কর্ণেল মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি (অবঃ) : পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্য ও বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে ১৯৬৫ সালের পূর্বে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের প্রবেশাধিকার ছিল খুবই সীমিত। ক্যাডেট কলেজ হতে একাডিমেক রেজাল্টের মেধা তালিকার শীর্ষস্থান অধিকারীদের অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবে যাচাই-বাছাই ও সর্বদিক বিচার বিবেচনা করে সামরিক বাহিনীতে নির্বাচিত করা হতো। আর ১৯৫৩ সালে তো সেটা আরো কঠিন ছিল। কিন্তু অসাধারণ মেধাবী ও চৌকস হবার কারণে ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমির ১২তম দীর্ঘ মেয়াদী কোর্সে জিয়া ও সফিউল্লাহ নির্বাচিত হন এবং ১৯৫৫ সালে কমিশন লাভ করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তিনি চৌকস অফিসার হিসেবে দাপটের সাথে চাকরি করেছেন। তাঁর ক্যারিশমেটিক নেতৃত্বের কারণে জিয়া তখন হতেই সিনিয়র-জুনিয়র সকলের নিকট দারূণ জনপ্রিয়।
☆ পেশাগত দক্ষতা ও অন্যান্য সকল যোগ্যতার মাপকাঠিতে জিয়ার অবস্থান অনেক উপরে ছিল বলেই তিনি সকল ভালো ভালো পদবীতে নিয়োগ পেয়েছিলেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি সামরিক দক্ষতার অনন্য নজির স্থাপণ করেন। ফলে তাঁকে আর পিছনে ফিরে তাঁকাতে হয়নি। যোগ্যতার কারণে তাঁর অনেক সিনিয়রকে ডিঙ্গিয়ে তিনি দেশে-বিদেশে উচ্চতর পেশাগত প্রশিক্ষণ অর্জণের সুযোগ পান। ১৯৭০ সালেই জ্যেষ্টতার তালিকায় তিনি লেফটেনেন্ট কর্ণেল পদে পদোন্নতির জন্য প্রথমে ২ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পরে ৮ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে উপ-অধিনায়ক হিসেবে যোগদান করেন। মহান আল্লাহর পরিকল্পনা অত্যন্ত সুক্ষ্ম; তিনি মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে জিয়ার মতো একজন অসাধারণ দুঃসাহসী যোদ্ধাকেই বেঁছে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর পক্ষ হতে আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য। আর এ জন্যই হয়তো তিনি বদলী হয়েছিলেন চট্টগ্রাম সেনাবিনাসে ৮ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক হিসেবে। দেশের স্বার্থে তাঁর অধিনায়কের মতো সর্বাধিক শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্বকে হত্যা করার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেও তিনি পিছ পা হননি। এটা যে কত উচ্চমানের দুঃসাধ্য কঠিন কাজ তা সামরিক বাহিনীর সদস্য ব্যতীত অন্য কারো বুঝা সহজ নহে।
☆ দেশের সেই এক দুঃসময়ে জিয়া আরো দুঃসাহসী ভূমিকা পালন করে প্রথমে বললেন, ‘উই রিভোল্ট’ এবং পরাধীনতার নাগপাশ ভেঙ্গে বজ্রকন্ঠে ঘোষনা করলেন দেশের স্বাধীনতা। যে ঘোষণা শুনে হতভম্ব জাতি দিশা খুঁজে পেল, সামরিক বাহিনীর সদস্যগণ হলেন উজ্জীবিত। একের পর এক বিদ্রোহ ঘোষণা শুরু করলো পূর্ব পাকিস্তানের ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের পাঁচটি ইউনিট ও সামরিক-আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা। তখন হতেই দুই অক্ষরের ‘জিয়া’ নামটি সামরিক বাহিনী সদস্য ও বাঙালিদের মুখে মুখে। জিয়া ছিল এমন এক দুঃসাহসী পিলে চমকানো নাম, যে নামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হৃদয় প্রকম্পিত হতো। একই ভাবে বাঙালিদের নিকট ছিল অতিপ্রিয় একজন সামরিক নেতা জিয়া। রণাঙ্গনে জিয়াউর রহমান শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারই ছিলেন না, তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, একজন সেক্টর কমান্ডার ও ফোর্স প্রধান। এভাবেই হয়তো মহা পরিকল্পনাকারী মহান আল্লাহ জিয়াকে প্রস্তুত করেছিলেন সবচেয়ে সঙ্কটময় সময়ে দেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার জন্য।
☆ ১৯৭২ সালে সিনিয়র জেনারেল জিয়াকে ডিঙ্গিয়ে তাঁর জুনিয়র জেনারেল সফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান করা হলেও সামরিক বাহিনীতে জিয়া ছিলেন অধিক পরিচিত ও সর্বাধিক জনপ্রিয়। জেনারেল সফিউল্লাহও তাঁকে সম্মান করতেন। ১৯৭৫ সালে খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমানকে নির্মম ভাবে হত্যার পর দেশের অবস্থা যখন টাল-মাটাল সে সময়ে অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ২৪ আগষ্ট মোশতাক সরকার জিয়াউর রহমানকে সফিউল্লাহর স্থলাভিষিক্ত করলেন। সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আড়াই মাসের মাথায় সংঘটিত হয় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের ঐতিহাসিক ঘটনা। জিয়াউর রহমান তখন এতই জনপ্রিয় ছিলেন যে, সামরিক বাহিনীর সকল সদস্য এবং রাজনীতিবিদ ও তাঁদের কর্মীগণও জিয়াউর রহমানকে দেশের সরকার পরিচালনার শীর্ষপদে আসীন করান। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম পদত্যাগ করায় উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব হস্তান্তর করেন।
☆ এরপরের ইতিহাস সকলেরই জানা। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাঁর নিজ কর্মধারা দায়িত্ববোধ, নিষ্ঠা, শ্রম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, সাহস ও নিখাঁদ দেশপ্রেম দ্বারা দেশের আপামর জনসাধারণের নিকট অকল্পনীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। দেশ ও জাতির নির্ভরযোগ্য অভিভাবক হিসেবে তিনি রাষ্ট্রের প্রশাসন, রাজনীতি, অর্থনীতি, বিদেশনীতিতে বৈপ্লবিক এক পরিবর্তন এনে দেশকে বিশ্বের দরবারে এমন এক উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেন যে, জনগণ ফিরে পায় তাঁদের আত্ম-মর্যাদা ও সম্মানবোধ। যা ছিল রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানে ঢেলে দেয়া ত্যাগ-তিতিক্ষা ও শ্রম সাধনার ফসল।
মহান আল্লাহ্ সুবাহানু ওয়া তায়ালা এ মহান নেতাকে জান্নাতের উচ্চ আসনে স্থান দান করুন। আমীন।
লেখকঃ সাবেক সেনা কর্মকর্তা এবং সামরিক ও ইতিহাস বিশ্লেষকঃ