DMCA.com Protection Status
title="৭

দুই ছেলে রাসেল-রুবেলের অযোগ্যতায় মরহুম হাশেমের পারটেক্স গ্রুপ হুমকির মুখে!

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ          দেশের অভিজাত এলাকায় বহুল আলোচিত দুই নাম শওকত আজিজ রাসেল  রুবেল আজিজ। ক্লাবপার্টিমডেলগার্লদের সাথে সখ্যতা সহ নানা কারণেই সময়ে অসময়ে আলোচনার তুঙ্গে ওঠেন তারা।  দুই সহোদর পারটেক্স গ্রুপের স্বপ্নদ্রষ্টা মরহুম এমএ হাশেমের যমজ সন্তান। একেবারেই শূন্য থেকে ব্যবসা শুরু করেছিলেন এমএ হাশেম। চার দশকের পরিশ্রম আর সাধনায় পারটেক্স গ্রুপকে দেশের শীর্ষস্থানীয় করপোরেটে রূপ দিয়েছিলেন তিনি।

জীবদ্দশায় স্ত্রীসহ পাঁচ ছেলের মধ্যে ব্যবসা  সম্পদ বণ্টন করে দিয়েছিলেন এমএ হাশেম। পাশাপাশি উত্তরাধিকারীদের ব্যাংকঋণের দায়দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। পিতার দেখানো পথে ব্যবসা সম্প্রসারণে সন্তানরা উদ্যোগীও হয়েছেন। যদিও উদ্যোক্তা হিসেবে সফল পিতার কনিষ্ঠ এই দুই সন্তান এরই মধ্যে পথ হারিয়েছেন।

ব্যবসায় মনোযোগী হওয়ার পরিবর্তে বিলাসী জীবন বেছে নিয়েছেন শওকত আজিজ রাসেল  রুবেল আজিজ। একাধিকবার গুলশান  বনানী ক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন তারা। রাজধানীর অভিজাত এলাকায়  দুই সহোদরের দাপটও চোখে পড়ার মতো। যদিও ব্যাংকঋণের দায় মেটাতে একের পর এক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিক্রি করছেন রুবেল আজিজ। অন্যদিকে ব্যবসার আকারের চেয়ে ঋণ বেড়ে যাওয়ায় চাপ বাড়ছে শওকত আজিজ রাসেলের প্রতিষ্ঠানগুলোতে।

উত্তরাধিকার হিসেবে শওকত আজিজ রাসেল পেয়েছেন পারটেক্স গ্রুপের অংশ আম্বার বস্ত্রসুতাপার্টিকেল বোর্ডকাগজপর্যটনসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ আছে আম্বারের।  গ্রুপের এক ডজন কোম্পানির নামে দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণ রয়েছে প্রায়  হাজার কোটি টাকা। আম্বার গ্রুপের সবচেয়ে সফল প্রতিষ্ঠান ছিল আম্বার ডেনিম মিলস লিমিটেড। যদিও গত কয়েক বছরে প্রতিষ্ঠানটির নগদ অর্থপ্রবাহের (ক্যাশ ফ্লোতুলনায় দায় বেড়ে গেছে অনেক বেশি। গ্রুপটির অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অবস্থাও সংকটাপন্ন।

শওকত আজিজের চেয়েও খারাপ পরিস্থিতিতে পড়েছেন তার সহোদর রুবেল আজিজ। পিতার উত্তরাধিকার হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন পারটেক্স গ্রুপের অন্তত সাতটি কোম্পানির মালিকানা। মাম পানিআরসি কোলার মতো সুপরিচিত ব্র্যান্ডের পারটেক্স বেভারেজ লিমিটেডের পাশাপাশি তার মালিকানায় রয়েছে পারটেক্স প্লাস্টিকজুটকয়লারিয়েল এস্টেট  তেল পরিশোধনাগার। তবে পারটেক্স বেভারেজ ছাড়া অন্য সবকটি কোম্পানিই বর্তমানে বন্ধ হওয়ার পথে। যদিও তার কোম্পানিগুলোর নামে বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণ রয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা।

রাসেল  রুবেলের প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঋণ দেয়া ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেনএমএ হাশেম দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তা ছিলেন। উদ্যোক্তা হিসেবে তার উজ্জ্বল ভাবমূর্তির কারণে ব্যাংকগুলো অনেক ক্ষেত্রে জামানত ছাড়াই ঋণ দিয়েছে। ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে পারটেক্স গ্রুপের সুনামও ছিল। কিন্তু রাসেল  রুবেল আজিজের প্রতিষ্ঠানগুলো যে পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছেতাতে ঋণ আদায় নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। এরই মধ্যে ব্যাংকে  দুই সহোদরের প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের কিস্তি বকেয়া হতে শুরু করেছে। করোনাকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া নীতিছাড়ের কারণে তাদের ঋণ  মুহূর্তে খেলাপি হচ্ছে না। তবে আগামী বছর থেকে রাসেলরুবেলের প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ নিয়ে বিনিয়োগকারী সব ব্যাংককেই ভুগতে হবে।

