ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী বলেছেন,বাংলাদেশ ও ভারতের দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে যে দুই ব্যক্তিত্ব নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মহাত্মা গান্ধী। বঙ্গবন্ধু ও মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক আদর্শে মিল রয়েছে। তারা উভয়েই অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও অহিংস নীতির মাধ্যমে মানুষের মুক্তির আন্দোলন শুরু করেছিলেন। বাংলাদেশ ও ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রামে আরেকটি খুব বড়ো মিল যে, দুই দেশের সংগ্রামেই সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা রয়েছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের মহাত্মা গান্ধীর জীবনী-নির্ভর তথ্যচিত্র নিয়ে শনিবার ‘বঙ্গবন্ধু-বাপু ডিজিটাল প্রদর্শনী’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভারতীয় হাইকমিশনার এসব কথা বলেন। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশন, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির যৌথ উদ্যোগে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই প্রদর্শনী।
বিক্রম দোরাইস্বামী আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু-বাপু ডিজিটাল প্রদর্শনী আমাদের দুই দেশের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী জীবনকে উদযাপন করছে। মুজিব শতবর্ষ, মহাত্মা গান্ধীর সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী এবং ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে প্রদর্শনীটি বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে। তবে করোনার কারণে দেরিতে হলেও এই প্রদর্শনীটি যে হচ্ছে, এজন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন ভারতীয় হাইকমিশনার।
শনিবার সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমিতে এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন শিক্ষা মন্ত্রী ড. দীপু মনি। সংস্কৃতি সচিব মো. আবুল মনসুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ ও ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, দুই জন ভিন্ন সময়ের মানুষ, কিন্তু উভয়ই ইতিহাস রচনা করেছেন। নিজেদের জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন, দুই জনই আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন। একজন অহিংসাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ব্রিটিশ রাজত্বের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। অপরজন ভাষা ও সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে নিপীড়িত জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রায় এককভাবে যুদ্ধ করেছেন। একজন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং অপরজন ভারতের মহাত্মা গান্ধি বা বাপু। এই দুই কালজয়ী মানুষকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য একসঙ্গে তৈরি করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু-বাপু প্রদর্শনী।
সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, স্বাধীনতার জন্য আমরা ভারতের সহযোগিতার প্রতি কৃতজ্ঞ। বঙ্গবন্ধু-বাপু শীর্ষক এই প্রদর্শনীতে দুই নেতার বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য সময়ের বর্ণনা সংবলিত ডিজিটাল উপস্থাপনা রয়েছে। বিশেষ করে দুই দেশের দুই মহান ব্যক্তিকে এই প্রদর্শনীতে সমৃদ্ধ এবং বিশেষায়িত প্রযুক্তিতে তুলে ধরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
মহাত্মা গান্ধী ডিজিটাল জাদুঘরের কিউরেটর বিরাদ ইয়াগনিক দ্বারা বিশেষভাবে পরিচালিত এই ডিজিটাল প্রদর্শনীটি আগামী ১১ অক্টোবর পর্যন্ত একাডেমির জাতীয় চিত্রশালার ৩ নম্বর গ্যালারিতে চলবে। প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। প্রদর্শনীতে উপমহাদেশের দুই বরেণ্য নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং মহাত্মা গান্ধীর জীবনী নির্ভর ভ্রাম্যমাণ তথ্যচিত্রসহ দুই নেতার বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য সময়ের বর্ণনা সংবলিত ডিজিটাল উপস্থাপনা রয়েছে।
প্রদর্শনীটি আয়োজন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু আর বাপুকে নিয়ে। ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী ও বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একসঙ্গ তুলে ধরা হয়েছে বঙ্গবন্ধু-বাপু ডিজিটাল প্রদর্শনীতে। উঠে এসেছে দুই মহামানবের সংগ্রামী জীবনকে, তাদের অবদানকে। সেইসঙ্গে এ দুই ব্যক্তিত্বের সংগ্রামী জীবনে তাদের সহধর্মিণী ও পরিবারের আত্মত্যাগ রয়েছে প্রদর্শনীতে তাদের কথাও গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রদর্শনীর প্রবেশ মুখেই দুই মহামানবের আলোকচিত্র। যার উপরে লেখা ‘জয় বাংলা’ ও ‘অহিংসা’। বঙ্গবন্ধু ও বাপুর এ দুটি শব্দই যেন তাদের রাজনৈতিক আদর্শের মন্ত্র, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা। বঙ্গবন্ধু-বাপু ডিজিটাল প্রদর্শনীটি ২২টি তথ্য দেয়াল এবং শতাধিক ডিজিটাল মুহূর্তের সমন্বয়ে তৈরি। প্রদর্শনী শুরু হয় পরিচিতি প্রাচীর দিয়ে। যেখানে যা প্রদর্শনীর বিষয়বস্তুকে তুলে ধরার পাশাপাশি প্রশংসাপত্রের মাধ্যমে বিশ্বের চোখে মহান দুই মহান নেতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। পরবর্তী দুটি দেয়াল দুই নেতার জীবনের বিস্তৃত পটভূমি প্রদর্শন করে। ১৯৪৭ সালের আগস্টে দুই নেতার সাক্ষাতের দিনটির উপর ভিত্তি করে নির্মিত ‘মিটিং ওয়াল’ এ প্রদর্শিত ছবিটি সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র ছবি যেখানে বঙ্গবন্ধু এবং বাপু উভয়ই এক ফ্রেমে রয়েছেন।
অপরদিকে, একটি হলোগ্রাফিক টাইম মেশিনের মাধ্যমে ঐতিহাসিক ছবিগুলিকে একটি সময়রেখার সাথে সাজানো হয়েছে। যার ফলে দর্শনার্থীরা সময় এবং জীবনকাল সম্পর্কে বুঝতে পারেন। পরবর্তী অংশটি তাদের তারুণ্যের দিনগুলির কিছু ঘটনার বর্ণনা করে। যখন তাদের রাজনৈতিক ভাবনাগুলি কাঠামো নিচ্ছিল। পরবর্তী দেয়ালটি তাদের জীবনের তিনটি বিখ্যাত আন্দোলনকে প্রদর্শন করেছে। একটি হলো লবণ সত্যাগ্রহ, যেটিকে টাইম ম্যাগাজিন আধুনিক ইতিহাসের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনের মধ্যে বিবেচনা করে। এবং অন্যটি ৭ই মার্চের ভাষণ, যেটি ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে, বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্যের দলিল হিসেবে। মানুষের দুর্দশা, যন্ত্রণা এবং অবিচারের দৃশ্য জালিয়ানওয়ালাবাগ এবং বাংলাদেশের ২৫ মার্চের গণহত্যা সুড়ঙ্গের মধ্যে উপস্থাপন করা হয়েছে। দর্শনার্থীদের জন্য ১৯৭১ সালের ঘটনাগুলি পর্যায়ক্রমে সাজানো হয়েছে। প্রদর্শনীতে একটি রোবোটিক স্বাক্ষর দেখানো হয়েছে। সঙ্গে দুই নেতার প্রিয় সঙ্গীতও রাখা হয়েছে।
বাপুর স্ত্রী কস্তুরবা গান্ধী; যাকে ‘বা’ বলে অভিহিত করা হয় তাকে এবং বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসাকে উৎসর্গ করেও নির্মিত হয়েছে একটি দেয়াল। এ দুই নারী তাদের সঙ্গীদের পাশে দাঁড়িয়ে সব সময়ই প্রেরণা যুগিয়েছেন, দিয়েছেন সাহস। তাদের কথাও উঠে এসেছে প্রদর্শনীতে।
দুই মহান নেতা তাদের দেশ ও জনগণের জন্য যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা পরবর্তী অংশে প্রদর্শিত হয়েছে। প্রদর্শনীটির শেষ অংশে চলমান মহামারী বিষয়ে একটি সামাজিক বার্তা প্রদান করে। দর্শনার্থীদের একটি ইন্টারেক্টিভ দেয়ালে তারা যে তথ্য শিখেছে তা সংযুক্ত করার সুযোগ ছিলো। প্রদর্শনীর বিদায়ী অংশে দর্শনার্থী দুই নেতার সাথে একটি ছবি ভুলতে পারেন এবং একটি ভিডিও প্রশংসাপত্র রেখে যেতে পারবেন দর্শকরা।