ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বাংলাদেশের কোনো নাগরিক যাতে সাইবার অপরাধের শিকার না হন সেজন্য ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কঠোরভাবে নিয়মিত মনিটর করতে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ।
তিনি পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সরকার ও পুলিশ বাহিনীর প্রদত্ত অনুশাসন মেনে চলার নির্দেশ দেন।
গতকাল মঙ্গলবার (১৪ সেপ্টেম্বর) তিন দিনব্যাপী অপরাধ পর্যালোচনা সভায় সমাপনী বক্তৃতায় আইজিপি এ নির্দেশ দেন। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের হল অব ইন্টেগ্রিটিতে অনুষ্ঠিত এ সভায় সব অতিরিক্ত আইজি, রেঞ্জ ডিআইজি, মেট্রোপলিটন কমিশনার, সব জেলার এসপি, মেট্রোপলিটন এলাকার উপ-কমিশনাররা উপস্থিত ছিলেন।
সম্প্রতি দেশে ও দেশের বাইরে একটি চক্র রাষ্ট্র, বঙ্গবন্ধু পরিবার, সরকার, বিচার বিভাগ, শিল্পপতিসহ সমাজে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে নানা ধরনের বিষেদগার ছড়াচ্ছে। ভাড়া করা কিছু সাইবার সস্ত্রাসী গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করা গেলেও দেশের বাইরে থাকায় ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর জবাবদিহিতা না থাকায় এসব অপরাধীকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। দেশের প্রথম সারির কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ তুলে ধরে ক্রাইম কনফারেন্সে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা এ বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনার ওপর জোর দিলে আইজিপি তাদের এ বার্তা দেন।
আইজিপি বলেন, ‘এবার নতুন নীতিমালায় পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ করা হচ্ছে। এটা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে হবে। আমরা পাশের বিভিন্ন দেশ এবং উন্নত অনেক দেশের নিয়োগ নীতিমালা পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ পুলিশের উপযোগী কনস্টেবল নিয়োগ নীতিমালা প্রণয়ন করেছি। এর ফলে কনস্টেবল পদে মেধা ও শারীরিক দিক থেকে অধিকতর যোগ্যতাসম্পন্ন পুলিশ সদস্য নিয়োগে সক্ষম হব। অচিরেই পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর ও সার্জেন্ট পদে নতুন নীতিমালা অনুযায়ী লোক নিয়ােগ করা হবে।’
আইজিপি আরো বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট নির্দেশনায় আমরা দেশ ও জনগণের কল্যাণে দুর্নীতিমুক্ত পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পুলিশের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
মাদকের বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আইজিপি বলেন, ‘পুলিশের কোনো সদস্যের মাদকের সঙ্গে কোনো ধরনের সংশ্লিষ্ট থাকতে পারবে না। কারও যদি মাদকের সঙ্গে কোনো ধরনের সংশ্লেষ থাকে তাহলে তাকে বেরিয়ে আসতে হবে। কোনো পুলিশ সদস্যের মাদক গ্রহণ, মাদক ব্যবসা বা মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সখ্য প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একজন পুলিশ সদস্য হিসেবে এমন কোনো কাজ করা যাবে না যাতে পুলিশ বাহিনীর ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দেশের জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
বাংলাদেশ পুলিশকে একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী উল্লেখ করে আইজিপি বলেন, ‘বাহিনীর শৃঙ্খলা এবং কল্যাণ এক বিষয় নয়। শৃঙ্খলাকে কল্যাণের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা যাবে না। বাহিনীর শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে কোনো ধরনের আপোস করা যাবে না। কোনো পুলিশ সদস্য শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করতেও আমরা যথেষ্ট সচেষ্ট রয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘জুনিয়রদের কাজকর্ম তদারক করতে হবে। তাদের পুলিশ বাহিনীর একজন যোগ্য সদস্য হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব সিনিয়র সহকর্মীদের পালন করতে হবে।’
জনগণের দোরগোড়ায় পুলিশি সেবা নিয়ে যাওয়ার কার্যকর একটি পদ্ধতি ‘বিট পুলিশিং’ উল্লেখ করে ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে সামাজিক অনেক অপরাধ প্রতিরোধ করা যায়। বিট পুলিশিংয়ের কারণে বর্তমানে মামলা অর্ধেকে নেমে এসেছে।’ তিনি বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে চুরি, ডাকাতিসহ অন্যান্য অপরাধ দমনে তৎপর হওয়ার জন্য মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন।
উদ্ভাবনী পুলিশিংয়ের ওপর জোর দিয়ে পুলিশপ্রধান বলেন, ‘পুলিশিংয়ের ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী কৌশল ব্যবহার করতে হবে। পুলিশে বেস্ট প্র্যাকটিসের চর্চা বাড়াতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা যেখানেই কাজ করি না কেন আমাদের পদচিহ্ন রেখে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে; যাতে মানুষ আমাদের স্মরণ করে, মনে রাখে।’
পুলিশ প্রধান সাধারণ মানুষের প্রতি আচরণ বদলানোর আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘মানুষের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এজন্য প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো। আর এটা এখনই করা যায়। এতে সময় এবং আর্থিক বিনিয়োগ কোনোটারই প্রয়োজন হয় না।’ মামলার সঠিক তদন্ত পুলিশের প্রধান দায়িত্ব উল্লেখ করে আইজিপি বলেন, ‘মামলা তদন্তের মান আরও বাড়াতে হবে। তদন্তের প্রতি অত্যন্ত মনোযোগী হতে হবে। তদারকি বাড়াতে হবে।’
ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার ও বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন হচ্ছে। এসব প্রজেক্টে অনেক বিদেশি নাগরিক কাজ করছেন। তাদের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কিছুদিন পরই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। সেখানে যেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না হতে পারে সেজন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘শুধু চাকরি করলে হবে না। চাকরিতে প্রাইড নিয়ে আসতে হবে। এজন্য মানসিকতা ও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন আনতে হবে।’ আইজিপি পুলিশ বাহিনীকে বটবৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, ‘সংগঠন যত বড় হবে তত এর শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে। দেশ ও দেশের মানুষ এর থেকে উন্নত সেবা পাবে।’