রুবেল আজিজের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে পারটেক্স পেট্রো লিমিটেডপারটেক্স বেভারেজ লিমিটেডপারটেক্স কোল লিমিটেডপারটেক্স এভিয়েশনপারটেক্স প্লাস্টিকপারটেক্স জুট মিলস  পারটেক্স প্রপার্টিজ লিমিটেড। এর মধ্যে পারটেক্স পেট্রো লিমিটেডের নিবন্ধন নেয়া হয় ২০১৫ সালে। নিবন্ধনের সময় পেট্রোকেমিক্যাল খাতে সম্ভাব্য বিনিয়োগের পরিমাণ ঘোষণা করা হয়  হাজার ৫৭৫ কোটি ৯২ লাখ টাকা। ২০১৭ সালের মধ্যেই বিনিয়োগ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময়সীমা বিওআইয়ে উল্লেখ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। চট্টগ্রামে কর্ণফুলীর ডাঙ্গারচরে প্রকল্পটির কারখানা স্থাপন করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন শুরু হলে প্রতিদিন ১০ হাজার ব্যারেল (বিপিডিধারণক্ষমতার কনডেনসেট রিফাইনারি (ফ্র্যাকশনকেএনএইচটিসিআরইউপণ্য ট্যাংক ও ইউটিলিটিনির্মিত হওয়ার কথা। যদিও উৎপাদন শুরুর সময়সীমা অনেক আগে পেরিয়ে গেলেও এখনো উৎপাদনে আসতে পারেনি তেল পরিশোধনাগারটি।

১১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানার ডাঙ্গারচরে পারটেক্স পেট্রো লিমিটেডের কারখানায় গিয়ে দেখা যায়কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষেই কারখানাটির ভবন নির্মিত হয়েছে। গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় দিয়ে বন্ধ থাকা কারখানাটিতে প্রবেশের অনুমতি চাইলে সেটি দেয়া হয়নি। কারখানার ভেতরে থাকা কর্মকর্তারা  বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে কারখানাটির অবকাঠামো নির্মাণকাজ কয়েক বছর ধরেই চলছে বলে জানিয়েছেন দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তারক্ষীরা। তারা জানানপেট্রোলিয়াম পণ্য যে মেশিন দিয়ে তৈরি করা হবে সেগুলো প্রতিস্থাপনের কাজ চলছে। কারখানা চালু করার জন্য এখনো সম্পূর্ণ লোকবল নিয়োগ করা সম্পন্ন হয়নি। লোকবল নিয়োগ  মেশিনারিজ স্থাপন করে মালিকপক্ষ খুব দ্রুতই কারখানাটি চালু করবে বলে তারা শুনেছেন।

বিপুল লগ্নির পারটেক্স পেট্রোর উৎপাদন শুরু করতে না পারলেও উত্তরাধিকার হিসেবে প্রাপ্ত পারটেক্স জুট মিলস এরই মধ্যে আকিজ গ্রুপের অন্যতম কর্ণধার শেখ বশির উদ্দিনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন রুবেল আজিজ। প্রায় ৩৫০ কোটি টাকায় পাটকলটির সম্পদ কিনে নিয়েছেন শেখ বশির উদ্দিন। পাশাপাশি তার কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে পারটেক্স এভিয়েশনের দুটি হেলিকপ্টারও। গত বছরের শেষের দিকে এসব সম্পদ বিক্রি করে ঢাকা ব্যাংকব্যাংক এশিয়াসহ কয়েকটি ব্যাংকের কিছু ঋণ পরিশোধ করেছেন রুবেল আজিজ।

 প্রসঙ্গে ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমরানুল হক বলেনরুবেল আজিজ পারটেক্স জুট  এভিয়েশনের সম্পদ বিক্রি করে দেয়ায় আমরা বিপদ থেকে বেঁচে গেছি। যেকোনো প্রতিষ্ঠানের অর্থের নগদ প্রবাহের তুলনায় ঋণ বেড়ে গেলে সেটি আর লাভজনক পরিস্থিতিতে থাকে না।  ধরনের প্রতিষ্ঠানের জন্য ইকুইটি পার্টনার খোঁজা বা বিক্রি করে দেয়াই উত্তম সমাধান।

শওকত আজিজ রাসেলের মালিকানায় থাকা আম্বার গ্রুপের অধীনে কোম্পানি রয়েছে এক ডজনের বেশি। গ্রুপটির আওতাধীন কোম্পানিগুলো হলো আম্বার কটন মিলস লিমিটেডআম্বার সুপার পেপার লিমিটেডআম্বার ডেনিম মিলস লিমিটেডআম্বার ডেনিম লিমিটেডআম্বার ক্র্যাফট পেপার লিমিটেডআম্বার বোর্ড মিলস লিমিটেডআম্বার সুপার ইয়ার্ন লিমিটেডআম্বার আইটি লিমিটেডআম্বার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডবিডি হাব লিমিটেড  ঢাকা এফএম। রাসেলের মালিকানাধীন এসব কোম্পানির ব্যবসা পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। ব্যাংকাররা বলছেনআম্বারের ডেনিম  কটন মিলগুলো বাজার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। ফলে গ্রুপটির বিভিন্ন কোম্পানির নামে থাকা প্রায়  হাজার কোটি টাকা ব্যাংকঋণের কিস্তিও অনিয়মিত হয়ে পড়ছে। ক্যাশ ফ্লোর তুলনায় দেনার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় শওকত আজিজ রাসেলের ব্যবসায়িক ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে যাচ্ছে।

গাজীপুর জেলার রাজেন্দ্রপুরের জাঙ্গালিয়াপাড়ায় অবস্থিত আম্বার কটন মিলস লিমিটেড  আম্বার ডেনিম মিলস লিমিটেডের কারখানা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন সচল আছে। তবে আগের তুলনায় কারখানায় উৎপাদন কমিয়ে দেয়া হয়েছে বলে শ্রমিক  নিরাপত্তারক্ষীরা জানিয়েছেন।

শওকত আজিজ রাসেল  রুবেল আজিজের বিভিন্ন কোম্পানিতে ঋণ আছে ব্যাংক এশিয়াসাউথইস্ট ব্যাংকমার্কেন্টাইল ব্যাংকমিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকজনতা ব্যাংকসহ সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকের। এসব ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীসহ দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেনব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পর ফেরত না দেয়ার একটি সংস্কৃতি তৈরি হয়ে গেছে। সে তুলনায় এখনো পারটেক্স গ্রুপের কিছু কোম্পানির ঋণ পরিশোধ পরিস্থিতি ভালো। তবে শওকত আজিজ রাসেল  রুবেল আজিজের কোম্পানিগুলো যেভাবে দুর্বল হচ্ছেতাতে উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া দরকার। তা না হলে কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি ব্যাংকও বড় ধরনের বিপদে পড়বে।

ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোআরফান আলী বলেনএকটি শিল্প গ্রুপের ভালোমন্দের সঙ্গে দেশের অর্থনীতি  কর্মসংস্থান নিবিড়ভাবে জড়িত। পারটেক্স গ্রুপে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। উদ্যোক্তা হিসেবে কেউ ব্যর্থ হোকশ্রমিকরা চাকরি হারাকএটি আমরা দেখতে চাই না।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (্এবিবিসাবেক চেয়ারম্যান  মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেনদেশের বড় করপোরেটগুলো এখনো দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। হাতে গোনা কয়েকটি শিল্প গ্রুপ দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে অনেক বেশি বিকশিত হয়েছে। মূল উদ্যোক্তার অবর্তমানে অনেক সম্ভাবনাময় শিল্প গ্রুপকে হারিয়ে যেতে দেখছি। আমরা চাইপ্রকৃত করপোরেট সংস্কৃতি আত্মস্থ করার মাধ্যমে পারটেক্স গ্রুপ আরো বড় হোক।

সামগ্রিক বিষয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে চেষ্টা করেও রুবেল আজিজের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে শওকত আজিজ রাসেল বণিক বার্তাকে বলেনআমাদের পিতা মারা যাওয়ার আগেই সন্তানদের মধ্যে সম্পদ  ব্যাংকঋণ ভাগ করে দিয়েছিলেন। আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ অংশের ব্যবসার হাল ধরেছি। করোনার কারণে ব্যবসায় মন্দা ভাব আছে। তবে  পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি আমরা।

ব্যাংকঋণ পরিশোধের বিষয়ে শওকত আজিজ রাসেল বলেনআম্বার অংশের যেসব ব্যাংকঋণ আছেতার বেশির ভাগই ননফান্ডেড। আমি ব্যাংকগুলোর কাছে  কোটি ডলার পাব। রফতানির বিপরীতে  অর্থ প্রত্যাবাসনের অপেক্ষায় আছে। তাছাড়া আমার কারখানা সংখ্যা ১৭। এর মধ্যে শুধু ডেনিমেরই আছে চারটি কারখানা। এর প্রতিটি কারখানা  হাজার ৫০০ কোটি টাকায় বিক্রি করা যাবে। আমাদের কাছ থেকে ঋণ আদায় নিয়ে ব্যাংকারদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।

পারটেক্স পেট্রো লিমিটেডে উৎপাদন শুরু হলে রুবেল আজিজের ব্যবসা পরিস্থিতিও ঘুরে দাঁড়াবে বলে মন্তব্য করেছেন শওকত আজিজ রাসেল। তিনি বলেনতেল পরিশোধনাগার নির্মাণে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। কারখানাটি এখন পরীক্ষামূলকভাবে চালু আছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এটির উৎপাদন শুরু হবে।

সূত্রঃ বনিক বার্তা।

 

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!