ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিএনপি সহ দেশের বিরোধী দল সমূহ জোর দাবী তুললেও সেটিকে মোটও আমলে নিচ্ছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
এই দাবিতে বিএনপির আন্দোলনের হাঁকডাকেও গা করছে না দলটি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কয়েকজন নেতা গনমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বিগত নির্বাচনের মতোই আগামী জাতীয় নির্বাচনও দলীয় সরকারের অধীনেই হবে। এর আগে সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠন করা হবে। সংবিধান অনুসারে ওই নির্বাচন কমিশনের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন হবে। এর বাইরে আওয়ামী লীগের কোনো ইচ্ছা বা পরিকল্পনা নেই।
আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার মতে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অগণতান্ত্রিক শক্তিকে ক্ষমতায় আসার পথ করে দেয়। এ ছাড়া নির্দলীয় সরকারের অধীনে এখন পর্যন্ত কোনো বিতর্কমুক্ত নির্বাচন করা যায়নি। ফলে সারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই সংবিধান অনুসারে নির্বাচন কমিশনের পুরো কর্তৃত্বে আগামী সংসদ নির্বাচন হবে। এ ইস্যুতে বিএনপির দাবিকে কোনোভাবেই আমলে নেওয়া হবে না। আর বিগত দিনের মতো দলটি যদি আন্দোলনের পথে হাঁটে, সে ক্ষেত্রে তা মোকাবেলায় সরকার ও আওয়ামী লীগ প্রস্তুত থাকবে।
সরকারি দলের সূত্রগুলো জানায়, এ মুহূর্তে আগামী নির্বাচনের আগে বিএনপির আন্দোলন নিয়ে তেমন কোনো ভাবনা নেই তাদের। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারকরা দল গোছানোর দিকেই বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছেন। দীর্ঘদিন টানা ক্ষমতায় থাকায় তৃণমূলে দলের যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল তীব্র হয়েছে, সেগুলো নিরসন করাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কাজ শুরু করেছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। তাঁরা নির্বাচনের আগে দলকে সংগঠিত করাকেই বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন। কারণ বিএনপির আন্দোলন মোকাবেলার জন্য শক্তিশালী সংগঠন প্রয়োজন হবে।
আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো জানায়, বিএনপির আন্দোলনের হুমকি আওয়ামী লীগের গায়ে না মাখার বড় কারণ হলো বিগত এক যুগের বেশি সময়ে দলটির কোনো আন্দোলন কর্মসূচি সফল না হওয়া। বিএনপির বারবার ব্যর্থতা আওয়ামী লীগকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। দলের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণী পর্যায় মনে করে, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব শূন্যতার ফলে তারা তেমন কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে না। ক্ষমতায় গেলে কাকে প্রধানমন্ত্রী করা হবে সে বিষয়টি জাতির সামনে তারা স্পষ্ট করতে পারবে না। ফলে তাদের আন্দোলন বা নির্বাচনে সাধারণ মানুষের সমর্থন মিলবে না। আর জনগণের সক্রিয় সমর্থনহীন যেকোনো আন্দোলন মোকাবেলা করার মতো শক্তি সরকার ও আওয়ামী লীগের রয়েছে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপি তাদের কথা বলুক। কথা বলতে তো তাদের কেউ না করেনি। কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আমাদের নতুন কোনো ভাবনা নেই। কিভাবে নির্বাচন হবে তা শাসনতন্ত্রেই বলা হয়েছে। সেভাবেই আগামী নির্বাচন হবে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান এ দেশের নির্বাচনকে নষ্ট করেছিলেন হ্যাঁ-না ভোটের মাধ্যমে। তাদের মুখে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে এত লম্বা কথা মানায় না।’
দলের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনই সব দায়িত্ব পালন করে। নির্বাচনকালে সরকার শুধু রুটিন দায়িত্ব পালন করে। নির্বাচন কমিশনের ওপর সরকারের প্রভাব খাটানোর কোনো সুযোগ নেই। এটিই সারা বিশ্বের স্বীকৃত ব্যবস্থা। আমাদের এখানে কয়েকটি নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছে। একটি নির্বাচনও পরাজিত পক্ষ ভালোভাবে মেনে নেয়নি।’ তিনি বলেন, ‘আগামী দিনেও এমন নির্বাচন কমিশন গঠন হবে, যারা তাদের শপথ অনুসারে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করবে। আমি আশা করব, এই নির্বাচনে সবাই অংশ নেবে। কিন্তু বিএনপি যদি অহেতুক আন্দোলনের পথে যায়, নির্বাচনকে বানচাল করতে চায়, সংবিধানকে না মানে, তবে দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী তাদের দায়িত্ব পালন করবে। আমরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও শান্তিপূর্ণ ও রাজনৈতিকভাবে তাদের মোকাবেলা করব।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, ‘সার্চ কমিটির মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন খুবই গ্রহণযোগ্য একটি পদ্ধতি। এভাবেই নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে। একটি আইন প্রণয়নও সরকারের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে। তবে আগামী নির্বাচনের আগে এই আইন প্রণয়নের বাস্তবতা কম। সংবিধান অনুসারে এই নির্বাচন কমিশনের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’
দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘বিএনপি নিজেদের দলই তো চালাতে পারছে না। নিজেরাই নিজেদের বিশ্বাস করে না। তারা কিভাবে আন্দোলন করবে? নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন করতে চাইলে তো জনসমর্থন লাগবে। এটা কি তাদের আছে?’ তিনি বলেন, ‘বিএনপি যে নির্দলীয় সরকার চাচ্ছে তার সঙ্গে তো সংবিধানের মিল থাকতে হবে। তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনে অংশগ্রহণের চেয়ে নির্বাচন থেকে সরে গিয়ে নির্বাচনকে বিতর্কিত করার চেষ্টায় থাকে। আগামী নির্বাচন সংবিধান অনুসারেই হবে। দায়িত্বশীল সব রাজনৈতিক দলের উচিত এই নির্বাচনে অংশ নেওয়া। সে ক্ষেত্রে অংশীজন হিসেবে বিএনপির কোনো গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব থাকলে আমরা অবশ্যই বিবেচনা করব।’
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘সংবিধানে যেকোনো ধরনের ফাঁক সৃষ্টি করে দিলে কতিপয় ক্ষমতালিপ্সু জনসমর্থনহীন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দেশের এক বা একাধিক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন পরাশক্তির সমর্থন দেখিয়ে প্রোভোক করে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা বিনষ্ট করার সুযোগ পাবে। জাতির অতীত অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। সুতরাং ভবিষ্যতে নির্দলীয় সরকার বা এহেন কোনো ধরনের দেশ ও গণতন্ত্রবিরোধী দাবি পূরণ করা সম্ভব নয়।’
দলের আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, ‘জনগণের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির প্রচলন হয়েছিল। কিন্তু ২০০১-এ ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বিতর্কিত করেছে। এখন আর মানুষের কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। মহামান্য আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তার বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’