ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ অবৈধ প্রক্রিয়ায় আড়াই হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ফরিদপুরের আলোচিত দুই ভাই রুবেল, বরকতসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে সিআইডি। ওই অভিযোগপত্রে ৩ নম্বর আসামি করা হয়েছে শেখ হাসিনার বেয়াই, সাবেক মন্ত্রী ও ফরিদপুর–৩ আসনের সাংসদ খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ভাই খন্দকার মোহতেশাম হোসেন ওরফে বাবরকে। খন্দকার মোশাররফের সাবেক এপিএস এ এইচ এম ফোয়াদকে ৪ নম্বর আসামি করা হয়েছে। ফোয়াদ জেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়কও।
বুধবার মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) উত্তম বিশ্বাস ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ অভিযোগপত্র জমা দেন।
অভিযোগপত্রভুক্ত অন্য ৬ আসামি হলেন- শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি খন্দকার নাজমুল ইসলাম ওরফে লেবি, শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসিবুর রহমান ওরফে ফারহান, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ফাহাদ বিন ওয়াজেদ (ফাইন), শহর যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল হাসান (ডেভিড), জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ আলী (মিনার) ও শহর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক তরিকুল ইসলাম (নাসিম)।
পুলিশ সূত্র জানায়, এ মামলায় কারাগারে রয়েছেন দুই ভাই রুবেল–বরকত, খন্দকার নাজমুল ইসলাম ও আসিবুর রহমান। বাকি ছয়জনকে গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারির আবেদন করা হয়েছে। গ্রেপ্তার চারজনই দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন ওরফে বরকত ও ফরিদপুর প্রেসক্লাবের বহিষ্কৃত সভাপতি ইমতিয়াজ হাসান ওরফে রুবেলের বিরুদ্ধে গত বছরের ২৬ জুন ঢাকার কাফরুল থানায় মামলা করেন সিআইডির পরিদর্শক এস এম মিরাজ আল মাহমুদ। মামলায় ওই দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে দুই হাজার কোটি টাকার সম্পদ অবৈধ উপায়ে অর্জন ও পাচারের অভিযোগ আনা হয়।
প্রায় আট মাস তদন্তের পর সিআইডি গতকাল ওই মামলার অভিযোগপত্র দিল। মামলায় শুধু ওই দুই ভাইকে আসামি করা হলেও অভিযোগপত্রে তাঁকে প্রশ্রয় দেওয়া ও সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়েছে অন্যদের বিরুদ্ধে। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, সাবেক মন্ত্রীর ভাই বাবর ও এপিএস ফোয়াদের আশ্রয়–প্রশ্রয়ে অন্যদের সহযোগিতায় বরকত ও রুবেল এই বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন। অভিযোগপত্রে ১০ জন আসামি ছাড়াও বরকত-রুবেলের আরও ৪২ সহযোগীর কথা বলা হয়েছে। যার মধ্যে খান মাহাবুবের মৃত্যু হয়েছে। বাকি ৪১ জনের বিষয়ে তদন্ত চলছে।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, বরকত ও রুবেল ১৯৯৪ সালে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক মহিউদ্দিন খোকন হত্যায় অভিযুক্ত হয়ে এলাকা ছাড়েন। ২০০৮ সাল পর্যন্ত তাঁদের তেমন সম্পদ ছিল না। বরকত ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের পক্ষে নৌকা মার্কার নির্বাচন করেন। পরে খন্দকার মোশাররফ মন্ত্রী হলে বরকত তাঁর আস্থা অর্জন করেন। পরে মন্ত্রীকে দিয়ে পুরোনো আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের দল থেকে বহিষ্কার করান বরকত। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফের চারদিকে একটি বলয় তৈরি করের মন্ত্রীর ভাই মোহতেশাম হোসেন, মন্ত্রীর এপিএস এইচ এম ফোয়াদ। তাঁদের দিয়ে ওই দুই ভাই ফরিদপুর জেলার রোডস, পিডব্লিউডি, এলজিইডি, হেলথ, বিআরটিএ, পৌরসভা, বিদ্যুৎ, জেলা পরিষদ, ফ্যাসিলিটিজ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, টেপাখোলা গরুর হাট, সিঅ্যান্ডবি ঘাট ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সব ধরনের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ ও কমিশন–বাণিজ্য শুরু করেন। সঙ্গে তাঁরা মাদক ব্যবসা, পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি ও জেলা রেজিস্ট্রারের অফিসে দলিলসংক্রান্ত কমিশন নিতে শুরু করেন। পরে জোর করে নিরীহ মানুষের জমি দখল করে নামমাত্র মূল্যে ক্রয় করেন তাঁরা। সেসব জমির অধিক মূল্য দেখিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণও তোলেন দুই ভাই। বিভিন্ন ব্যাংকে তাঁদের ১৭১ কোটি টাকা ঋণ আছে। এসব অবৈধ টাকা দিয়ে ফরিদপুর ও রাজবাড়ীতে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি কিনে টাকা বৈধ করার চেষ্টা করেন তাঁরা। বরকত ও রুবেল এবং তাঁদের স্ত্রী, ভাই, শ্বশুর ও মায়ের নামে ৪৮৭টি দলিলে মোট ৫ হাজার ২৮৮ বিঘা জমির সন্ধান পাওয়া যায়। যার দলিলমূল্য ৩৯২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।
২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চার বছরে এলজিইডির ৪৭৫টি ঠিকাদারি কাজ পান বরকত ও রুবেল, যার আর্থিক মূল্য ৮১২ কোটি ২৬ লাখ টাকা। ওই সময়ে দুই ভাইয়ের নয়টি ব্যাংকের ১৮৮টি হিসাবে ২ হাজার ৯১০ কোটি ৭১ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। এই টাকার মধ্যে তাঁদের ২ হাজার ৫৩৫ কোটি ১১ লাখ টাকার কোনো বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি।
তাঁদের প্রায় ৫ হাজার ৩৮৮ বিঘাজমি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য সরঞ্জাম এবং ব্যাংকে রক্ষিত পৌনে ১০ কোটি টাকা ক্রোক করা হয়েছে।
এ মামলার বাদী সিআইডির পরিদর্শক এস এম মিরাজ আল মাহমুদ বলেন, সহযোগী হিসেবে বাকি ৪১ জনের ব্যাপারে তদন্ত চলছে। তাঁদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেলে আদালতে সম্পূরক চার্জশিট জমা দেওয়া হবে।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বরকত ও রুবেলের ৫ হাজার ৭০৬ বিঘা জমি ক্রোকের আদেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে তাঁদের ১৮৮টি ব্যাংক হিসাবে থাকা প্রায় ১০ কোটি টাকা ক্রোকের আদেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি তাঁদের মালিকানাধীন ৫৫টি বাস, ট্রাক ও ব্যক্তিগত গাড়ি জব্দের আদেশ দেন আদালত।
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, তাঁদের গাড়িসহ অন্যান্য সরঞ্জাম ৬৭টি, জমি ৫ হাজার ৩৮৮ বিঘা ও পৌনে ১০ কোটি টাকা ক্রোক করা হয়েছে।
গত বছরের ১৬ মে রাতে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহার বাড়িতে দুই দফা হামলার ঘটনা ঘটে। ওই মামলার আসামি হিসেবে গত বছরের ৭ জুন রাতে রুবেল, বরকতসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর মধ্য দিয়ে ফরিদপুরের রাজনীতিতে খন্দকার মোশাররফ ও তাঁর পরিবারের যে আধিপত্য ছিল, তার অবসান হয়। এ মামলাই যে ঐতিহ্যবাহী এ জেলার রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেবে, তা কে জানত।