর্বপরি এই শোকাবহ কান্নার দিনটিতে অতিতে এশিয়া কাপের মতো আনন্দঘন উদ্বোধনী উৎসব আয়োজনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জনমনে আজ বহু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ কি ১৫ আগষ্ট এর মতো শোকাবহ দিনে এধরনের কোনো উৎসব আয়োজন করতে পারতো??
এসকল পরিস্থিতিতে কুইক ডিসিশন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সেনা প্রধান মঈন ইউ আহমদ সিদ্ধান্ত নিতে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করেছেন। যার ফলশ্রুতিতে যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে। এর দায় দায়িত্ব শেখ হাসিনা এবং মঈন ইউ আহমদকেই ব্যক্তিগতভাবে অবশ্যই বহন করতে হবে। এখানে অন্য কারো দায়িত্ব নেওয়ার জায়গা নাই। একজন প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন। অনেকেই এর সাথে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। সেই মতের প্রতি সম্মান রেখেই আমার এ বক্তব্য।
ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজু , সাবেক সেনা কর্মকর্তা,রাজনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষক।